ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

স্কুলছাত্র বিভোর হত্যাকারী এখন কারাগারে বন্দী

সিনেমার কাহিনীকেও হার মানায় আল আমিনের খুনী হয়ে ওঠার গল্প

প্রকাশিত: ০৫:৪৬, ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

সিনেমার কাহিনীকেও হার মানায় আল আমিনের খুনী হয়ে ওঠার গল্প

গাফফার খান চৌধুরী ॥ যাত্রাবাড়ীতে স্কুলছাত্র রেদোয়ান ইসলাম বিভোরের হত্যাকারী আল আমিনের খুনী হয়ে ওঠার গল্প সিনেমার কল্পকাহিনীকেও হার মানিয়েছে। পাড়ার আট-দশটা বালকের মতোই ছিল আল আমিনের স্বাভাবিক জীবন। খেলাধুলা আর হৈ-হুল্লোড় করে সময় কেটে যেতে। কিন্তু বছর পনেরো আগে মা পরকীয়ার টানে ঘর ছাড়ে। পিতা, সৎমা আর সৎ ভাইবোনেদের মানসিক নির্যাতনে ধীরে ধীরে বেপরোয়া হয়ে ওঠে নম্র-ভদ্র আল আমিন। শেষ পর্যন্ত পারিবারিক যন্ত্রণা সইতে না পেরে আল আমিন মনের জ্বালা ভুলে থাকতে মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে। মাদকের টাকা যোগাতে ছিনতাই শুরু করে। তাতেও চাহিদা মেটাতে ব্যর্থ হলে চাঁদাবাজি করতে থাকে। পাশের বাড়ির এক ব্যবসায়ীর কাছে চাঁদা দাবি করে। টাকা না দিলে ক্ষিপ্ত হয়ে ওই ব্যবসায়ীর স্কুলপড়ুয়া একমাত্র ছেলেকে দিন-দুপুরে বাসার সামনে নৃশংসভাবে হত্যা করে। এরপর রীতিমতো বড় মাপের খুনী হিসেবে পরিচিতি পেয়ে যায়। আল আমিনের জীবন এখন অন্ধকার কারাগারের চার দেয়ালে বন্দী। অনুসন্ধানে মিলেছে এমন তথ্য। গত ৩০ জানুয়ারি সোমবার বিকেল চারটার দিকে যাত্রাবাড়ী থানার গোলাপবাগের ৬০/সি নম্বর নিজ বাসার সামনে স্থানীয় বাসিন্দা আল আমিন (২৪) নৃশংসভাবে ছুরিকাঘাতে রেদোয়ান ইসলাম বিভোরকে (১১) হত্যা করে। বিভোর নারিন্দা সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র ছিল। ঘটনাটি ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে। হত্যায় দায় স্বীকার করার পর আল আমিনকে কারাগারে পাঠিয়েছে আদালত। অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে আল আমিনের খুনী হওয়ার নেপথ্য কাহিনী। স্থানীয়রা জানান, আল আমিনের পিতার নাম আব্দুল মান্নান মুন্সী। তিনি সেখানকার স্থায়ী বাসিন্দা। এলাকায় প্রভাব-প্রতিপত্তি আছে। নিজের বাড়ি ছাড়াও বেশ কয়েকটি জমির মালিক তিনি। এর মধ্যে একটি জমি নিহত বিভোরের পিতা পরিবহন ব্যবসায়ী নজরুল ইসলাম বাবুর কাছে বিক্রি করেন। ওই জমি বিক্রির সূত্র ধরেই আল আমিনের পিতার সঙ্গে বিভোরের পিতার দ্বন্দ্ব। পরবর্তীতে তা পারিবারিক দ্বন্দ্বে পরিণত হয়। আল আমিনের পিতা মাদকের সঙ্গে জড়িত। তিনি মাদক সেবন করতেন। বিয়ে করানোর পর ছেলে ভাল হয়ে যাবে, এমন আশায় আব্দুল মান্নানকে বিয়ে দেন। বিয়ে হয় আল আমিনের মা আছিয়া বেগমের সঙ্গে। বিয়ের পর বছর দুয়েক মোটামুটি ভালই চলছিল। কিন্তু আব্দুল মান্নানের মাদক সেবনের বিষয়টি দিন দিন প্রকাশ পেতে থাকে। সংসারে নেমে আসে অশান্তি। ততদিনে অনেক সময় গড়িয়ে গেছে। তিন মেয়ে ও এক ছেলের জন্ম হয়েছে। সবার ছোট আল আমিন। ছেলেমেয়ের জন্য হলেও আব্দুল মান্নানকে মাদকের পথ ছেড়ে দিতে বলেন তার স্ত্রী। কিন্তু আব্দুল মান্নান মাদকের পথ ছাড়তে পারেননি। উপরন্তু স্ত্রীকে মাদক ব্যবসা করতে বাধ্য করান। সন্তানদের মুখের দিকে তাকিয়ে, সংসার টিকিয়ে রাখতে স্ত্রী মাদক ব্যবসায় নামেন। প্রথমে গাঁজা বিক্রি করতেন। এরপর আস্তে আস্তে ফেনসিডিল বিক্রি শুরু করেন। যাত্রাবাড়ীর একজনের কাছ থেকে ফেনসিডিল এনে বাসায়ই বিক্রি করতেন। মাদক বিক্রির সূত্র ধরে যাত্রাবাড়ীর ওই