ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

নাজনীন বেগম

কক্সবাজারে ইনানী বিচের এক সফল নারী

প্রকাশিত: ০৫:৫৮, ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

কক্সবাজারে ইনানী বিচের এক সফল নারী

বাংলাদেশের ছোট্ট একটি জেলা শহর কক্সবাজার। বঙ্গোপসাগরের প্রবহমান জলরাশির অনুপম নৈসর্গিক রূপে ভরা এই শহরটি বিশ্বের সর্ববৃহৎ সমুদ্র সৈকতের মর্যাদা পেয়ে আসছে। সাগরের উত্তাল স্রোতের সীমাহীন গর্জন যেভাবে প্রকৃতির রূপ-মাধুর্যকে আকর্ষণীয় করে তোলে একইভাবে অসংখ্য দর্শনার্থীর উপচে পড়া ভিড়ে এই দীর্ঘতম সৈকতের মনোমুগ্ধকর দৃশ্যও চোখে পড়ার মতো। অনন্ত সমুদ্রের বাধভাঙ্গা জোয়ারে অশান্ত ঢেউ যেমন পর্যটকদের বিস্ময়ে অভিভূত করে তেমনিভাবেই সাধারণ মানুষের প্রতিদিনের জীবনযাত্রার বিচিত্র কর্মযোগও উপস্থিত দর্শকদের নানা মাত্রিকে আপ্লুত করে। কারণ সমুদ্র নিকটবর্তী এসব কর্ম প্রবাহের সঙ্গে অচ্ছেদ্য বন্ধনে জড়িয়ে থাকে হরেক রকম মানুষের চাওয়া-পাওয়া এবং আশা-আকাক্সক্ষার বিচিত্র আগ্রহ। নানাবিধ পণ্যসামগ্রীর সম্ভারে ভরপুর এসব সাজানো-গোছানো দোকানের পরিচর্যায় যারা প্রতিনিয়তই কর্মব্যস্ত তারাও এই অপার রূপমাধুরীর সমান অংশীদার। দোকানের বিচিত্র শিল্পকর্মের অভিনব পণ্য আগত মানুষদের যেভাবে আপ্লুত করে তা সত্যিই দৃষ্টিনন্দন। শামুক আর ঝিনুকের তৈরি আকর্ষণীয় অলঙ্কার হাতেগড়া শৈল্পিক সুষমার এক পরিপূর্ণ আঁধার। ব্যবসায়িক সাফল্য তো আছেই তার ওপর নিজস্ব দ্রব্যের মনোমুগ্ধকর আয়োজন ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়েরই পরিতৃপ্তিও আছে। ছোট ছোট ছেলেমেয়ে ডালা সাজিয়ে যেমন দর্শনার্থীর চারপাশে ঘোরাফেরা করে তেমনি ব্যবসাতে পুঁজি খাটিয়ে ব্যক্তিগত দোকান গুছিয়ে নেয়ার ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাও চোখে পড়ার মতো। স্থানীয় যেসব অধিবাসী এ ব্যবসায় নিজেদের সফলতার জায়গায় নিয়ে যায় তাদের সঙ্গে কথা বললে জীবনযুদ্ধের এক নিখুঁত চিত্রও দর্শকের সামনে উঠে আসে। কক্সবাজার থেকে প্রায় ৩৯ কিলো দূরে ইনানী বিচে এক মহিলা উদ্যোক্তার সঙ্গে আলাপচারিতায় বের হয়ে আসে তার প্রতিদিনের জীবন-সংগ্রামের এক পরিচ্ছন্ন ছবি। একসময় হতদরিদ্র অবস্থা থেকে বর্তমানে সচ্ছলতার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যাওয়া এক ক্ষুদ্র নারী ব্যবসায়ী খুরশিদা বেগম। স্বল্প ঋণে ব্যবসা শুরু করে পরে তার পরিধি ক্রমান্বয়ে বিস্তৃত করার চমকপ্রদ ঘটনা সত্যিই অনুসরণযোগ্য। মাত্র ১২ বছর বয়সে খুরশিদা বাল্যবিয়ের অভিশাপে জর্জরিত। অনিবার্যভাবে অকাল মাতৃত্বও তাকে দিশেহারা করে তোলে। পারিবারিকভাবে শ্বশুর এবং বাবার দিক থেকে বলতে গেলে প্রায়ই