ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

আয়তি নাহার

ফুলন দেবী ॥ নিপীড়িত এক নারীর জেগে ওঠা

প্রকাশিত: ০৫:৫৭, ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

ফুলন দেবী ॥ নিপীড়িত এক নারীর জেগে ওঠা

ভারতের উত্তর প্রদেশের এক প্রত্যন্ত অঞ্চল জালৌন জেলার হরহাকাপুরওয়া একটি গ্রাম। পিছিয়ে পড়া এই গ্রামের হতদরিদ্র এক কৃষক দেবীদীন যারা বংশানুক্রমিকভাবে নৌকা চালানোর পেশায় নিয়োজিত ছিল। শুধু আর্থিকভাবেই গ্রামটির দৈন্যদশা ছিল তা নয়Ñ সামাজিক-সাংস্কৃতিক অঙ্গনেও ছিল অব্যাহত পশ্চাদবর্তিতা। জন্ম থেকেই কন্যাসন্তানরা ছিল অবজ্ঞা এবং উপেক্ষার পাত্র। শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ বলতে একেবারে শূন্যের কোঠায়। বাল্যবিয়ে ছিল এক অবধারিত সামাজিক বিধি। গতানুগতিক প্রথা, চলে আসা রক্ষণশীলতা, কঠোর বর্ণাশ্রমের অনতিক্রম্য বাধন, ধর্মীয় গোঁড়ামি সব মিলিয়ে বিংশ শতাব্দীর ষাট দশকেও হরহাকাপুরওয়া গ্রামটি ছিল মূলত কট্টর সামাজিক অপশাসনের এক নির্মম বিধিনিষেধের জালে আটকে পড়া। এই নিয়মবদ্ধতার ঘেরাটোপে নিম্নবিত্ত আর বর্ণের জাঁতাকলে পিষ্ট এক সমস্যা জর্জরিত পরিবারে জন্ম ফুলন দেবীর। ১৯৬৩ সালে জন্ম নেয়া ফুলন দেবী অতি বাল্যকাল থেকেই প্রত্যক্ষ করেন নির্বিত্ত পিতার আর্থিক টানাপোড়েন। কৃষি খামারে বর্গাখাটা চাষী কখনও বা খেটে খাওয়া দিনমজুর পিতা দেবীদীনের যৎসামান্য আয়ে পরিবারের অন্নসংস্থান হতো। এরই মধ্যে পারিবারিক ষড়যন্ত্রের কবলে পড়া দেবীদীন উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া সামান্য জমিজমা থেকেও বঞ্চিত হয়। এমনই ভাগ্যহত পিতার কন্যাসন্তানের দুর্ভোগ যে অবধারিত তাও নিষ্ঠুর সমাজ ব্যবস্থারই করুণ আখ্যান। পারিবারিকভাবে আর্থিক দুর্বিপাকে পড়া ফুলন দেবী শৈশব থেকে স্বাধীনচেতা দৃঢ় প্রত্যয়ী এবং সাহসী নারী হিসেবে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করলেও সেটাকে কেউই সুনজরে দেখেনি। এমনকি তার পিতা-মাতাও নয়। তারই অনিবার্য পরিণতি হিসেবে বাল্যবিয়ের প্রকোপে পড়া। মাত্র ১১ বছর বয়সে ৩৪ বছরের এক বিপতœীক পুরুষের সঙ্গে ফুলনের বিয়ে হয়। ফলে যা ঘটার তাই ঘটে। অপরিপক্ব শরীর আর মনের ওপর দাম্পত্য অত্যাচারে অতিষ্ঠ ফুলন স্বামীগৃহ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। কিন্তু পিতৃগৃহেও তার কোন স্থান হলো না। নিরুপায় হয়ে তাকে মানুষের বাসায় আশ্রয় নিতে হলেও শেষ অবধি স্বামীর সংসারে ফিরে আসতে হয়। এবারে সংসারে অত্যাচারের আর এক মাত্রা যুক্ত হলো স্বামীর দ্বিতীয় বিয়ে করা বউ, সতীনের সংসারে অপদস্থ, নাজেহাল ফুলন পুনরায় বাবার আশ্রয়ে গিয়ে ওঠে। আর এই সময় পিতৃ সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত