ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

কথা বলা সাইকেল

প্রকাশিত: ০৬:২১, ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

কথা বলা সাইকেল

বাবা বাইসাইকেলের সঙ্গে কথা বলে। যে জায়গাটায় বসে বাবা ন্যাকড়া দিয়ে বাইসাইকেলটা মুছে, তেল দেয়, মবিল দেয়। সেই জায়গাটার ঠিক উল্টো দিকে একদিন রেশাদ বসে রইল। আগের দিনই রেশাদ পরিকল্পনা করে রেখেছে, বাবা আর সাইকেলটার কথোপকথনে আড়ি পাতবে। কারণ ওকে শুনতেই হবে বাবা তার সাইকেলটার সঙ্গে কী কথা বলে। আড়ি পাতার উদ্দেশ্যেই সেদিন সকাল সকাল উঠা রেশাদের। বাবা প্রতিদিন সকালে উঠে যতœসহকারে রেশাদের বাইসাইকেলটাকে রেডি করে স্কুলে যাওয়ার জন্য। ঘুম থেকে উঠেই ছেলে নাস্তা করে সাইকেল নিয়ে স্কুল যাবে। সাইকেলটাকেও তো রেডি করতে হবে। রেডি করা মানে ওই মোছামুছি করে ঝকঝকা তকতকা করা। আর সাইকেলের সকালের নাস্তা হিসেবে সেই পোড়া মবিল আর তেল। আর বাবা এভাবে রেডি করতে করতে খোশগল্পে মেতে উঠে সাইকেলটার সঙ্গে। একদিন বিছানা থেকে রেশাদ শুনতে পেল বাবার গলা, ‘বুঝেছিস? বুঝেছিস তো!’ শুনেই চট করে বিছানা থেকে নেমে বাইরে বেড়িয়ে দেখে কেউ ঘুম থেকে ওঠেনি। শুধু বাবা উঠেছে। বের হয়ে বাবাকে ছাড়া আর কাউকে দেখতে পেল না। সামনে শুধু তার বাইসাইকেলটা আছে। বাবা রেশাদকে দেখেও না দেখার ভান করে যতœসহকারে সাইকেলটা মুছতে থাকল অনবরত। রেশাদ সেদিনই আঁচ করতে পেরেছিল বাবা তার সাইকেলটার সঙ্গে লুকিয়ে লুকিয়ে কথা বলে। আড়ি পেতে কিছুটা সফল হলো সেদিন। মানে বাবা আর সাইকেল এর মধ্যে কথোপকথনের একটা অংশ শুনতে পেল। একটা অংশ মানে বাবার অংশটা। বাবা সেদিন সাইকেলটাকে বলতেছিল, ‘কি-রে খবর সবর সব ঠিক তো! কোন সমস্যা হচ্ছে না তো? চোখ কান খোলা রাখছিস তো? রেশাদ স্কুলে গিয়ে দুষ্টামি করে না তো? আর তোকে তালা মারতে ভুলে যায় না তো? জানিস তো আমার বড় ছেলে মোর্শেদ খালি হারায় আর হারায়। এর আগের রেশাদের সাইকেলটা ও নিয়ে গিয়ে তালা মারতে ভুলে গেল। আর এই সুযোগে চোর নিজের মনে করে দরদাম ছাড়াই সাইকেলটা নিয়ে গেল। এমনই বোকা আমার বড় ছেলে। রেশাদ অবশ্য অত বোকা নয়। তোর কী মনে হয়? অধিকাংশ সময় তো তুই ওর সঙ্গেই থাকিস। তাই না?’ বাবা একটু থেমে বলে, ‘হু! তবুও তুই সবসময় এলার্ট থাকবি। রেশাদের তোকে তালা মারতে ভুলে গেলে যে কোন পথ অবলম্বন করে মনে করে দিবি। আর খুব সাবধানে পথ চলবি। এই ছেলেটা আমার কলিজার টুকরা। ওর কোন ক্ষতি হলে তোর কিন্তু কোনভাবেই রক্ষা নেই। বুঝেছিস? বুঝেছিস তো!’ বাবার একতরফা এই কথাগুলো কানে এলো রেশাদের। তবে বাবার প্রত্যেকটি প্রশ্নবোধক বাক্যের পর কিছুক্ষণ থেমে থেমে কথা বলেছিলেন বাবা। রেশাদ ভেবেছে নিশ্চয় বাইসাইকেলটা তার উপস্থিতি টের পেয়ে বাবার সঙ্গে ফিসফিস করে কথা বলেছে। যে কারণে বাবার কথা শুনতে পেলেও শুনতে পায়নি সাইকেলটার কথা। গত পরশুদিনের আগের দিনের ঘটনা। স্কুলে যাওয়ার সময় সেই সাইকেলে এক্সিডেন্ট করে ফেলল রেশাদ। সাইকেলটার একটা চাকা দুমরেমুছরে গেল। সিট থেকে হ্যান্ডেল বরাবর যে রডটা থাকে সেটাও ভেঙ্গে গেল। পায়ের হাঁটুতে একটু চামড়া উঠে যাওয়া ছাড়া সৌভাগ্যবশত রেশাদের কিছুই হয়নি। এরপর যা হবার কথা নয় তাই হলো। বাবা সাইকেলটাকে সাইকেল মেকারের কাছ থেকে অপারেশন করিয়ে নিয়ে ঠিক করার