যুবক ব্যবসায়ীর সঙ্গে আছিয়া বেগমের প্রেমের সম্পর্ক হয়। বেশ কয়েক বছর প্রেম চলে তাদের মধ্যে। ওই মাদক ব্যবসায়ী বয়সে আছিয়া বেগমের চেয়ে অন্তত দশ বছরের ছোট। এদিকে, আল আমিনের পিতাও পরকীয়ায় জড়িয়ে এক নারীকে বিয়ে করেন। স্বামীর দ্বিতীয় বিয়ে আর স্ত্রীর পরকীয়ার সূত্র ধরে সংসারে চরম অশান্তি নেমে আসে। দ্বিতীয় স্ত্রীকে ঘরে তোলার পর অশান্তি যেন স্থায়ীভাবে আসন পেতে বসে। এমন পরিস্থিতিতে প্রথম স্ত্রী পরকীয়া প্রেমিকের হাত ধরে ঘর ছাড়েন। তা প্রায় পনেরো বছর আগের কথা। আল আমিনের বয়স তখন এগারো বছর। মা পরপুরুষের হাত ধরে বগুড়ায় গিয়ে ফেনসিডিলের ব্যবসা শুরু করেন। অন্য ছেলেমেয়েদের মতোই আল আমিন নিয়মিত স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছে। এরপর মা চলে যাওয়ার পর আল আমিনের জীবনে নেমে আসে করুণ পরিণতি। ঘরে সৎমায়ের বকুনি, সৎ ভাইবোনের মারধর, ঝগড়া-বিবাদ আল আমিনের মনকে একেবারে বিষণœ করে তোলে। নীড়হারা পাখির মতো আল আমিন পাড়ার এখানে সেখানে ঘুরে বেড়াতে থাকে। এক সময় স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। কোনদিন একবেলা খেতে পায় তো আরেক বেলা খাবার জোটে না। উঠতে বসতে সৎমায়ের বকুনিতে জীবন একেবারে অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে। এভাবেই আল আমিন বেড়ে উঠতে থাকে। মনের দুঃখে আল আমিন প্রায়ই ঘরে ফিরত না। আস্তে আস্তে পাড়ার আজেবাজে ছেলেদের সঙ্গে মিশতে থাকে। বেশিরভাগ সময় বাড়ির কাছেই কমলাপুর রেলবস্তিতে সময় কাটাত। প্রথমে বিড়ি-সিগারেট, এরপর আস্তে আস্তে গাঁজা, ফেনসিডিল, প্যাথেড্রিন, হেরোইন ও সর্বশেষ ইয়াবার নেশায় আসক্ত হয়ে পড়ে। নেশার টাকা যোগাড় করতে বেছে নেয় ছিনতাইয়ের পথ। এলাকার অনেকেই তার কবলে পড়ে টাকা-পয়সা খুইয়েছেন। এজন্য তার পিতা তাকে কোনদিনই কিছু বলেননি। সর্বশেষ গত বছরের ২৮ ডিসেম্বর স্থানীয় বাসিন্দা হকার রাজুকে আল আমিন সাইকেল কিনে দেয়ার কথা বলে একটি গলিতে ডেকে নেয়। সেখানে যাওয়ার পর রাজুর মাথায় ইট দিয়ে আঘাত করে। রাজু অচেতন হয়ে পড়লে তার পকেটে থাকা দশ টাকার নোটের দুটি বান্ডিল নিয়ে পালিয়ে যায়। ওই টাকায় কয়েক দিন জমিয়ে নেশা করে ঘুরে বেড়ায়। টাকা শেষ হওয়ার পর বিভোরের পিতার কাছে টাকা দাবি করে। একদিন দিন-দুপুরে বাসায় গিয়ে টাকা দাবি করে। দিতে রাজি না হওয়ার সূত্র ধরে বিভোরকে দিন-দুপুরে তাদেরই বাসার সামনে নৃশংসভাবে হত্যা করে। স্থানীয়রা বলছেন, আল আমিনের খুনী হওয়ার পেছনে তার পারিবারিক অশান্তি ও পিতা দায়ী। আল আমিনের পাশাপাশি তার পিতারও সর্বোচ্চ শাস্তি হওয়া উচিত। কারণ পিতা হিসেবে আব্দুল মান্নান ব্যর্থ। এলাকায় বহু লোকের কাছ থেকে ছিনতাই করেছে আল আমিন। প্রতিটি ঘটনার পরেই তার পিতার কাছে অভিযোগ দেয়া হয়েছে। প্রতিবারই আল আমিনের পিতা ছেলের পক্ষ নিয়েছেন। আল আমিন ছিনতাই করে না বলে দাবি করেছেন। রাজুর কাছ থেকে টাকা নেয়ার পর স্থানীয়রা আল আমিনের পিতার কাছে অভিযোগ করেন। আল আমিনের পিতা তাকে পুলিশের হাতে তুলে দেবেন বলে স্থানীয়দের আশ্বাস দিয়েছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে ছেলেকে পুলিশের কাছে তুলে দেয়া দূরে থাক, ন্যূনতম শাসন পর্যন্ত করেননি। পিতার এমন কর্মকা-ের কারণে শেষ পর্যন্ত আল আমিন খুনী হিসেবে পরিচিত পেল। এর জন্য দায়ী আল আমিনের পিতা ও তার পরিবার। আল আমিন আট-দশটা ছেলের মতোই নম্র-ভদ্র ছিল। ভাল করে শাসন করলে মানুষের মতো মানুষ না হলেও অন্তত খুনী হতো না।
×