ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

সরকার মাসুদ

ডরিস লেসিঙ তার কথাসাহিত্য

প্রকাশিত: ০৬:০৭, ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

ডরিস লেসিঙ তার কথাসাহিত্য

পঞ্চাশের প্রজন্মের অর্থাৎ যুদ্ধোত্তরকালের বড় মাপের কথাসাহিত্যিক ডরিস লেসিঙ। এই মহিলা সাহিত্যিক একজন ব্রিটিশ লেখক, কিন্তু তার জন্ম ইরানে, ১৯১৯ সালের ২২ অক্টোবর। ছোটবেলায় তিনি বাবা-মার সঙ্গে আফ্রিকায় থাকেন। যৌবন ও প্রৌঢ়ত্বের সময়টা কাটে জার্মানি এবং ব্রিটেনে। জিম্বাবুইয়ের ঔপনিবেশিক পরিবেশ এবং বর্ণবাদী আফ্রিকা তার গল্প উপন্যাসে গভীর ছায়া ফেলেছে। ওই অঞ্চলের বঞ্চিত-নিপীড়িত লোকজনের মানবেতর জীবনধারাকে ভিত্তি করে রচিত হয়েছে তার প্রথম উপন্যাস ঞযব এৎধংং রং ংরহমরহম (১৯৫০)। ২৫৬ পৃষ্ঠার এই বই এগারোটি অধ্যায়ে বিভক্ত। রিচার্ড টার্নার নামে জনৈক কৃষকের স্ত্রী মেরি টার্নারের হত্যার ঘটনার ভেতর দিয়ে শুরু হয় উপন্যাসের কাহিনী। তারপর গল্প এগোতে থাকে, খুলতে থাকে জট। উপন্যাসটিকে বিরূপ নিয়তির বিরুদ্ধে এক নারীর সংগ্রামগাথাও বলতে পারি আমরা। মেরি কেন্দ্রীয় চরিত্র। চরম অনগ্রসর পুরুষ শাসিত দরিদ্র সমাজে একজন নারী কতখানি মানসিক চাপ, কতটা মর্মন্তুদ অন্তর্দ্বন্দ্বের শিকার হতে পারে; ওই কৃষক-স্ত্রীর নির্মম হত্যাকা-ের ভেতর দিয়ে লেসিঙ তা ব্যক্ত করেছেন নিরাসক্ত ভঙ্গিতে। এই উপন্যাস পাঠকপ্রিয় হতে পেরেছে। এর সূত্রেই লেখক বার বার আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এসেছেন। কিন্তু ঞযব এড়ষফবহ ঘড়ঃনড়ড়শ (১৯৬২) হচ্ছে সেই উপন্যাস যেটা প্রকাশের পর পরই লন্ডনসহ বহির্বিশ্বে ব্যাপক আলোচনার সূত্রপাত হয়। লেসিঙ বৃহত্তর পরিম-লে পরিচিতি অর্জন করতে আরম্ভ করেন। তার খ্যাতির বৃত্ত প্রসারিত হয় বহুদূর পর্যন্ত। এটা প্রথানুগ কোন উপন্যাস নয়। প্রচল অর্থে নায়ক-নায়িকা নেই এতে। মলি ও আন্না নামে দুটি কেন্দ্রীয় চরিত্র আছে। স্বামীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ির কারণে দু’জনেই স্বাধীন জীবনযাপন করছে। এরা মনে করে, বিবাহ নামের প্রথাটি শোষণের একটা প্রক্রিয়া। তাই তারা নারী মুক্তির স্বপ্নে বিভোর থাকে। এদের জীবনেও প্রেম আসে, কিন্তু বিবাহবহির্ভূত এই সম্পর্ক আনন্দ নয় বরং তিক্ততা ও বিষাদ সৃষ্টি করে তাদের মনে। ঞযব এড়ষফবহ ঘড়ঃবনড়ড়শ-এ পাঁচটি অধ্যায় আছে। এই উপন্যাসের আঙ্গিক গতানুগতিক নয়। কেন্দ্রীয় চরিত্র আন্না আলাদা আলাদা পাঁচটি রঙের নোটবুকে নিজের কথা লিখে রাখে। পাঁচটি নোট বইয়ে যেসব অভিজ্ঞতা লিপিবদ্ধ হয়েছে তাতে একটি ঘটনা পরম্পরা