পর সেটা বিক্রি করে দিল খানসামার হাঁটে গিয়ে। গতকাল বাবা একটা নতুন সাইকেল নিয়ে এসেছে রেশাদের জন্য। নিশ্চয় বাবা এই সাইকেলটার সঙ্গেও কথা বলার সন্ধি করতে পারে। ঠিক এই ভেবে আজ সকালেও রেশাদ আড়ি পেতেছে ঠিক সেই আগের জায়গাটায়। বাবা নতুন সাইকেলটাকে কী বলে শুনতেই হবে ওকে। বাবা নতুন সাইকেলটাকে ন্যাকড়া দিয়ে মুছতে মুছতে বলতে শুরু করল, ‘এ্যাই শোন তোকে নতুন নিয়ে আসা হয়েছে রেশাদের জন্য। জানিস তো? রেশাদ হচ্ছে আমার মেজ ছেলে। এক রাত এই বাসায় থেকে নিশ্চয় জেনেছিস তা। হয়তো আরও জেনেছিস যে,এর আগের সাইকেলটা বিক্রি করে দেয়া হয়েছে। কেন দেয়া হয়েছে নিশ্চয় জানিস?’ বলেই বাবা একটু থামল। এই ফাঁকে নিশ্চয় নতুন সাইকেলটা জিজ্ঞেস করেছে, ‘কেন?’ বাবা এরপর আগের সাইকেলটার অপরাধসমূহ বর্ণনা করল অনেকক্ষণ ধরে। তারপর বলল, ‘তোর জন্য প্রথম দিনে সাবধান বাণী। কোনভাবেই দুর্ঘটনায় পড়া যাবে না। ছেলে আমার সোনার পুতলা, কলিজার টুকরা। ওর কিছু হলে কোনভাবেই তোর কিন্তু রক্ষা নেই। সাবধানে পথ চলতে হবে। তোকে যেমন যতœ করি তার চেয়ে বেশি যতœ করতে হবে আমার ছেলেকে! বুঝেছিস? বুঝেছিস তো!’ বাবার এসব কথা আড়ি পেতে শুনছিল রেশাদ। হঠাৎ পেছন থেকে ওর মাথায় কার জানি হাত পড়ল। হাত পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ইলেকট্রিকের শক খাওয়ার মতো চমকে উঠল ও। পেছন ফিরে তাকালো সঙ্গে সঙ্গে। দেখল মা পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। রেশাদ নিজের মুখে একটা আঙ্গুল ঠেকিয়ে মাকে চুপ করে থাকার ইশারা করল। যদিও মা জানে ছেলে তাকে কি জন্য চুপ করে থাকার ইশারা করল। তবুও না জানার ভান করে মা ছেলের ইশারায় চুপ করে থাকল। অনেকক্ষণ বাবা আর সাইকেল এর কোন কথোপকথোন শোনা গেল না। আর কিছু আজকে হয়ত শোনা যাবে না। এই ভেবে মার হাত ধরে নিজের ঘরে মাকে নিয়ে এলো। মাকে ফিস্ ফিস্ করে বলল, ‘মা, তুমি কী জান আমি কি জন্য আড়ি পেতেছিলাম?’ মা’ও ফিস্ফিস্ করে বলে, ‘হু, জানি তো।’ ‘তাহলে কি তুমিও শুনেছো সাইকেলের সঙ্গে বাবার কথা বলা।’ ‘হু।’ ‘মা সাইকেল কি বাবার সঙ্গে কথা বলে?’ ‘না।’ ‘মা, তাহলে কী বাবা পাগল হয়ে গেছে?’ ‘না।’ একটু থেমে মা আবার বলে,‘হ্যাঁ’ ও বলা যায়।’ রেশাদ বলে, ‘না আবার হ্যাঁ! এটা কী ধরনের কথা হলো মা?’ মা কিছুক্ষণ থেমে থাকে। তারপর বলে, ‘তোর বাবা তোকে আকাশ সমান ভালবাসে। তাই তোর বাবা যদি পাগল হয় তবে তোর ভালবাসায় পাগল। আর বেশি ভালবাসলে ভয়ও বেশি থাকে। সাইকেলটা যেন তোকে নিরাপদে নিয়ে যায় আবার নিরাপদে ফিরে নিয়ে এসে। এজন্য প্রায় দিনই সাইকেলটাকে তোর বাবা নানান পরামর্শ দেয়। এসবই ভালবাসার পাগলামি বাবা।’ ‘আমিও বাবাকে অনেক ভালবাসি মা।’ ‘আমাকে?’ জিজ্ঞেস করে মা। ‘ তামাকেও ভালবাসি মা। মা...।’ কিছুক্ষণ থেমে থাকে রেশাদ। পরক্ষণে আবার বলে, ‘মা, সাইকেলটা কী সত্যি সত্যি বাবার সঙ্গে কথা বলে না?’ মা একটু মুচকি হেসে বলে, ‘বলতেও পারে। তুই যেমন আমার সঙ্গে ফিস্ ফিস্ করে কথা বলছিস। তেমনি সাইকেলটাও হয়ত তোর বাবার সঙ্গে ফিস্ ফিস্ করে কথা বলে।’ এ কথা বলেই মা রেশাদের ঘর থেকে বাইরে বেড়িয়ে যায়। মার কথা শুনে রেশাদ আবার অন্য কোন একদিন আড়ি পাথার পরিকল্পনা করে। যেমন করেই হোক সাইকেল এর ফিস্ ফিস্ করে কথা বলা ওকে শুনতেই হবে।
×