ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ওরা চায় না দাম কমানো হোক

জ্বালানির মূল্য নির্ধারণে সরকারের ওপর প্রভাব ফেলেছে বিপিসি

প্রকাশিত: ০৫:৪৩, ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

জ্বালানির মূল্য নির্ধারণে সরকারের ওপর প্রভাব ফেলেছে বিপিসি

রশিদ মামুন ॥ জ্বালানি তেলের দাম নির্ধারণে সরকারের উপর প্রভাব ফেলেছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি)। জানুয়ারি থেকে জ্বালনি তেলের দাম কমানো হবে এমন ঘোষণা দিয়েছিলেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। এরপর পরই জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী জানিয়ে দেন জ্বালানি তেলের দাম কমাচ্ছে না সরকার। পাশাপাশি সময়ে জ্বালানি তেলের মূল্য সমন্বয় নিয়ে দুই মন্ত্রীর দুই ধরনের বক্তব্যর বিষয়ে অনুসন্ধানের সময় দেখা গেছে বিপিসি চায় না জ্বালানি তেলের দাম কমানো হোক। গত ডিসেম্বরে জ্বালানি তেলের মূল্য সমন্বয় করার চূড়ান্ত উদ্যোগ নেয় সরকার। জানুয়ারি থেকেই দেশে জ্বালানি তেলের দাম কমানো হবে এমনটা প্রত্যাশা করছিল। কিন্তু এতে বাদ সাধে বিপিসির একটি প্রতিবেদন। তিন পৃষ্ঠার এই প্রতিবেদনে বিপিসি সরকারকে জানায়, জ্বালানি তেলের আন্তর্জাতিক বাজার সব সময় স্থিতিশীল থাকে না। ফলে এখন এ ধরনের উদ্যোগ নিলে বিপিসির মুনাফা কমে যাবে। এতে বলা হয় বিপিসিকে আগের মতোই ঋণগ্রস্ত হতে হবে, সরকারের ভর্তুকি দিতে হবে এবং উন্নয়ন কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হবে। বিপিসির ওই প্রতিবেদনের পর পরই সরকার তেলের দাম কমানোর সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে। আন্তর্জাতিক বাজারে এখন অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দর প্রতিব্যারেল ৫২ দশমিক ৩৪ ডলার। বিপিসি তেলের বাজারের যে উর্ধমুখী প্রবণতার কথা বলছে তা গত এক বছরের কোন সময় পরিলক্ষিত হয়নি। অপরিশোধিত তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি ৫০ ডলারের আশপাশেই রয়েছে। গত অক্টোবরেই তেলের দাম কমানোর বিষয়ে জ্বালানি বিভাগ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে প্রস্তাব পাঠায়। ওই প্রস্তাবে পেট্রোল ও অকটেনের দর লিটারপ্রতি ১০ টাকা এবং ডিজেলের দাম লিটারপ্রতি দুই টাকা কমানোর প্রস্তাব করা হয়। কিন্তু এর পরেই তেলের দাম না কমানোর বিষয়ে জ্বালানি বিভাগে একটি প্রতিবেদন দেয় বিপিসি। বিপিসির ওই প্রতিবেদনে জ্বালনি তেলের দাম কমানো হলে অর্থনীতির উপর আটটি প্রভাবের কথা বলা হয়েছে। প্রতিবেদনের শুরুতেই বলা হয়, জ্বালানি তেলের দাম কমালে বিপিসি আর্থিকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হবে, ফলে সরকারকে ভর্তুকি দিতে হবে; সরকারের মুনাফা কম হবে; রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যংকের দায় সৃষ্টি হতে পারে। এতে বলা হয় তেলের দাম কমলেও পরিবহন ভাড়া, বিদ্যুত এবং শিল্পে উৎপাদন ব্যয় কমলেও এর সুফল জনগণ পায় না। ফলে সরকারের উদ্দেশ্য ব্যাহত হয়। এছাড়াও