সহায় সম্বলহীন। অসুস্থ স্বামী কোনমতে একটি চায়ের দোকান চালান। যা আয় হয় তাতে সংসারের দায় মেটে না। পর পর তিন সন্তানের জননী খুরশিদা পড়েন আর্থিক দুর্বিপাকে। ২ ছেলে ১ মেয়ে। সংসার চালাতে হিমশিম খেতে খেতে এক সময় স্বপ্ন দেখতে শুরু করে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর। কিন্তু স্বামীর যা আয় তা দিয়ে সংসারই চলে না পুঁজি পাবে কোথা থেকে। স্থানীয় কল্যাণ সমিতি এ ধরনের দুস্থ মহিলাদের স্বল্প সুদে ঋণ বিতরণ করে। ২০১৩ সালে এই কল্যাণ সমিতির কাছ থেকে ২০ হাজার টাকা ঋণ করে ছোট্ট একটি দোকান খুলে বসে ইনানী বিচে। ১ বছর যেতে না যেতেই সফলতার মুখ দেখতে থাকেন। কারণ ইতোমধ্যে সেই ২০ হাজার টাকা শোধ করা হয়ে যায়। পরবর্তীতে আরও ৩০ হাজার টাকা ঋণ করে ছোট্ট দোকানের পরিধি আরও বাড়াতে থাকে। রং-বেরঙের টুপি, শাল, ম্যাক্সি এবং ঝিনুক আর শামুকের তৈরি বিবিধ অলঙ্কারে তার এই দোকানটি আজ কানায় কানায় পূর্ণ। ঋণ পরিশোধ করতে এখন আর কোন সমস্যাই নেই। সংসারেও কোন অভাব-অনটন নেই। তবে সঞ্চয়ের দিকটা এখনও ভাবতে পারছে না। আরও কিছু সময় লাগতে পারে পরিপূর্ণ উদ্যোক্তার আসনে পৌঁছাতে। ছেলেমেয়েরা সবাই স্কুলে পড়াশোনা করে। খুরশিদার আন্তরিক ইচ্ছা তাদের নিজেদের পায়ে দাঁড় করানোর। আর এ জন্য যা যা করা দরকার সবই দিতে প্রস্তুত সে। শুধু যে তাকে দোকান সামলাতে হয় তা নয়Ñ পারিবারিক সমস্ত দায়-দায়িত্বও তাকেই বহন করতে হয়। সেই কাকডাকা ভোরে ঘুম থেকে উঠে সংসারের যাবতীয় কাজকর্ম সারতে হয়। স্বামী তেমন কোন সহায়তা করতেও পারে না। সকালের নাস্তা, দুপুরের খাবার যোগাড় করা, ঘর-দুয়ার গোছানে, সন্তানদের স্কুলে পাঠানোÑ সবই পরিকল্পিতভাবে গোছাতে হয় খুরশিদাকে। তার পরেও পরিতৃপ্তি আর গর্বের হাসি তার মুখে। সে থেমে থাকেননিÑ নিজের যা আছে তাই দিয়েই ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছে প্রতিনিয়তই। বাধাবিপত্তি এসেছে। তোয়াক্কা করেনি। দৃঢ়প্রত্যয় আর সাহসী মনোবলে শুধু সামনেই তাকিয়েছেÑ কোন পিছুটান তাকে বিব্রত করতে পারেনি। আর তাই আজ সে একজন পরিপূর্ণ সফল নারী। যদিও তাকে আরও কঠোর পরিশ্রম এবং অবিচলিত লক্ষ্যে শুধুই এগিয়ে যেতে হবে। কঠিন ব্রতে এগিয়ে চলা এই সফল নারী অনেকের জন্য দৃষ্টান্ত হতে পারে। যে নিজেকে গড়ে তুলতে জীবনযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে পেছনে টানা কারও পক্ষেই সম্ভব হয় না। সে পুরুষ কিংবা নারী যেই হোক না কেন। একটি সফল বার্তা খুরশিদা সবাইকে জানাতে চায় দারিদ্র্যতার কাছে নিজেকে সমর্পণ করা নয় তাকে অকুতভয়ে জয় করতে হবে। নিজের সম্বল নিয়েই বিড়ম্বিত জীবনের মোড় ফেরাতে হবে। ভাগ্য কারও সহায় হয় না নিজেকে নিজের ভাগ্য গড়ে নিতে হবে।
×