বাবার পাশে দাঁড়ায় ফুলন। পারিবারিক ষড়যন্ত্রের শিকার দেবীদীনের পক্ষ হয়ে কন্যা ফুলন আদালতে ন্যায্য বিচার দাবি করে। কিন্তু ক্ষমতাধর, চক্রান্তকারীরাই বিচারের রায় তাদের পক্ষে নিয়ে যায়। ফুলন পড়ে আরও বিপাকে। বাবার রোষানল তাকে প্রতিনিয়তই দগ্ধ করতে থাকে। অনিবার্য পরিণতিতে আবারও গৃহছাড়া। এর পরের ইতিহাস নিপীড়িত নারী থেকে জ্বলে ওঠা এক বিদ্রোহী, প্রতিবাদী, প্রতিহিংসাপরায়ণ এক দুর্ধর্ষ শক্তির নতুন উদ্যমে আর্বিভূত হওয়া। তারও আগে ফুলনের জীবনে নেমে আসে আর এক অবর্ণনীয় দুর্ভোগ। কয়েকজন মানুষরূপী হিংস্র জানোয়ার যারা হত্যা এবং লুণ্ঠনের মতো অসামাজিক কার্যক্রমে লিপ্ত তাদের পাশবিক নির্যাতনের শিকার হয় ফুলন। হিংস্র এবং পাশবিক মনোবৃত্তি কোন মানুষকে সুস্থ স্বাভাবিক থাকতে দেয় না। ফুলন দেবীকেও দেয়নি। ছোটকাল থেকেই ফুলন দেবী জেদী, তেজী এবং একরোখা ছিলেন। জীবনের নৃশংস ঘাত-প্রতিঘাত তাকে আরও দুর্দমনীয়, বেপরোয়া এবং সহিংস করে তোলে। একজন অসহায় এবং দুর্বল নারী হিসেবে নয় শক্তি এবং ক্ষমতার সীমাহীন দাপটে ভেতরের অনমনীয় কঠিন নিষ্ঠা এবং বোধ তাকে মাতোয়ারা করে তোলে। প্রতিশোধ আর প্রতিহিংসার অদম্য তাড়নায় তাকে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য করে দেয়। স্বাভাবিক কিংবা আইনী প্রথায় যা তিনি অর্জন করতে পারেননি তার বিপরীতে গিয়ে আইন কিংবা সামাজিক অনুশাসনকে তোয়াক্কা না করে নির্দ্বিধায় নিজের হাতে অস্ত্র তুলে নিলেন। নিজের প্রতি অন্যায়-অবিচারের প্রতিবিধানে নিজেই সশস্ত্রভাবে অপরাধীদের বিরুদ্ধে দাঁড়ালেন। নিজের ওপর ঘটে যাওয়া নির্মম অত্যাচারের প্রতিবাদে তিনি ব্যাকুল, দিশেহারা হলেন। যে শারীরিক এবং মানসিক নিপীড়ন ফুলন দেবীকে সহ্য করতে হয়েছে তা যেমন মানবেতর একইভাবে বর্বর যুগের নিষ্ঠুর দলন। প্রতিশোধের উন্মাদনায় উন্মত্ত ফুলন দেবীও। এরই ফলে কিছু নৃশংস অভিযানে ফুলন দেবীও জড়িয়ে পড়েন হত্যা, লুণ্ঠন আর অপহরণের মতো অসামাজিক কার্যকলাপে। দুর্ধর্ষ সংগ্রামের টনক নড়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীরও। বিভিন্ন কলা কৌশল খাটিয়ে ফুলন দেবীকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করা হয়। শর্তসাপেক্ষে একসময় তিনি ধরাও দেন পুলিশের হাতে। ভোগ করতে হয় সুদীর্ঘ ১১ বছরের কারাবাস। সাধারণ এক সহজ সরল নারী এমন হিংসাত্মক বিধ্বংসী নারীতে পরিণত হওয়া ফুলন দেবীর জীবনালেখ্য রিক্ততায় ভরা। কোন বিশ্বাস, কোন ধরনের নির্ভরতা কিংবা দায়বদ্ধতার মতো একান্ত নিবিড় ছায়া তার জন্য কখনও অবলম্বনের সুযোগ তৈরি করেনি। বার বার অপমানিত হয়েছেন, নির্যাতিত হয়েছেন, চক্রান্ত আর ষড়যন্ত্রের জালে বিপর্যস্ত হয়েছেন তার পরেও কি নৃশংস হওয়া ছাড়া আর কোন