প্রতিবেদনে সরকারকে হুঁশিয়ার করা হয়, তেলের দাম কমে গেলে যে সব প্রকল্প বিপিসি নিজস্ব অর্থায়নে করছে তা বাধাগ্রস্ত হবে। একই প্রতিবেদনে বিপিসি বলছে তেলের দাম না কমালে ঠিক এর বিপরীত আটটি প্রভাব পড়বে। সেখানে বলা হয়, নতুন করে বিপিসির কোন দায় দেনা সৃষ্টি হবে না। সরকারকে ভর্তুকি তো দিতেই হবে না উল্টো সরকারের ঋণের পরিমাণ কমবে। বিপিসির নিজস্ব অর্থায়নে বাস্তবায়ন করা প্রকল্পগুলো ঠিকঠাক চলবে; সরকার বিপিসির লভ্যাংশ থেকে লাভ পাবে যা দিয়ে জনগণের উন্নয়ন করা যাবে; পরিবহন খাতসহ দেশে কোন অস্থিতিশীলতা তৈরি হবে না এবং জ্বালানি নিরাপত্তাও নিশ্চিত হবে। জ্বালানি তেলের মূল্য সমন্বয়ে দেশে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া মানা হয় না। বিপিসির বিরুদ্ধে ব্যাপক অনিয়ম এবং দুর্নীতির অভিযোগ থাকলেও কখনই এসব নিয়ে কোন ব্যবস্থা নেয়া হয় না। বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি আইন ২০০৩ অনুযায়ী বিদ্যুত জ্বালানির দাম নির্ধারণের একক দায়িত্ব কমিশনের। বিদ্যুত খাতকে সরকার তদারকির ব্যবস্থা করলেও জ্বালানি তেলকে বাইরেই রয়ে গেছে। বিদ্যুত খাতকে তদারকির আওতায় আনায় দেখা গেছে এখানে চুরি, দুর্নীতি অনেকাংশে কমেছে। সিস্টম লসের মাত্রাও বেঁধে দিচ্ছে কমিশন। বিদ্যুত খাতকে অযাচিত মুনাফা করতেও দেয়া হচ্ছে না। দেশে গ্যাসের দাম বৃদ্ধির বিষয়টিও কমিশন তদারকি করলেও জ্বালানি তেলে কর্তৃত্ব ছাড়তে চাইছে না জ্বালানি বিভাগ। ফলে একই মন্ত্রণালয়ের দ্বিমুখী আচারণ হিসেবে দেখছে সংশ্লিষ্টরা। বিপিসির প্রতিবেদনে মাত্র দুই বছরে জ্বালানি তেলের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে স্থিতিশীল থাকায় বিপুল পরিমাণ মুনাফার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে ২০১৪-১৫ অর্থবছর থেকে বিপিসি লাভের মুখ দেখেছে। মাত্র দুই বছরের লাভের টাকা থেকে ৬ হাজার ৬২৩ কোটি টাকা ঋণ পরিশোধ করেছে বিপিসি। এর মধ্যে রাষ্ট্রীয় সোনালী, জনতা, অগ্রণী এবং রূপালীর দেনা বাবদ তিন হাজার ৮৫ কোটি টাকা, পেট্রোবাংলার পাওনা এক হাজার ৭০০ কোটি টাকা, ভ্যাটের ৬০৩ কোটি টাকা, ইস্টার্ন রিফাইনারীর (ইআরএল ইউনিট-২) জমি কেনা বাবদ ২৩৫ কোটি টাকা এবং লভ্যাংশ হিসেবে সরকারকে এক হাজার কোটি টাকা পরিশোধ করেছে। বিপিসি নিজেদের আয়ের অর্থে ইআরএল ইউনিট-২, ঢাকা-চট্টগ্রাম তেল পাইপ লাইন, সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং টার্মিনাল নির্মাণ, ভারতের নুমালিগড় রিফাইনারী থেকে পার্বতীপুর পর্যন্ত তেল পাইপ লাইন, পায়রা বন্দর এলাকায় একটি নতুন তেল পরিশোধনাগার নির্মাণের জন্য বিপিসির অর্থ সংস্থান করতে হচ্ছে। এজন্য বিপিসি বলছে পায়রাবন্দরে নতুন রিফাইনারী করার জন্য তাদের ৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকার সংস্থান রাখতে হচ্ছে। এছাড়া দেশের জ্বালানি নিরাপত্তার জন্য ৬০ দিনের জ্বালানি তেলের মজুদ রাখতে তাদের পাঁচ হাজার কোটি টাকার একটি কার্যকরী মূলধন গঠন করার জন্যও তারা লাভের অর্থ থেকেই সংস্থান করছে।
×