ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বিদেশ যাওয়া হলো না হাজেরার, যেতে চায় না আর...

প্রকাশিত: ০৫:৫৪, ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

বিদেশ যাওয়া হলো না হাজেরার, যেতে চায় না আর...

ওয়াজেদ হিরা ॥ কিশোরী বয়স। চেহারায় অজানা আতঙ্কের ছাপ। একজন কান্না করছেন অন্যজন কান্না করতেও যেন ভুলে গেছেন। শুধু সবার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছেন। দৈনিক বাংলার মোড়ে দুই কিশোরীকে চারপাশ ঘিরে আছেন প্রায় অর্ধশত লোক। কেউ ঘটনা দেখছেন, কেউ বোঝার চেষ্টা করছেন। ভিড় ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করে জানা গেল এরা বিদেশ যাত্রী। একজন টেকনাফের মুংরাডি গ্রামের হাজেরা বেগম (১৮)। পাশের বাড়ির দুই মেয়ের সঙ্গে ঢাকা এসেছেন আরও পনেরো দিন আগে। এই পনেরো দিনে বাড়িতে যোগাযোগ করতে পেরেছে মাত্র দু’বার। হাজেরার ভাষ্য মতে, তাকে একটি ঘরে আটকে রাখা হয়েছিল। যেখানে আছে আরও বিশের অধিক মেয়ে। সবাই আটকে আছে সেখানে। কিন্তু আটক থাকা অবস্থায় তাদের উপর কোন নির্যাতন চলেনি। যারা আটক রেখেছে তাদের বিষয়ে কিছুই বলতে পারেনি হাজেরা। এই ব্যক্তিগুলো কোন সংঘবদ্ধ দালাল চক্র নাকি নারী পাচারকারী তা নিয়ে বেশ কানাঘুষা উপস্থিত ব্যক্তিদের মধ্যে। জানা গেল, ছয় ভাইবোনের মধ্যে হাজেরা পঞ্চম। বৃদ্ধ বাবার অভাবের সংসারে একটু সুখের আশায় যেতে চায় সৌদি আরব। বড় ভাই সাগরে মাছ ধরে সেই মাছ বিক্রি করে সংসার চালাচ্ছে। ছোট বেলা থেকে অভাব দেখতে দেখতে এখন অভাব সহ্য হয়ে গেছে ওদের। আর তাই যেতে চায় সৌদি আরবে নারী কর্মী হিসেবে। পাশের বাড়ির দুই মেয়ের পরিচয়ের সুবাদে বাবা তুলে দেন বিশ হাজার টাকাও। কিন্তু গ্রামের সহজ সরল মেয়েটি কংক্রিটের শহর ঢাকায় এসে বুঝতে পারে বিদেশ আরও ভয়ঙ্কর কিছু হলেও হতে পারে। তাই আর বিদেশ যেতে চায় না, ফিরে যেতে চায় নিজ গ্রামে। যেতে চায় মায়ের কাছে। সেখানেই বাঁধে বিপত্তি। ঢাকায় আসার পর বাড়িতে কথা বলাও বন্ধ। আর যাবার পথও অচেনা। শুধু পরিচিত এক সঙ্গীর ফোন দিয়ে একটু একটু বাড়িতে কথা হতো তাও পনেরো দিনে দুই বার মাত্র। দারুসসালাম একটি বাড়িতে তাকে আটকে রাখা হয়েছিল বলেও জানায় মেয়েটি। হাজেরার সাথে আছেন আরেক কিশোরী নওগাঁর কাটখড় এলাকার পপি আক্তার (১৮)। উপস্থিত লোকজন জানান, মেয়েটি দালাল বা পাচার চক্রের সঙ্গে জড়িত। কিন্তু মেয়েটি অনবরত কেঁদে যাচ্ছিল আর বলছিল আমিও বিদেশ যেতে চাই। অবশেষে উপস্থিত লোকজনসহ নিয়ে যাওয়া হলো মতিঝিল থানায়। পপি আক্তারের সাথে কথা বলে জানা গেল, তিনিও যেতে চান সৌদি আরবে। গাজীপুরে দীর্ঘ দিন গার্মেন্টস শ্রমিক হিসেবে কাজ করেছেন। বৃদ্ধ মায়ের সংসারে একটু সচ্ছলতার আশায় বিদেশে ‘অজানা সুখ’ ধরতে পাড়ি দিতে চান তিনি। এজন্য তিনিও দিয়েছেন ২০ হাজার টাকা। আর এই টাকা দিয়েছেন তার প্রতিবেশী চাচাত ভাই সাগর নামের