ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বইমেলার একাল সেকাল...

প্রকাশিত: ০৬:১৭, ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

বইমেলার একাল সেকাল...

বইমেলা। চারদিকে সাজানো শত সহস্র বই। মনে হবে বইয়ের উদ্যান। তার মধ্যে পাঠক আর মানুষের ভিড়ে বইগুলো পাপড়ি মেলেছে। বাঙালী যে কতটা বইপ্রেমী তা বোঝা যায় বইমেলায় ঢু দিলে। শিশু-কিশোর-তরুণ-বয়স্ক কেউ বাদ যায় না। বইমেলায় যাওয়া যেন হৃদয়ের অপার সুখানুভূতি। বাঙালীর ঐতিহ্যের চিরন্তন গ্রামীণ মেলার মতো নয় বইমেলা। তবে সংস্কৃতির বলয়ে তা থেকে পৃথকও নয়। বলা যায় সংস্কৃতির হৃদয়ের গভীরে থেকে উৎসারিত বইমেলা। গত শতকের শেষ ভাগে এই মেলা ছিল শুধু ঢাকাকে কেন্দ্র করে। ফেব্রুয়ারি মাস এলেই বইমেলার আনন্দ সূচনা বেজে ওঠে। সারা দেশের মানুষ ভর বছর অপেক্ষায় থাকে কবে পর্দা উঠবে বইমেলার। কবি-সাহিত্যিক-লেখক সত্তার সকলেই প্রস্তুতি নেয় কে কয়টি বই প্রকাশ করবে অমর একুশের মাসে। ঢাকার প্রকাশনা শিল্পের লোকজন দুয়ার খুলে বসে থাকে কখন কোন লেখক কবি-সাহিত্যিক তাদের ঘরে গিয়ে বই প্রকাশের পান্ডুলিপি নিয়ে উপস্থিত হয়। সকলের দাবি মেলার প্রথম দিনেই বই স্টলে পেঁঁৗঁছা চাই। এমন আনন্দের বইমেলার আজ আর শুধু ঢাকার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। ছড়িয়ে পড়েছে দেশজুড়ে। বইয়ের এই মেলা কিন্তু খুব বেশি দিনের নয়। এর প্রাথমিক শুরু ষাটের দশকের মধ্য ভাগে। প্রয়াত কথাসাহিত্যিক সরদার জয়েনউদ্দীনের হাত ধরে শিশুদের গ্রন্থমেলার আবির্ভাব ১৯৬৫ সালে। তৎকালীন কেন্দ্রীয় পাবলিক লাইব্রেরী (বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরির নিচ তলায়) অনেক গ্রন্থ দিয়ে সাজানো এই মেলা দেশের প্রথম বইমেলা। সরদার জয়েনউদ্দীন তখন জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের পরিচালক। শিশুদের গ্রন্থমেলার সফল আয়োজনের পর বড় পরিসরে বইমেলার আয়োজন খুঁজতে থাকেন। ১৯৭০ সালে তিনি সুযোগ পান। নারায়ণগঞ্জ ক্লাবের সহযোগিতায় নারায়ণগঞ্জে অনুষ্ঠিত হয় সকলের জন্য বড় বইমেলা। মেলায় স্টলে বইয়ের পসরার সঙ্গে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আলোচনা সভায় অংশ নেন শিল্পী-সাহিত্যিক-গুণীজনেরা। ইউনেস্কো ১৯৭২ সালকে আন্তর্জাতিক গ্রন্থবর্ষ হিসেবে ঘোষণা দেয়। ওই বছর ডিসেম্বর মাসে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে একটি আন্তর্জাতিক বইমেলার আয়োজন করা হয়। বাংলা একাডেমি চত্বরে এই বইমেলা ছিল ঢাকায় প্রথম কোন বই মেলা। যে মেলায় ইউনেস্কো, বাংলাদেশে কয়েকটি বিদেশী দূতাবাস, কয়েক দেশের লেখক-সাহিত্যিক ভারতীয় কয়েক প্রকাশক অংশ নেয়। ১৯৭২ সালেই একুশের মাসে একাডেমির প্রাচীরের ওপারে ঢাকার কয়েকটি প্রকাশনা সংস্থা বই সাজিয়ে রাখতেন। এর দু’বছর পর ১৯৭৪ সালে বাংলা