ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

মোটা অঙ্কের টাকায় তাদের বাংলাদেশী পাসপোর্ট যোগাড় করে দেয়া হচ্ছে

ওমরাহর নামে রোহিঙ্গা পাচার, একাধিক দালাল চক্র জড়িত

প্রকাশিত: ০৫:৫৪, ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

ওমরাহর নামে রোহিঙ্গা পাচার, একাধিক দালাল চক্র জড়িত

আজাদ সুলায়মান ॥ আবারও শুরু হয়েছে বাংলাদেশী পাসপোর্ট নিয়ে ওমরাহ ভিসায় রোহিঙ্গাদের সৌদি আরব পাচার। এই অভিযোগে এক বছর ওমরাহ ভিসা বন্ধ থাকার পরও সতর্ক হয়নি হজ এজেন্সি ও প্রশাসন। ঢাকা ও চট্টগ্রামের একাধিক শক্তিশালী সিন্ডিকেট প্রতি সপ্তাহেই রোহিঙ্গাদের ওমরাহ ভিসায় সৌদি আরব পাঠাচ্ছে বলে নিশ্চিত হয়েছে ইমিগ্রেশন পুলিশ। সম্প্রতি হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ওমরাহ ভিসায় সৌদি আরব যাওয়ার সময় দুজনকে আটক করা হয়। তাদের আটকের পর পুলিশ জানতে পারে, ঢাকা ও চট্টগামের একটি সিন্ডিকেট তিন লাখ টাকা করে দুজনের কাছ থেকে ৬ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়। এ সম্পর্কে হজ এ্যাসোসিয়েশন্স অব বাংলাদেশের (হাব) সভাপতি ইব্রাহিম বাহার জানিয়েছেন, এখনো আগের মতো ঢালাওভাবে ওমরাহর নামে রোহিঙ্গা পাচারের অভিযোগ পাওয়া যায়নি। এ বিষয়ে এখন সবাই সতর্ক। সৌদি আরব ও বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ নজরদারি রয়েছে কেউ যাতে ওমরাহর নামে কোন রোহিঙ্গা পাচার না করতে পারে। তারপর যখন কিছু অভিযোগ উঠছে-সেটা আমলে নিয়ে এ চক্রের লাগাম টেনে ধরতে হবে। নইলে খেসারত দিতে হবে। এ বিষয়ে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত বছরের শেষদিকে ওমরাহ ভিসায় ঢাকা ও চট্টগ্রামে রোহিঙ্গা পাচারের সময় বেশ কজনকে আটক করা হয়। তাদের জিজ্ঞাসাবাদের সময় তারা জানিয়েছে, মানবপাচারের জন্য ঢাকা ও চট্টগ্রামে গড়ে উঠেছে একাধিক দালাল চক্র। এদের সঙ্গে রয়েছে ডজন খানেক অসাধু ওমরাহ এজেন্সি। এজেন্সিগুলো মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে রোহিঙ্গাসহ অন্যান্য আদম পাচারের কাজে জড়িত। সাধারণত, ওমরাহ করার জন্য Ÿৈধভাবে পাঠাতে হলে সাধারণ ক্যাটাগরিতে কিছুতেই এক লাখ টাকার বেশি লাগে না। কিন্তু রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশী পাসপোর্ট দিয়ে পাচার করার প্যাকেজে খরচ পড়ে তিন থেকে চার লাখ টাকা। এ ক্ষেত্রে বিমানবন্দরে সংশ্লিষ্ট ইমিগ্রেশন কর্মকর্তা ছাড়াও অন্তত ৬টি পয়েন্টে টাকা খরচের কথা বলে প্যাকেজের হিসাব ধরা হয়। ইমিগ্রেশন পুলিশের একজন কর্মকর্তা জনকণ্ঠকে জানান, গত মাসে চট্টগ্রাম শাহ আমানত বিমানবন্দরে ওমরাহর নামে এভাবে রোহিঙ্গাদের সৌদি আরব পাড়ি দেয়ার সময় নারীসহ ১৪ জনকে আটক করার পর ৪টি ওমরাহ এজেন্সির লাইসেন্স বাতিল করে। তখনই নতুন করে বিষয়টি সামনে আসে। এ ঘটনার তদন্ত করতে গিয়ে পুলিশ নিশ্চিত হয়Ñঢাকা শাহজাহাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়েও অনুরূপ রোহিঙ্গাদের পাচারের ঘটনা ঘটছে। হাবের কাছেও এ ধরনের অভিযোগ আসে। এনিয়ে হাব নেতারা উদ্বিগ্ন। হাবের মহাসচিব শেখ আব্দুল্লাহ চট্টগ্রামের মতো ঢাকা শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়েও ওমরাহর নামে রোহিঙ্গাদের সৌদি আরবে পাঠানো হচ্ছে বলে অভিযোগ করে বলেন, ‘আমরা জানতে পেরেছি, ইমিগ্রেশন পুলিশকে ৪০-৫০ হাজার টাকা করে দিয়ে বাংলাদেশী পাসপোর্টে ওমরাহ ভিসায় রোহিঙ্গাদের সৌদি আরব পাঠানো হচ্ছে। এর আগেও ওমরাহর নামে মানবপাচারের কারণে সৌদি আরব বাংলাদেশকে ওমরাহর ভিসা বন্ধ করে দিয়েছিল। এতে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হয়েছিল। কিন্তু অসাধু একটি চক্র নতুন করে আবারও ওমরাহ ভিসায় মানবপাচার শুরু করেছে। এতে আবারও বাংলাদেশ অভিযুক্ত হতে পারে। এ বিষয়ে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে কর্মরত একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান জনকণ্ঠকে বলেন, গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে চট্টগ্রাম শাহ আমানত বিমানবন্দর দিয়ে ওমরাহর নামে সৌদি আরবে রোহিঙ্গা পাচারে পুলিশের ইমিগ্রেশন শাখার সম্পৃক্ততার কথা উঠে আসে। প্রাথমিক তদন্তে প্রমাণ মেলায় তখন এক কর্মকর্তাসহ কয়েকজন পুলিশ সদস্যকে বদলি করা হয়। পুলিশ জানায়, মানবপাচারের অভিযোগ ওঠার পর গত নবেম্বর মাসে চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশনের দায়িত্ব নেয় ঢাকা পুলিশের বিশেষ শাখা (এসবি)। এরপর থেকে রোহিঙ্গাসহ মানবপাচারে বিমানবন্দর ইমিগ্রেশনের কঠোর পদক্ষেপ সত্ত্বেও থেমে নেই রোহিঙ্গা পাচার। গত মাসে সৌদি যাওয়ার প্রাক্কালে শাহ আমানত বিমানবন্দরে রোহিঙ্গা সন্দেহে ১৪ নারী-পুরুষকে আটকের ঘটনা ঘটে। ইমিগ্রেশনের দায়িত্বে থাকা ঢাকা পুলিশের বিশেষ শাখার সুপার মোঃ শাহরিয়ার আলম ১৪ রোহিঙ্গা আটকের পর সাংবাদিকদের জানান, চিটাগাংয়ের আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলার কারণে এরা রোহিঙ্গা কিনা, সেটা নিশ্চিত হওয়া বেশ কঠিন। হজ বা ওমরাহ করতে গেলে পুরুষ নিকটাত্মীয় সঙ্গে থাকতে হয় নারীদের। কিন্তু জেরা করে আটক নারী-পুরুষের মধ্যে সম্পর্কের গরমিল পাওয়ায় তাদের রোহিঙ্গা বলে সন্দেহ হয় এবং তাদের আটক করা হয়। বড় দল হওয়ায় সন্দেহের বশে তাদের আটক করা গেছে। এ ঘটনায় সর্বশেষ ধর্ম মন্ত্রণালয় চারটি এজেন্সির লাইসেন্স বাতিল করে। এজেন্সিগুলো হলোÑ ঢাকার মতিঝিলের সৌদিয়া বাংলা এয়ার সার্ভিসেস লিমিটেড (লাইসেন্স নং-৩৬০), নয়াপল্টনের টপ ওয়ান এভিয়েশন লাইসেন্স নং-৪০৭), সামিট এয়ার ইন্টারন্যাশনাল (লাইসেন্স নং-৩৩৮) ও প্যারামাউন্ট ট্রাভেলস এ্যান্ড ট্যুরস লিমিটেড (লাইসেন্স নং-৩৬৪)। এ সম্পর্কে হাবের সভাপতি ইব্রাহিম বাহার বলেন, এ জন্য কম খেসারত দেইনি। ২০১৫ সালে ওমরাহর নামে মানবপাচারের দায়ে ৫৯টির লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছিল। মোট ১০৪টি এজেন্সিকে শাস্তি দেয়া হয়েছিল। অবশ্য পরে সৌদি সরকার আবার ওমরাহ ভিসা চালু করলে এবং এজেন্সিগুলো রিভিউ আবেদন করলে অধিকাংশ এজেন্সির শাস্তি কমিয়ে তাদের আবারও ওমরাহ কার্যক্রম পরিচালনার সুযোগ দেয়া হয়। এখন ওমরাহ ভিসায় সৌদি পাঠানোর সব প্রক্রিয়ায় ঢাকা ও সৌদির প্রশাসন খুব কঠোরভাবে নজরদারি করছে। তারপরও ফাঁকে ফাঁকে যে কয়েকটা এজেন্সি এমন অপকর্ম করেছে বলে প্রমাণ মিলেছে তাদের লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছে। এতে অন্যরা হয়তো সতর্ক হবে। এ সম্পর্কে একটি গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তা জানান, গত ৭ বছরে শাহজালাল ও শাহ আমানত এ দুটি বিমানবন্দর থেকে বিদেশ পাড়ি দেয়ার সময় সহস্রাধিক রোহিঙ্গাকে আটক করা হয়েছে। রোহিঙ্গারা শুধু যে, বাংলাদেশি পাসপোর্ট ব্যবহার করে বিদেশে পাড়ি দিচ্ছে তা নয়। তারা সেখানে গিয়ে জড়িয়ে পড়ছে চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই ও মাদক ব্যবসাসহ নানা অপরাধে। বেসরকারী হিসেবে প্রায় সাড়ে ৩ লাখ রোহিঙ্গা ছড়িয়ে আছে বাংলাদেশে। সম্প্রতি মিয়ানমারে হামলা চালিয়ে ৯ সীমান্ত রক্ষীকে হত্যার পর সে দেশের নিরাপত্তা বাহিনী ফের রাখাইন রাজ্যে অভিযান শুরু করলে দলে দলে রোহিঙ্গারা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে ঢোকে। এরপর একটি গোয়েন্দা সংস্থার তদন্তে উঠে আসে রোহিঙ্গাদের হাতে বাংলাদেশী পাসপোর্ট চলে যাওয়ার চাঞ্চল্যকর তথ্য। পরে গোয়েন্দারা নিশ্চিত হয়Ñওমরাহ ভিসায় সৌদি আরবে রোহিঙ্গা পাচার করার জন্যই তাদের নামে চড়া মূল্যে বাংলাদেশী পাসপোর্ট সরবরাহ করা হয়।
×