একজনকে। তিনি আরও বলেন, আমার এই মোবাইল দিয়ে বাড়িতে কথা বলত হাজেরা। ওকে (হাজেরা) দেখে রাখার জন্য আমাকে বলা হয়েছিল। থানায় বসে উপস্থিত দু’জনেই জানালেন দারুসসালাম নামক একটি ভাড়া বাড়িতে তাদের রাখা হয়েছিল। যেখানে আরও বিশ জনের মতো নারী কর্মীকে বিদেশে পাঠানোর জন্য আনা হয়েছে। তবে যারা বিদেশে যেতে চায় না তাদের বাড়িও যেতে দিচ্ছে না। তাদের ভাষ্য মতে, বিশ জনের বেশি মেয়েকে আটকে রাখা হয়েছে। কারা আটকে রেখেছে এমন প্রশ্নে জানা যায় সাগর ও আজিজ নামের দুই দালালের কথা। হাজেরা বেগম দারুস সালামের কোন বাসায় রাখা হয়েছিল তার কিছুই জানে না। তবে পপি আক্তার বাসার ঠিকানা বলতে না পারলেও সাথে গেলে চিনিয়ে দিতে পারবেন বলে জানান। পুলিশের প্রশ্নের এক ফাঁকে পপি আক্তার মোবাইল করলেন তার প্রতিবেশী চাচাত ভাইকে। তিনি শুধু বললেন, পুলিশী ঝামেলায় আমি নাই। দেখি কি করা যায় বলে ফোন কেটে দিলেন। উপস্থিত কতিপয় ব্যক্তি জানালেন, এই চাচাত ভাই খ্যাত দালালদের ধরলে জানা যাবে মেয়েদের কোথায় পাঠায় আর আটকেই বা রাখছে কেন? মতিঝিল থানায় কথা হলো হাজেরা বেগমের ছোট ভাই হারুন অর রশিদের সাথে। যিনি টেকনাফ থেকে মঙ্গলবার সকালে ঢাকা এসে নামেন বড় বোনকে বাড়ি নিয়ে যাবেন বলে। কোথায় যাবেন তিনি তা না জেনেই ছুটে এসেছেন রাজধানীতে। যদিও তার হাতে ঠিকানা বলতে একটি মোবাইল নম্বর। শ্যামলীর একটি গাড়িতে ঢাকা আসেন তিনি। শ্যামলী পরিবহনের সুপারভাইজার শত অনুরোধে হারুন অর রশিদকে নিয়ে যান দারুসসালাম। সেখানে গিয়ে ফোন দিলে রাস্তার কাছাকাছি আসেন হাজেরা বেগম ও সঙ্গে আসেন পপি আক্তার। একটি চক্রের ফাঁদে পড়েছে এমন একটি বিষয় আঁচ করতে পেরে কৌশলে নতুন কাপড় কিনে দেয়ার কথা বলে দুই মেয়েকে নিয়ে চলে আসেন প্রথমে ফার্মগেট। পরে আরেক গাড়িতে করে দৈনিক বাংলার মোড়ে। সেখানে বেরিয়ে আসতে থাকে থলের বিড়াল। অবশেষে অনেক তর্ক এবং লোক সমাগমের পর থানা। ভয়ার্ত কণ্ঠে থানায় কথা বলছিলেন হাজেরা বেগম। তিনি বলেন, ‘আমি বিদেশ যামু না, আমি বাড়ি যেতে চাই। আর আমারে আটকাইয়া রাখছে।’ আর পপি আক্তার কেঁদে কেঁদে বলছিলেন, ‘স্যার আমার কোন দোষ নাই, আমি গরিব মাইনশের মাইয়া। আমারে ওরে দেইখা রাখতে কইসে। তা না হলে আমাকে বিদেশ পাঠাইতে দেরি করবো।’ মতিঝিল থানার কর্তব্যরত কর্মকর্তা এস আই নিশাত জাহান জানালেন, বিষয়টি আপনারা যারা নিয়ে এসেছেন সবার কাছে শুনলাম, ওদের মুখেও শুনলাম। আসলে বিদেশের নারীকর্মী পাঠাতে অনেকেই মেয়েদের একত্রে করে রাখে। কেননা মেয়েদের পাঠালে পুরুষদের ভিসা পাওয়া যায়। আর সেই ভিসা থেকেই একটু বেশি আয় করতে চায় জড়িতরা। একজন মেয়েকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। আর অন্যজনের নামে অভিযোগ থাকায় অভিভাবককে আসতে বলা হয়েছে। পরবর্তীতে পদক্ষেপ নেয়া হবে। দারুসসালাম থানা এলাকায় আটকে থাকা নারীদের বিষয়ে তিনি বলেন, আসলে আটক নয়, সবাই ইচ্ছায় যেতে চায়। এরজন্য কিছু কাগজপত্র তৈরি কিংবা আনুষঙ্গিক ব্যয় বাবদ কিছু টাকা নেয়। অনেক সময় আমরা এজেন্সির অভিযোগও পাই। তবুও খোঁজ নিচ্ছি বিষয়টি। এদিকে, দারুসসালাম থানায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তাদের কাছে মেয়ে আটকে রাখার মতো কোন তথ্য নেই। অভিযোগ পেলে বিষয়টি দেখবে। এদিকে, খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সৌদি আরবে নারী কর্মী যেতে কোন টাকারই প্রয়োজন পড়ে না। অথচ এ সকল মেয়েকে একত্র করে একটি চক্র টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। একই সাথে আরও জানা গেছে, সৌদি আরবে নারী কর্মীর সঙ্গে স্বামী বা নিকটাত্মীয় পুরুষ গৃহকর্মী নিয়োগের প্রস্তাব স্থগিত ঘোষণা করেছে দেশটির শ্রম ও সমাজকল্যাণ বিষয়ক মন্ত্রণালয়। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এ গত বছরের শুরুর দিকে এ প্রস্তাব দিলে ওই সময় সৌদি কর্তৃপক্ষ প্রস্তাবটি বাস্তবায়ন করার আশ্বাস দিয়েছিল। এখন তারা সেখান থেকে সরে এসেছে। সৌদি কর্তৃপক্ষ উল্টো জানিয়েছে, পুরুষ কর্মীর ভিসা পেতে হলে ২৫ ভাগ নারী কর্মী পাঠাতে হবে। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে সৌদি আরবে বিভিন্ন সময় নারী কর্মীদের ওপর নানাভাবে নির্যাতনের খবর প্রকাশ হওয়ার পর থেকে দেশটিতে নারী কর্মীর যাওয়া অনেকটাই কমে যায়। গত বছরের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দেড় লাখেরও বেশি পুরুষ কর্মী সৌদিতে চাকরি নিয়ে গেছেন। মন্ত্রণালয় প্রস্তাবে নারী কর্মীদের সুরক্ষার জন্য তাদের সঙ্গে স্বামী বা নিকটাত্মীয় পুরুষ কর্মী নিয়োগ করতে অনুরোধ জানিয়েছিল। তখন তারা এ প্রস্তাব মেনেও নিয়েছিল। তবে বছরের শেষের দিকে এসে নারী গৃহকর্মী নিয়োগের ক্ষেত্রে আর পুরুষ কর্মী নিয়োগ দিচ্ছে না দেশটি। বিষয়টি নিয়ে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সৌদি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কয়েক দফা আলোচনা করেছে। কিন্তু এখন সৌদি কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে ইতিবাচক সাড়া দেয়নি। সৌদিতে নারী কর্মী নিয়োগের বিষয়ে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, কেউ যদি যেতে চায় তার কোন টাকাই লাগবে না। আর জোর করে কাউকে পাঠানোর প্রশ্নই আসে না। জোর-জবরদস্তির বিষয় হলে বুঝতে হবে সে প্রতারকের পাল্লায় পড়েছে। সন্ধ্যার দিকে মুঠোফোনে খোঁজ নিয়ে জানা গেল, থানা থেকে বেরিয়ে ছোট ভাই তার বোনকে নিয়ে বাস কাউন্টারে অপেক্ষা করছে। সুখ খুঁজতে বিদেশে না গিয়ে বাড়ির পথের যাত্রী হয়েছে হাজেরা বেগম। আর পপি আক্তার থানায় বসে অপেক্ষা করছে অভিভাবকের জন্য। দুই মেয়ের দুটি গতিপথ জানা গেলেও অন্য আরও বিশের অধিক মেয়ের বিষয়ে জানা যায়নি। তারা আদৌ কি একেক জন হাজেরার মতো বাড়ি ফেরার পথ চেয়ে বন্দী নাকি অজানা সুখের খোঁজে মত্ত তারা?
×