ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বোতলজাত ৫ লিটারের সয়াবিনের মূল্য অস্বাভাবিক বৃদ্ধি

প্রকাশিত: ০৫:৪৬, ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

বোতলজাত ৫ লিটারের সয়াবিনের মূল্য অস্বাভাবিক বৃদ্ধি

এম শাহজাহান ॥ প্রতি পাঁচ লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেলে ভোক্তাদের কাছ থেকে ৬২ টাকা বেশি মুনাফা করা হচ্ছে। মুনাফার সিংহভাগ যাচ্ছে বিপণনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর পকেটে। নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে রাজধানীর বাজারে বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম বাড়ানো হচ্ছে। ব্র্যান্ড ভেদে প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিনের দাম বেড়েছে ৫-১০ টাকা পর্যন্ত। পাঁচ লিটারের বোতলে ২০-৩০ টাকা পর্যন্ত দাম বাড়ানো হয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারের দোহাই দিয়ে এবং উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ার কারণ দেখিয়ে সম্প্রতি বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং ট্যারিফ কমিশনে ভোজ্যতেল বিপণনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো নতুন দর প্রস্তাব করে। বাজার যাচাই-বাছাই করে তাদের এই প্রস্তাব নাকচ করে দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। কিন্তু তারপরও বোতলজাত ভোজ্যতেলের দাম বাড়ানো হচ্ছে। এদিকে, বাজারে খোলা সয়াবিনের তেলের দাম এখন কমতির দিকে। এ কারণে বোতলজাত তেলের দাম বাড়ানোকে সম্পূর্ণ অযৌক্তিক বলছেন পাইকারি ব্যবসায়ীরা। তাদের মতে, প্রতি পাঁচ লিটার বোতলে খুচরা পর্যায়ে ভোক্তাদের কাছ থেকে ৬২ টাকা বেশি নেয়া হচ্ছে। কারণ হিসেবে তারা বলছেন, বর্তমানে প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন তেলের পাইকারি মূল্য হচ্ছে ৭৬ দশমিক ২৫ টাকা। এর সঙ্গে ২০ শতাংশ অতিরিক্ত খরচ যোগ করলে পাঁচ লিটারের বোতলজাত তেলের মূল দাঁড়ায় ৪৫৭ দশমিক ৫০ টাকা। কারণ, খোলা সয়াবিনের চেয়ে বোতলজাত তেল উৎপাদন ও বিপণনে সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তি খরচ করে মুনাফা করা সম্ভব। পাইকারি ব্যবসায়ীদের ওই হিসেবে বোতলজাত সয়াবিন তেলে ৬২ টাকা পর্যন্ত বেশি নেয়া হচ্ছে। রাজধানীর ভোজ্যতেলের সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার হিসেবে খ্যাত মৌলভীবাজারে বর্তমানে প্রতি মণ খোলা সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছে ৩ হাজার ৫০ টাকা। অর্থাৎ প্রতি লিটার সয়াবিন তেল ৭৬ দশমিক ৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। কিন্তু গত এক মাস আগে সমপরিমাণ এই তেল ৮১ টাকায় পাইকারি বাজারে বিক্রি হয়েছে। অর্থাৎ খোলা সয়াবিন তেলের দাম কমেছে। ভোজ্যতেল ব্যবসায়ীরা বলছেন, খোলা সয়াবিনের তেলের দাম কমলে বোতলজাত তেলের দামও কমতে হবে, বেশি হওয়ার কোন কারণ নেই। খোলা সয়াবিন তেলের চেয়ে বোতলজাত সয়াবিন সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ বেশি দামে বিক্রি হতে পারে। তাই এই তেলে দাম কেন বেশি নেয়া হচ্ছে সেদিকটায় সরকারের নজর দেয়া প্রয়োজন। জানা গেছে, গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে ভোজ্যতেলের দাম বাড়ানোর পাঁয়তারা করে আসছিল বিপণনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। শেষ পর্যন্ত ২৯ সেপ্টেম্বর ভোজ্যতেলের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দেয়া হয়। ওই সময় বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশনে বাজার মূল্যের চেয়ে প্রতি লিটার সয়াবিন তেলের দাম ৮ টাকা বাড়ানোর প্রস্তাব দেয়া হয়। বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স এ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স এ্যাসোসিয়েশন ও বাংলাদেশ সুগার রিফাইনার্স এ্যাসোসিয়েশন পৃথক আবেদনে দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দেয়। তাদের সেই প্রস্তাব মেনে নেয়া হলেও বোতলজাত সয়াবিন তেলের খুচরা দাম হয় প্রতি লিটার ১০৩ টাকা। কিন্তু দুটি সংগঠনের আবেদন বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও ট্যারিফ কমিশন নাকচ করে দিলেও বাজারে বোতলজাত ভোজ্যতেলের দাম বেড়ে যাচ্ছে। ব্র্যান্ডভেদে প্রতি লিটার ভোজ্যতেল বিক্রি হচ্ছে ১০৫-১০৭ টাকা পর্যন্ত। বাজারভেদে এই মূল্যের চেয়ে বেশি দামেও তেল বিক্রি হওয়ার অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। এ প্রসঙ্গে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব হেদায়েতুল্লাহ আল মামুন জনকণ্ঠকে বলেন, কয়েকটি বিপণনকারী প্রতিষ্ঠান ভোজ্যতেল ও লবণের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছিল। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজার পর্যালোচনা এবং ভোক্তা স্বার্থ বিবেচনায় নিয়ে দর বৃদ্ধির প্রস্তাব নাকচ করে দেয়া হয়েছে। এ কারণে ভোজ্যতেলের দাম বাড়ার কোন যৌক্তিক কারণ নেই। তিনি বলেন, সরকারের কাছে ভোক্তা স্বার্থই প্রথম। তাই কোন কোন প্রতিষ্ঠান ভোজ্যতেলের দাম বাড়াচ্ছে তা খতিয়ে দেখছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এ বিষয়ে বাজার মনিটরিং টিম সক্রিয় রয়েছে বলেও জানান তিনি। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বোতলজাত সয়াবিন তেলের বাজারের ৯০ শতাংশের দখল সিটি গ্রুপ, বাংলাদেশ এডিবল অয়েল ও মেঘনা গ্রুপের হাতে। এছাড়া আরও কয়েকটি কোম্পানির তেল বাজারে আছে। সাধারণত, প্রধান তিন কোম্পানির একটি দাম বাড়ালে অন্যরাও বাড়িয়ে থাকে। বাজারে রূপচাঁদা, তীর, মুসকান, মিজানসহ সব ধরনের বোতলজাত তেলের দাম বেড়ে গেছে। সরকার নিয়ন্ত্রিত সংস্থা ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্যমতে, বর্তমানে প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন দাম বেড়ে ৮৮-৯০, প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেল ১০৫-১০৭, পাঁচ লিটারের বোতল ৪৯০-৫২০, পামওয়েল খোলা ৭৩-৭৫ এবং পামওয়েল সুপার ৭৫-৭৭ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। সংস্থাটির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, গত এক বছরে পাঁচ লিটারের বোতলে দাম বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ১৫ শতাংশ এবং প্রতি লিটারে দর বৃদ্ধির এই হার ১২ শতাংশ পর্যন্ত। তবে মৌলভীবাজারের পাইকারি ব্যবসায়ীদের তথ্যমতে, নানা অজুহাতে মিলগেটে ভোজ্যতেলের দাম বাড়ানো হচ্ছে। আর এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি দাম বৃদ্ধি পায় বোতলজাত সয়াবিনে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ পাইকারি ভোজ্যতেল ব্যবসায়ী সমিতির সাবেক সহসভাপতি মোহাম্মদ আলী ভুট্রো জনকণ্ঠকে বলেন, এই মুহূর্তে বোতলজাত ভোজ্যতেলের দাম বাড়ার কোন কারণ নেই। পাইকারি বাজারে খোলা সয়াবিন তেলের দাম কমে যাচ্ছে। খোলা সয়াবিন বোতলে ঢুকিয়ে বড় বড় ব্র্যান্ডের ব্যানারে বেশি দামে বিক্রি করছে বিপণনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। পৃথিবীর কোন দেশে দাম বাড়ানোর এমন নজির নেই। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সারাদেশে প্রতিদিন ২০-২৫ হাজার মেট্রিক টন বোতলজাত তেলে চাহিদা রয়েছে। একটু ভালমানের আশায় দিন দিন ভোক্তাদের কাছে বোতলজাত তেলের চাহিদা বেড়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে নাগরিক জীবনে বোতলজাত ভোজ্যতেলই প্রধান ভরসা সাধারণ ভোক্তাদের কাছে। এ কারণে চাহিদা বাড়ার সুযোগ নিচ্ছে বিপণনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। ট্যারিফ কমিশনে দর বৃদ্ধির প্রস্তাব দিয়েই দাম বাড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। খুচরা ব্যবসায়ীরা বলছেন, কোম্পানি দাম বাড়িয়ে দিয়েছে, আর এ কারণে খুচরা বাজারেও বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে ভোজ্যতেল। কাপ্তান বাজারের জামশেদ স্টোরের ম্যানেজার মো. খায়রুল হোসেন জনকণ্ঠকে বলেন, দাম বাড়ার পেছনে খুচরা বিক্রেতাদের কোন হাত নেই। যেসব কোম্পানি বোতলজাত ভোজ্যতেল সরবরাহ করছেন তারাই দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। লিটারপ্রতি ৫-১০ টাকা পর্যন্ত দাম বাড়ানো হয়েছে। এ কারণেই খুচরা বাজারে দাম বাড়ার প্রভাব পড়ছে। অপকৌশল হিসেবে দর বৃদ্ধির প্রস্তাব ॥ ভোজ্যতেলের দাম বাড়ানোর অপকৌশল হিসেবেই বিপণনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো ট্যারিফ কমিশনে দর বৃদ্ধির প্রস্তাব দিয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। প্রথম পর্যায়ে দর বৃদ্ধির প্রস্তাবটি বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ভালভাবে না নিলেও বিপণনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো হাল ছাড়েনি। এ কারণে তাদের এই প্রস্তাবটি পুনর্মূল্যায়ন করছে ট্যারিফ কমিশন। শীঘ্রই এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন প্রস্তুত করবে ট্যারিফ কমিশন। এ প্রসঙ্গে ট্যারিফ কমিশনের এ্যাসিসট্যান্ট চীফ মোঃ মাহমুদুল হাসান জনকণ্ঠকে বলেন, ভোজ্যতেলের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব আগেই দেয়া হয়েছে। তাদের প্রস্তাবটি পুনর্মূল্যায়ন করবে ট্যারিফ কমিশন। এরপরই বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন দেয়া হবে।
×