ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

নাজনীন বেগম

তৃতীয় পা-ব ॥ কবিতা ও কবিতা বিষয়ক পত্রিকা

প্রকাশিত: ০৬:০৮, ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

তৃতীয় পা-ব ॥ কবিতা ও কবিতা বিষয়ক পত্রিকা

রাজশাহী থেকে প্রকাশিত ‘কবিতা ও কবিতা বিষয়ক’ ছোট পত্রিকা ‘তৃতীয় পা-ব’-এর প্রকাশ ২০১৭ সালের জানুয়ারি। মাসুদা খানমের সম্পাদনা এবং নওরোজ আলমের প্রচ্ছদ আঁকা ক্ষুদ্র এই সাময়িকী মূলত গোছানো হয়েছে কবিতার কথামালা দিয়ে। সম্পাদকের লেখায় উঠে আসে জীবনের ঘাত-প্রতিঘাত ও টানাপোড়েনের ধাক্কা সামলানোর দুঃসহ অভিযাত্রায় ‘তৃতীয় পা-বে’র সূচনাপর্ব। প্রায় ১২ বছর আগে প্রকাশ হওয়া ‘পা-বের’ পথ ধরেই নতুন আঙ্গিকে তৃতীয় পা-বের রূপরেখা, আঙ্গিক এবং বিষয়বস্তু। বিভাগীয় শহর রাজশাহীর কোলাহলপূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের ধারে কাছেই আলোচিত পত্রিকাটির বিজ্ঞজনেরা স্ব স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। পত্রিকাটির শুরুতেই আছে দ্রোণাচার্যের একটি সারগর্ভ প্রবন্ধ ‘আমাদের কবিতা : ভবিষ্যত ভাবনা’। পত্রিকাটি যেহেতু বিভিন্ন জনের কাব্যিক অনুভব সঙ্গত কারণেই প্রবন্ধটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। বাংলা কবিতার বর্তমান আবহকে বিশ্লেষণের ধারায় তার ঐতিহ্যিক পথপরিক্রমা ও সুষ্ঠু আলোচনার দাবি রাখে। প্রবন্ধের লেখকও সেভাবে বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনতম নিদর্শন চর্যাপদ থেকে শুরু করে বর্তমানের যান্ত্রিকতার জাঁতাকলে পিষ্ট কাব্যানুভূতির জটিল এবং দুর্বোধ্য বিষয়কে তার সুচিন্তিত মতামতে উপস্থাপন করতে সচেষ্ট হয়েছেন। বর্তমানে কবিতার আঙ্গিক ও বৈশিষ্ট্য বুঝতে এই ধরনের আলোচনা নিঃসন্দেহে সময়ের দাবি রাখে। কিভাবে বাংলা সাহিত্যের যাত্রাপথ প্রাচীনকালের সুদীর্ঘ পরিক্রমায় মধ্যযুগের ধর্মীয় ভাবানুভূতির আবর্তে পড়ে পরবর্তীতে তা উনিশ শতকের নবজাগরণের সুর্বণ সময়ে আধুনিকতার মোড় নেয়। এসব কালপর্বে বৈষ্ণম পদাবলী থেকে আরম্ভ করে মঙ্গল কাব্যধারা কাব্যসাহিত্যে যে যুগান্তকারী অবদান রাখে যার সমৃদ্ধ পরিণতি আসে উনিশ শতকের নতুন আলোর বিচ্ছুরিত কিরণে। প্রসঙ্গক্রমে এসেই যায় এই শতকের দুই দিকপাল ঈশ্বরগুপ্ত এবং মাইকেল মধুসূদন দত্তের কথা? নব প্রভাতের উদীয়মান সূর্য রবীন্দ্রনাথের কালজয়ী সৃষ্টিযজ্ঞের দুর্লভ সংযোজন। বিংশ শতাব্দীর শুরুতে এই অপরাজেয় কবিকে পাশ কাটানোর চেষ্টায় মাতোয়ারা হন কল্লোলযুগের পষ্ণপা-বেরা। অর্ধশতব্যাপী রাজত্ব করা রবীন্দ্র প্রতিভাকে এড়িয়ে তিরিশের দশকের পাঁচ কবি কাব্যিক জগতে যে নতুন আবহের সূচনা এবং বিস্তৃতি ঘটল তাও ছিল সময়ের প্রয়োজনে যুগের দাবি। যান্ত্রিক সভ্যতার আবর্তে পড়া নব্য আধুনিকতার চাহিদা মেটানো কবিরা সফলভাবেই তাদের যাত্রাপথকে মহিমান্বিত করলেন। প্রসঙ্গক্রমে এসেই যায়’ ’৫০, ’৬০ ’৭০ দশকের অগ্নিঝরা সময়গুলোতে পরবর্তী কবিদের রাজনৈতিক চেতনার এক অনবদ্য প্রয়াস যা কবিতার জগতকে ভিন্ন মাত্রায় রূপ দেয়। সেই ঐতিহাসিক অভিযাত্রার পথ ধরে বর্তমান কবিদের অন্য রকম বিচরণ কাব্য জগতকে ব্যতিক্রমী ধারায় নিয়ে যায়। এভাবে দীর্ঘ পথপরিক্রমায় পরিবর্তনের যে আবহ কবিতার গতি নির্ণয়ে প্রভাব ফেলে সেটাও সময়ের দাবিতে অনিবার্য। উন্নতমানের এই প্রবন্ধটি কালের বিবর্তনে কাব্য জগতের বৈচিত্র্যপূর্ণ প্রতিবেশের সঙ্গে শুধু পরিচয়ই করাবে না, এর পর্যায়ক্রমিক ইতিহাসও পাঠকের মননকে সমৃদ্ধ করবে। দ্বিতীয় অধ্যায় বিশ জন উদীয়মান কবির যুগল কবিতা পত্রিকাটির একটি বিশিষ্ট আয়োজন। আধুনিক গদ্য কবিতার আঙ্গিকও বৈশিষ্ট্যের কাব্যিক অনুভবে সুসংবদ্ধ কথামালা পাঠকদের মুগ্ধতার জায়গায় নিয়ে যাবে। বিষয়বস্তুর দুর্বোধ্যতাও এখানে পাঠক সমাজকে বিড়ম্বিত করতে পারে। অনীক মাহমুদের গুচ্ছ কবিতা ক্ষুদ্র সাময়িকীটির অন্যতম আকর্ষণ। কবি হিসেবে অনীক মাহমুদের একটি বিশেষ পরিচিতি আছে। সেই প্রেক্ষিতে তার কবিতার আবেদনও পাঠকের হৃদয়কে ছুঁয়ে যায়। আশা করি এখানেও তার ব্যতিক্রম হবে না নতুন পাঠক তৈরি করতে প্রতিষ্ঠিত কবিরা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেনÑ এ কথা বলাই যায়। আয়েশা ঝর্ণার অনুবাদে পাজের কবিতা পাঠকদের ভিন্ন মাত্রার আনন্দ দেবে। নারীবাদী এই কবির কবিতাগুলোর শৈল্পিক রূপান্তর পাঠকরা নিশ্চয়ই উপভোগ করবেন। অনুবাদকের নান্দনিক শৌর্য ভিন দেশী এক কবিকে চেনাতে যে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখে তাও প্রশংসার দাবিদার। আবু হাসান শাহরিয়ার ‘কিছু দৃশ্য অকারণে প্রিয়’ কাব্যটির একটি যৌক্তিক আলোচনা করেছেন আতোয়ার হোসেন। যা পাঠককে আর একটি কবিতার বই চেনাতে বিশেষ ভূমিকা রাখবে। ছোট্ট এই পত্রিকাটি পাঠক সমাজে আদৃত হবে এ আশা ব্যক্ত করে এর সর্বাঙ্গীণ সফলতা কামনা করছি।
×