রাস্তা খোলা থাকে...? কারামুক্ত হওয়ার পর নিজেকে শুধরিয়েছেন, শাসন আর আইনের নিয়মবিধিতে আত্মসমর্পণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি সুস্থ ধারার রাজনীতিতে নিজেকে জড়ানো। পর পর দু’বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়া। তার পরেও শেষ রক্ষা হয়নি। আশৈশব যাকে লড়াই করতে হয়েছে সমাজের বৈরী আবহের সঙ্গে, অন্যায়, অবিচার আর নির্যাতনের বিরুদ্ধে সর্বোপরি আইন ও শাসনের ত্রুটিপূর্ণ অব্যবস্থা যাকে হত্যোদম করেছে তার বিপরীত নিজেকে শক্ত অবস্থানে তৈরি করা সবই ফুলন দেবীর জীবনালেখ্যের নির্মম বিধিলিপি। শেষ অবধি সুস্থ স্বাভাবিক জীবন বেছে নিলেও আইন ও শাসন ব্যবস্থার প্রতি নিষ্ঠা দেখালেও সমাজের নির্মম ক্ষতগুলো ফুলন দেবীর চলার পথকে অবারিত হতে দিল নাÑ সামাজিক আবর্জনা থেকে তিনি যথার্থ মুক্তিও পেলেন নাÑ তার শেষ বিদায় সেই চিহ্নই এঁকে দিল ফুলনের মরদেহে। ২০০১ সালের ২৫ জুলাই নতুন দিল্লীতে সংসদ থেকে বের হওয়ার পথে আততায়ীর গুলিতে ফুলন দেবী শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। তার দ্বারা সংঘটিত বিভিন্ন গণহত্যা প্রতিশোধের সঙ্কল্প নিয়েই ঘাতকরা তাকে মেরে ফেলে। এভাবে এক বিচিত্র অভিযাত্রার দুঃসাহসিক পথিক অকুতভয় ফুলন দেবী অত্যাচার আর অবিচারের বিরুদ্ধে খ—গহস্ত হলেন। জীবন বাজি রেখে অনেক পাশবিকতার জবাব দিলেন যদিওবা আইনের পথে নয়। কিন্তু নিজেকে যখন তিনি নতুনভাবে তৈরি করতে আইন ও শাসনের প্রচলিত ধারায় স্বাভাবিক পথ বেছে নিলেন তখন কেন তাকে আহূতি দিতে হলো? বিপন্ন জীবনের গতিতে বিভ্রান্ত পথচলার ক্লান্ত, অবমন্ন ফুলন যখন সরল-সোজা পথে জীবনের মোড় ঘোরালেন সেই সময়ও তাকে নৃশংস হত্যার শিকার হতে হলো। জীবনভর অন্যায় আর অবিচারের নির্মমতায় ক্ষত-বিক্ষত হতে হয় ফুলন দেবীকে। যার সামান্যতম বিচার প্রক্রিয়ায় স্থান না পাওয়ার যন্ত্রণায় যাকে দগ্ধ হতে হয়েছে সংক্ষিপ্ত জীবনের একটি নির্দিষ্ট সময় ধরে। প্রতিশোধের স্পৃহা এক সময় ছাইচাপা আগুনের মতো জ্বলে ওঠে। আইনের শাসনকে নিজের অতৃপ্তির কাতারে দাঁড় করালেন তা যেমন ঘটনাবহুল, আলোচিত তেমনি একটি রক্তাক্ত জীবনের বুক ফাঠা দীর্ঘশ্বাসের নিষ্ঠুর জিঘাংসা। ঘর, সংসার, স্বজন, সমাজ সবাই ছিল ফুলন দেবীর প্রতিপক্ষ। এই বহুমাত্রিক বিরোধিতার সহিংস অভিঘাতে অতিষ্ঠ ফুলন দেবীর সুস্থ জীবনের জয়গান গাওয়া ছিল একেবারে আশাতীত। জীবন মানেই সংঘাত, সঙ্কট, সংঘর্ষ, সহিংসতা আর উপর্যুপরি অত্যাচার এই কঠিন বোধ নিয়ে গড়ে ওঠা ফুলন দেবী শেষ অবধি আশা-আকাক্সক্ষা, সত্য ও ন্যায় এবং স্থিত জীবনের স্বপ্ন নিয়ে সুস্থ-স্বাভাবিক পথে বাঁচতে চাইলেও তাকে আরও গাঢ় অন্ধকারে ডুবে যেতে হয়। ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস।
×