সৃষ্টি হয়। লেখক এসব চরিত্রের ভাবনা-কল্পনার ভেতর দিয়ে মার্কসবাদ, সার্ত্রের জীবনদর্শন প্রভৃতি উল্লেখ করেছেন। আন্না এক সময় উপলব্ধি করে, জীবন সব সময় যুক্তি-তর্কের ধার ধারে না, সে তার নিজের ধারামাফিক চলে। এন্টি-নভেলের কিছু কিছু বৈশিষ্ট্য এতে লক্ষ্য করা যায়। মলি এবং আন্নার সমস্যা শুধুই ব্যক্তিগত নয়, শৈল্পিকও। বিভিন্ন রঙের নোটবুকে লিখিত আন্নার ডায়েরিগুলোর প্রতিটি তার জীবনের বিভিন্ন অধ্যায়ের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। মানসিক স্বপ্ন, আশা-আকাক্সক্ষা, আচার-আচরণ ও শৈল্পিক সঙ্কটের অত্যন্ত বিশ্বস্ত শিল্পরূপ এই উপন্যাস। ঞযব ঈযরষফৎবহ ড়ভ ারড়ষবহপব নামে ডরিস লেসিঙের একটি সিরিজ উপন্যাস আছে। এটা ১৯৫২-’৬৯ সালের মধ্যে রচিত। মনে করা হয় যে, উপরে উল্লিখিত উপন্যাস দুটির মতো এটাও তার বড় মাপের সাহিত্যকর্ম। কেন্দ্রীয় চরিত্র মার্থা কোয়েস্টকে ঘিরে এই উপন্যাসের কাহিনী ও ঘটনাপ্রবাহ অগ্রসর হয়েছে। আফ্রিকার ঔপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থা ও বর্ণবৈষম্যভরা সমাজরীতির সুস্পষ্ট নেতিবাচক প্রভাব আমরা লক্ষ্য করি এই বইয়ে। বইটি প্রকাশিত হওয়ার পর কিছু সমালোচক ডরিসকে নারী বাদী লেখক আখ্যা দেন। আমার ধারণা, যে অর্থে ভার্জিনিয়া উলফ, সিমন দ্য বভেয়া বা আমাদের তসলিমা নাসরিন নারী বাদী ঔপন্যাসিক বা লেখক, ডরিস লেসিঙ ঠিক সেই অর্থে নারী বাদী নন। কেননা ওদের মতো কোন আদর্শের পতাকাতলে আসন গ্রহণ করেননি তিনি। তা ছাড়া নারীবাদের ইতিবাচক ফল লেসিঙ মনে করেন, কেবল শিল্পোন্নত পশ্চিমা বিশ্বের সুবিধাভোগী নারীরাই ভোগ করছেন। নারীবাদের প্রচার নয় বরং নারী নিজেকে কিভাবে দেখতে চায়, পুরুষশাসিত সমাজে নারীর অবস্থান কি রকম হওয়া সমীচীন সেটাই বলতে চেয়েছেন এই লেখক। গধৎধ ধহফ উধহহ (১৯৯৯) নামে লেসিঙ একটি অত্যন্ত কল্পনা প্রধান উপন্যাস লিখেছেন। আফ্রিকার ভয়াবহ অনাবৃষ্টির পটভূমিতে রচিত এই গ্রন্থ বিরল মানবিক অভিজ্ঞতা ধারণ করে আছে। এই উপন্যাস রচিত হয়েছে লেখকের অনাবৃষ্টি সংক্রান্ত মর্মস্পর্শী অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে। জনৈক কফি চাষীর জবানিতে ব্যক্ত হয়েছে সেই প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কথা। সহায়-সম্বলহীন ড্যানের প্রতি লেসিঙ এতটাই মমত্ব দেখিয়েছেন যে, গধৎধ ধহফ উধহহ উপন্যাসের বর্ধিত অংশ হিসেবে কয়েক বছর পর, ২০০৬ সালে, তিনি ঞযব ংঃড়ৎু ড়ভ মবহবৎধষ উধহহ ধহফ গধৎধ’ং উধঁমযঃবৎ নামে আরেকটি উপন্যাস লিখে ফেলেন। এই বইয়ে ড্যান প্রাপ্তবয়স্ক। সে জ্ঞানের অন্বেষণে বেরিয়েছে। সভ্যতার সঙ্কট