ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

নারায়ণগঞ্জ এখন যানজটের নগরী!

প্রকাশিত: ০৬:১৬, ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

নারায়ণগঞ্জ এখন যানজটের নগরী!

মোঃ খলিলুর রহমান, নারায়ণগঞ্জ ॥ প্রাচ্যের ডান্ডি খ্যাত নারায়ণগঞ্জ এখন যানজটের নগরীতে পরিণত হয়েছে। যানজটে আটকে থেকে স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীসহ বিভিন্ন পেশার লোকজন মূল্যবান সময় অপচয় করতে বাধ্য হচ্ছে। বিশেষ করে কোন দিন নগরীর কোথাও যানজট দেখা না গেলেও নগরীর কেন্দ্রস্থল চাষাঢ়ার গোল চত্বরে যানজট লেগেই আছে। আবার নগরীর তিনটি রেলক্রসিং, বঙ্গবন্ধু সড়ক, টার্মিনাল সড়কসহ বিভিন্ন সড়কে প্রতিনিয়ত যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে। এতে ভোগান্তিতে পড়ছে সাধারণ মানুষ। যানজটের কারণে দিন দিন ক্ষুব্ধ হচ্ছেন নারায়ণগঞ্জের সাধারণ মানুষ। যানজটে অস্তির মানুষগুলো এই অভিশাপ থেকে মুক্তি চান। খবর নিয়ে জানা যায়, ঢাকা-পাগলা-নারায়ণগঞ্জ সড়ক, ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোড, নারায়ণগঞ্জ-আদমজী-ডেমরা সড়ক এবং নগরীর প্রধান সড়ক বঙ্গবন্ধু সড়কের চাষাঢ়া থেকে নিতাইগঞ্জ পর্যন্ত অংশের মোহনা হিসেবে পরিচিত চাষাঢ়া গোল চত্বর। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, এ গোল চত্বরে অহরহ যানজট লেগেই আছে। ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জ শহরে ঢুকতে কিংবা সিদ্ধিরগঞ্জ, ফতুল্লা, সোনারগাঁও, রূপগঞ্জ, আড়াইহাজার ও বন্দর থেকে শহরে ঢুকতেই চাষাঢ়া এসেই পড়তে হয় যানজটের কবলে। ফলে অনেকেই রিকশার পরিবর্তে হেঁটে নির্ধারিত গন্তেব্যে পৌঁছতে বাধ্য হন। এছাড়া ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, যানজটের কারণে রিকশার ভাড়াও দ্বিগুণ বেড়ে যায়। যানজটের প্রধান স্পটগুলো হলোÑ চাষাঢ়া গোল চত্বর, রাইফেল ক্লাব, ১নং রেলগেট, ২নং রেল গেট, কালিরবাজার, নিতাইগঞ্জ ও উকিলপাড়া। সবচেয়ে তীব্র যানজট লক্ষ করা যায় বঙ্গবন্ধু সড়কে। বিশেষ করে চাষাঢ়া গোল চত্বর থেকে ২নং রেল গেট ও ডিআইটি পর্যন্ত প্রতিনিয়ত সৃষ্টি হচ্ছে যানজট। ভুক্তভোগী ও বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, নানা কারণে নগরীতে ইদানীং সৃষ্টি হচ্ছে যানজট। যানজটের অন্যতম কারণ হিসেবে রয়েছে নগরীতে ৩টি রেল ক্রসিং। ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটে প্রতিদিন ১৩টি ট্রেন দুইবার করে আসা-যাওয়া করে। একদিনে ২৬ বার চলাচল করে। নগরীর কেন্দ্রীয় রেলস্টেশনটি হলো কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল সংলগ্ন। নগরীর কেন্দ্রীয় রেলস্টেশনে যেতে তিনটি রেল ক্রসিং অতিক্রম করতে হয়। এর মধ্যে চাষাঢ়া রেল ক্রসিং যেটা ঢাকা-পাগলা-নারায়ণগঞ্জ সড়কে অবস্থিত, দ্বিতীয়টি