একাডেমির উদ্যোগে জাতীয় সাহিত্য সম্মেলন হয়। ওই সময় একাডেমির ভেতরে এক ধারে দেয়াল ঘেঁষে কয়েক প্রকাশক বই নিয়ে বসেন। তারই মধ্যে বাংলা একাডেমির বইয়ের একটিা স্টল দেয়া হয়। দিনে দিনে বাংলা একাডেমির ভেতরে বইমেলা আয়োজনের দাবি উঠতে থাকে। ১৯৮৩ সালে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে অমর একুশে গ্রন্থমেলার আয়োজন যখন শেষ পর্যায়ে তখন শিক্ষা ভবনের সামনে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীর দু’জন ছাত্র নিহত হলে বই মেলা ভ-ুল হয়ে যায়। এর পরের বছর ১৯৮৪ সালে বাংলা একাডেমি চত্বরেই অমর একুশের গ্রন্থমেলা শুরু হয় আড়ম্বরপূর্ণভাবে। সেই থেকে আজ অবধি ভাষার মাসের প্রথম দিন থেকে শেষ দিন পর্যন্ত বইমেলা চলে। একুশের বইমলাকে আর পেছনে তাকাতে হয়নি। টানা এক মাস বইমেলা বিশ্বের আর কোন দেশে হয় না। বইমেলাকে ঘিরে বছরের মাঝামাঝি থেকে প্রকাশনা শিল্পের গতি বাড়তে থাকে। বলা যায় একুশে গ্রন্থমেলাকে কেন্দ্র করে অনেক প্রকাশনা শিল্প একটি ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে গিয়েছে। একই সঙ্গে দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা লেখকরা তাদের প্লাটফর্ম খুঁজে পেয়েছে। টানা এক মাসের বইমেলা পরিণত হয় কবি- সাহিত্যিক-শিল্পী ও পাঠকদের মিলনমেলা। যারা পাঠক নয় তারাও যায় বইয়ের এই বাগানে। নব্বইয়ের দশকের শুরু থেকে নদীর স্রোতের মতো আপন গতিতেই এগিয়ে চলেছে বইমেলা। দিনে দিনে বাড়ছে পাঠকের সংখ্যা। বর্তমানে বাংলা একাডেমি চত্বরে স্টল সঙ্কুলান হয় না। মেলা সম্প্রসারিত হয়েছে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান পর্যন্ত। ভাষার মাসে ঢাকার বইমেলার হাত ধরে দেশের বিভিন্ন স্থানে ফেব্রুয়ারি মাসে আয়োজন করা হয় বইমেলার। ঢাকার বাইরে বইমেলার আয়েজনও বেশি দিনের নয়। নব্বইয়ের দশকের প্রথম দিকে উত্তরাঞ্চলের বগুড়া, রাজশাহী ও পাবনা জেলায় বইমেলার আয়োজন করা হয়। এর মধ্যে পাবনা জেলার বইমেলা ঢাকার সঙ্গে অর্থাৎ ফেব্রুয়ারির প্রথম দিনে শুরু হয়ে চলে ফেব্রুয়ারির শেষ দিন পর্যন্ত। বগুড়ায় শহীদ খোকন পার্কের সামনে ফুলের দোকানের অপর প্রান্তে এবং নবাববাড়ি সড়কের দুই প্রান্তে বইমেলা বসে। চলে ফেব্রুয়ারি মাসের শেষের ৮ দিন। লিপ ইয়ার হলে ৯ দিন। ২০১৫ সাল থেকে বগুড়া সরকারী আযিযুল হক কলেজের নতুন ভবনে ফেব্রুয়ারির প্রথম দিন থেকে ২০ তারিখ পর্যন্ত বইমেলা হয়। বর্তমানে দেশের প্রতিটি জেলায় বইমেলার আয়োজন হয় ভাষার মাসে। বইমেলা বইপ্রেমীদের শুধু নয় সর্বস্তরের মানুষের মিলনমেলায় পরিণত হয়েছে। বই কেনা ছাড়াও সাংস্কৃতিক কর্মকা- নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচন সাহিত্যিকদের আড্ডা সব মিলিয়ে বই মেলা এনে দেয় বাঙালীর শিকড়ের সংস্কৃতির আরেক আবহ। Ñসমুদ্র হক, বগুড়া থেকে
×