তাকে হতাশও করেছে। ড্যান মানুষের ওপর আস্থা হারিয়েছে। তার বিশ্বস্ত বন্ধু বরঞ্চ একটি শ্বেত কুকুর যে তাকে হতাশার গভীর থেকে টেনে তোলে। এই উপন্যাসের ভেতর দিয়ে লেখক আমাদের বাসযোগ্য পৃথিবী এবং ভবিষ্যতের পৃথিবীকে নানা মাত্রায় বিশ্লেষণ করেছেন। লেসিঙের আরেক উপন্যাস ঞযব পষবভঃ-এর প্রকাশকাল ২০০৭। এ এক অদ্ভুত গ্রন্থ যেখানে কবিসুলভ কল্পনা ডানা মেলেছে ইচ্ছেমাফিক। পষবভঃং নামে পরিচিত একটি প্রাচীন নারী সম্প্রদায় এ ডেনের উপকূলবর্তী অঞ্চলে বাস করত। এদের ভেতর পুরুষ ছিল না। শিশুর জন্ম হতো চাঁদের, আবর্তনের দ্বারা। একদিন হঠাৎ এক পুরুষ শিশু জন্ম নেয় যা ক্লে¬ফটদের মধ্যে বড় ধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে। সমাজে বিরাজমান রীতি-নীতি ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম হয়। নানা রকম জটিলতা দেখা দেয় ওই নারীগোষ্ঠীর ভেতর। লেখক সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের বিষয়বস্তু হাজির করেছেন এই উপন্যাসে। চমকপ্রদতা এর সবচেয়ে বড় বেশিষ্ট্য। নিঃসন্দেহে এই গ্রন্থ এক আশ্চর্যজনক নারী জগতের গল্প বলে যা বাংলাভাষী পাঠককে বেগম রোকেয়ার ‘নারীস্থান’-এর কথা মনে করিয়ে দিতে পারে। এখন আমি ডরিসের উপন্যাসশৈলী নিয়ে দু’চার কথা বলব। তার অধিকাংশ গল্প-উপন্যাসের আঙ্গিক শাদামাটা। ব্যতিক্রম ঞযব এড়ষফবহ ঘড়ঃবনড়ড়শ, ঞযব পষবভঃ-এর মতো অল্প কয়েকটি রচনা। নিরীক্ষাধর্মী লেখক বলতে যা বোঝায় তিনি তা নন। সহজ-সরল গদ্যে উপস্থাপন করেছেন গল্প-উপন্যাস। ভাষার সারল্যের ও ভাবের গভীরতার বিচারে তিনি লরেন্স, হেমিংওয়ে প্রমুখের সগোত্র। ঞযব এড়ষফবহ ঘড়ঃবনড়ড়শ- এর আঙ্গিকের ক্ষেত্রে লেসিঙ পূর্বতন ছক থেকে বেরিয়ে এসেছেন। ভাষাও ঠিক আগের মতো সর্বত্র অতখানি সুগম নয়। বোঝা যায়, বইটি লিখতে বসার আগে লেখক বিষয়বস্তু এবং লিপি কৌশল দুটো বিষয়েই ভেবেছেন। ঞযব এড়ষফবহ ঘড়ঃবনড়ড়শ খানিকটা ডায়েরি, খানিকটা জার্নালের স্টাইলে লেখা। স্মৃতির মধ্য দিয়েও অনেক কিছু উঠে এসেছে! এই নিবন্ধে আলোচিত অন্য উপন্যাসগুলোর পাঠ থেকে একটা জিনিস পরিষ্কার যে, লেসিঙের গল্প-উপন্যাসে চিত্রিত বাস্তবতা সরলরৈখিক নয়। আবার তা ফ্রান্সের সুররিয়্যালিস্টিক লেখকদের, রচনার মতো ঠিক পরাবাস্তবও নয়। যুক্তি, জীবনোপলদ্ধি ভাবাবেগ ও বাস্তবতার ছন্দ লক্ষণীয়ভাবে উপস্থিত এখানে। সন্ত্রাসবাদ নিয়ে তিনি যখন কথাসাহিত্য করেন, তখনও বিষয়বস্তু ও রচনারীতি উভয় দিক থেকেই তাতে আলাদা মাত্রা যোজিত হয়। মনোবিশ্লেষণধর্মী এই উপন্যাসে আছে যাপিত জীবনের ভাষ্য, স্মৃতিময়তা, আত্মজৈবনিক নানা