বঙ্গবন্ধু সড়কের ২নং রেল গেট ও তৃতীয়টি বাস টার্মিনাল সংলগ্ন ১নং রেল গেট। ২৬ বার ট্রেন চলাচল করার কারণে ৫ মিনিট করে ক্রসিং হিসেব করলে ১৩০ মিনিট (২ ঘণ্টা ১৬ মিনিট) যানবাহন চলাচল বন্ধ রাখতে হয়। আর এ ক্রসিংয়ের কারণে পুরো শহরে দেখা দেয় যানজট। অপরদিকে নগরীর অধিকাংশ ফুটপাথ দখল করে অবৈধ দোকানপাট বসিয়েছে হকাররা। ফলে পথচারীরা বাধ্য হয়ে রাস্তা দিয়ে হাঁটছে। এতেও সৃষ্টি হচ্ছে যানজট। অনেকেই বলছেন, নগরীতে অবৈধ রিকশারও ছড়াছড়ি রয়েছে। অতিরিক্ত রিকশা রাস্তার অধিকাংশ অংশজুড়ে চলাচল করায় সৃষ্টি হচ্ছে যানজট। আবারও প্রধান প্রধান সড়কের পাশের বিপণি বিতানের সামনে প্রাইভেটকার ও মাইক্রোবাসসহ নানা যানবাহন রাস্তায় পাশে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকে। এতেও সৃষ্টি হয় যানজট। পথচারীরাদের অভিযোগ, কোন কোন সড়কে ভ্যানগাড়িতে ফল, কাপড়, খাবার জিনিসপত্র নিয়ে রাস্তায় দোকান খুলে বসেছে। এতেও সৃষ্টি হচ্ছে যানজট। অন্যদিকে শহরের উকিলপাড়া এলাকাতে রয়েছে প্রচুর হোসিয়ারী কারখানা। এ কারণে ওই কারখানাগুলোর সামনে বঙ্গবন্ধু সড়কে মালামাল লোড-আনলোডের জন্য গাড়ি পার্কিং করে রাখার কারণেও যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে। সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, চাষাঢ়ার সড়কে অবৈধ ফলের দোকান, সিএনজি চালিত বেবীট্যাক্সি, টেম্পোর দখলে রয়েছে। অপরদিকে চাষাঢ়ায় ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডের প্রবেশমুখে পশ্চিম পাশে বিভিন্ন বাস সবসময়ই যাত্রী নেয়ার জন্য দাঁড়িয়ে থাকে। এর সঙ্গে টেম্পো, বেবীট্যাক্সি ও রিকশা তো রয়েছে। লিংক রোডের পূর্বপাশে রাইফেল ক্লাবের প্রবেশপথের একটু আগে পেট্রোল পাম্পের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে টেম্পো ও বেবীট্যাক্সি। তারা লিংক রোড থেকে সাইনবোর্ড পর্যন্ত যাত্রী বহন করে। এদের কারণে যানজট সৃষ্টি হলে প্রভাব পড়ে শহরের। এদিকে চাষাঢ়া খাজা সুপার মার্কেটের সামনেও অবৈধ স্ট্যান্ড গড়ে তোলা হয়েছে। চাষাঢ়ায় সরকারী মহিলা কলেজের ফটকের সামনে আনন্দ পরিবহনের বাস ও অটোরিকশার অবৈধ স্ট্যান্ড রয়েছে। চাষাঢ়া গোল চত্বরের আশপাশের পুরো ফুটপাথই হকারদের দখলে। এর ফলে পথচারীরা রাস্তা দিয়ে চলাচল করছে। রাস্তা দখল থাকায় সৃষ্টি হচ্ছে যানজট। নারায়ণগঞ্জ শহরের পাইপাড়ার বাসিন্দা আবু জাফর জানান, যানজটের কারণে রিকশায় দীর্ঘক্ষণ বসে থাকতে হয়। যানজট সৃষ্টি হলে অবশ্য রিকশার চেয়ে হেঁটেই আগে গন্তব্যে পৌঁছা যায়। তার অভিযোগ, নারায়ণগঞ্জ নগরীতে যানজট এখন অভিশাপে পরিণত হয়েছে। আমলাপাড়া বাসিন্দা ইয়াকুব হোসেন জানান, নগরীর যানজট এখন প্রধান সমস্যা। বলতে পারেন নারায়ণগঞ্জ এখন যানজটের নগরীতে পরিণত হয়েছে। অভিজ্ঞমহল মনে করছেন, নগরীর কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনালটি ও কেন্দ্রীয় রেলস্টেশনটি চাষাঢ়ার দিকে নিয়ে এলে শহরের যানজট অনেকাংশ কমে আসবে। তারা বলছেন, নগরীর কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল ও তিনটি রেল ক্রসিংয়ের কারণেই মূলত যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে। এছাড়া বাসগুলো শহরের প্রধান প্রধান সড়ক দিয়ে যাতায়াতের কারণেও যানজটের সৃষ্টি হয়। এ বিষয়ে নারায়ণগঞ্জ নাগরিক কমিটির সভাপতি এ বি সিদ্দিক বলেন, নারায়ণগঞ্জ নগরী থেকে যানজট দূর করতে হলে সিটি কর্পোরেশন, ডিসি, ট্রাফিক পুলিশ ও বিআরটিএ এ চারটি ডিপার্টমেন্ট একসঙ্গে বসে সমন্বিত কর্মসূচীর গ্রহণ করতে হবে। আমরা ৭-৮ বছর ধরে নগরীর যানজট দূর করার দাবি জানিয়ে আসছি। এ বিষয়ে বহু পদক্ষেপ নেয়ার আবেদন জানিয়েছি। কোন কাজ হয়নি। বিআরটিএ’র একটি কমিটি আছে যার প্রধান কাজ হলো যানজট দূর করা। সংস্থাগুলো যানজট নিরসনে ৭-৮ বছর ধরে কোন মিটিংও করছে না। বিআরটিএ যাকে-তাকে ফিটনেস সার্টিফিকেট দিয়ে দেয়। সিটি কর্পোরেশনের হাজার হাজার অবৈধ রিকশা রয়েছে। সিটি কর্পোরেশনের নির্দিষ্ট কোন স্ট্যান্ড নেই, যেখানে সেখানে যানবাহন থামানো, বাসস্ট্যান্ডটি (কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনালটি) সেন্ট্রালে হওয়াতে উল্টাপাল্টা বাস আসা-যাওয়া করে। ফিটনেসবিহীন গাড়ি অহরহ চলাচল করছে। সিটি কর্পোরেশন একা কিছু করতে পারে না। এ বিষয়ে ট্রাফিক পুলিশের কোন মাথা ব্যথা নেই। ট্রাফিক পুলিশও যানজট নিরসনে ঠিকমতো কাজ করে না। নারায়ণগঞ্জ জেলার সহকারী পুলিশ সুপার (ট্রাফিক) আব্দুর রশিদ নগরীতে যানজট সৃষ্টি হওয়া প্রসঙ্গে বলেন, নারায়ণগঞ্জ নগরীতে তিনটি রেল ক্রসিং আছে। এ রেল ক্রসিংয়ের কারণে প্রতিবার কম করে হলেও ৫ মিনিট করে বন্ধ রাখতে হয়। এতে কয়েক ঘণ্টা রাস্তা বন্ধ থাকায় সৃষ্টি হয় যানজট। নগরীতে যে সময়ে কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল তৈরি হয়েছে সে সময়ের চেয়ে বর্তমানে তিন গুণ যানবাহন বেড়ে গেছে। যানবাহন ধারণ করার স্থানও লাগবে। এছাড়াও বিভিন্ন রাস্তায় রাস্তায় যানবাহন দাঁড় করিয়ে রাখায় যানজট সৃষ্টি হচ্ছে। সিটি কর্পোরেশনে অবৈধ রিকশা রয়েছে। অবৈধ রিকশা চলাচল করার কারণেও নগরীতে যানজটের প্রভাব পড়ে। আমাদের ট্রাফিক পুলিশেরও স্বল্পতা রয়েছে। ফুটপাথ দখল করে অবৈধ দোকানপাট তৈরি করা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, নগরীর যানজট কমাতে হলে নগরীর মধ্য থেকে রেলস্টেশনটি অন্য জায়গায় (শহরের বাইরে) সরিয়ে নিলে যানজট অর্ধেক কমে আসবে। বাস টার্মিনালটি এখন আর আগের জায়গায় থাকা উচিত নয়। বিভিন্ন শহরে বাস টার্মিনাল শহরের বাইরে নিয়ে আসা হয়েছে। যানজটের বিষয়ে আমরা অসহায়। আমরা ইচ্ছে করলেই শুধু সিগন্যাল দিয়ে রাস্তা পরিষ্কার করতে পারব না।
×