উপাদান। সংস্কৃতি, রাজনীতি ও আদর্শবাদের একটা সমন্বিত চেহারা লক্ষ্য করা যায় এই বইয়ে। আর কেবল ঞযব এড়ষবহ ঘড়ঃবনড়ড়শ এই নয়, লেসিডের অপরাপর উপন্যাসেও আমরা এসব দেখতে পাই। দেখি সেই বাস্তবের বিচিত্র চেহারা যা সমাজ ও সময়ের চিত্র ফুটিয়ে তুলেছে প্রবলভাবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী পৃথিবীর সামাজিক-রাজনৈতিক অস্থিরতা, বিচ্ছিন্নতাবোধ, নির্বেদ, জীবনাদর্শ ও আদর্শজনিত টানাপোড়েনÑ এই বিষয়গুলো ঘুরেফিরে উপজীব্য হয়েছে লেসিঙের গল্প-উপন্যাসে। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের যুদ্ধোত্তর ইউরোপ, মানবিক আশা-নিরাশা, বিষাদ-বিভ্রান্তির কথা লেখক বলতে পেরেছেন মুনশিআনার সঙ্গে। অন্যদিকে উপনিবেশ আমলের আফ্রিকার শাসনরীতি, বর্ণবাদ ও সমাজব্যবস্থার খোলামেলা সমালোচনাও করেছেন। এ জন্য তাকে ‘আফ্রিকার সমালোচক বলা হয়ে থাকে। পশ্চাৎপদ আফ্রিকার সমাজ, রীতিনীতি, বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গি, কালো মানুষদের স্বাধিকার চেতনা ও বিক্ষোভ Ñএগুলোও আরেক নোবেল বিজয়ী লেখক নাডিন গর্ডিমারের কথাসাহিত্যে তীব্রভাবে উপস্থিত। কিন্তু অকপট উচ্চারণ বা সভ্যভাষণের দিক থেকে তিনি ডরিস লেসিঙকে ছাড়িয়ে যেতে পারেননি। গর্ডিমারের সিদ্ধি ও সাফল্য অন্য জায়গায়। মার্কস এবং ফ্রয়েডÑতত্ত্ববিশ্বের দুই প্রধান তারকা লেসিডের উপন্যাসভাবনায় অনেকখানি প্রভাব বিস্তার করেছে। বিশেষ করে মলি চরিত্রের স্বপ্নগ্রস্ত অবস্থা ফ্রয়েডের মনসমীক্ষণের বিষয়টি মনে করিয়ে দেয়। যুদ্ধপরবর্তী যুগে ইউরোপের চিন্তাজগতে পরিবর্তন হচ্ছিল। সমাজতন্ত্র ও ধনতন্ত্র এই দুই দলে বিভক্ত মানুষের মনে দানা বাঁধছিল স্বপ্ন, সংশয় ও অস্থিরতা। এসব প্রসঙ্গ লেখকের অধিকাংশ লেখাতেই উঠে এসেছে। রচনাশৈলী বা নন্দনতত্ত্ব নিয়ে ডরিস লেসিঙ খুব একটা মাথা ঘামিয়েছেন, এমন মনে হয় না। সহজ-সাবলীল নির্মেদ গদ্যে তিনি উপস্থাপন করেছেন তার ‘বলবার কথা’। সবচেয়ে বেশি জীবন্ত ও বিশ্বাস্য মনে হয় সেই সব বয়ান যেখানে লেখক জিম্বাবুইয়ের প্রসঙ্গ তুলেছেন অথবা আত্মজৈবনিক উপাদান ব্যবহার করেছেন। তার অঙ্কিত চরিত্র আন্না তারই আদলে সৃষ্ট। উভয়েই নিঃসঙ্গ; নানা কারণে মর্মপীড়িত। আবার উভয়েরই শৈশব কেটেছে আফ্রিকায়। নিরীক্ষার দাসত্ব না করেও, আঙ্গিক প্রধান উপন্যাস না লিখেও যে বড় মাপের শিল্পকর্ম সৃষ্টি করা সম্ভব, লেসিঙ তার এক অত্যুজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। ঞযব এড়ষফবহ ঘড়ঃনড়ড়শ লেখার মাধ্যমে তিনি যে উচ্চতায় পৌঁছেছেন, সেই জায়গাটি অর্জন করতে পারেন পৃথিবীর খুব কম লেখক।
×