ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

খেলাপী ঋণের বোঝা আমানতকারীদের ঘাড়ে

প্রকাশিত: ০৩:৩৪, ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

খেলাপী ঋণের বোঝা আমানতকারীদের ঘাড়ে

একটি কাগজে দেখলাম এশিয়ায় নাকি ‘খেলাপী ঋণে’ অন্যতম শীর্ষ দেশ বাংলাদেশ। শুধু এই খবর নয়, প্রায় প্রতিদিনই বাংলাদেশের কাগজগুলোতে খেলাপী ঋণের ‘চর্বিতচর্বণ’ তথ্য থাকে। পিলে চমকে যাওয়ার মতো তথ্য! দিনের পর দিন এসব তথ্য ও খবর পাঠ করে মনে অনেক প্রশ্ন জাগে- তবে কী এর কারণ নিহিত বাঙালীর ঐতিহ্যে, তার মনোজগতে? এর উত্তর দেয়ার যোগ্যতা আমার নেই। তবে এ প্রসঙ্গে দুটো ঘটনার উল্লেখ করতে পারি। বেশ কিছুদিন আগে দীনেশ চন্দ্র সেনের ‘বৃহৎ বঙ্গে’ বাঙালীর নানা ঐতিহ্যের কিছু উদাহরণের কথা পড়েছিলাম। এক ভদ্রলোক একজনের কাছ থেকে টাকা ধার/কর্জ নিয়েছে। দেই-দিচ্ছি-দেব করে ঋণী ভদ্রলোক টাকা আর ফেরত দিচ্ছে না। ঋণদাতা মহাজন কেবলই তাগিদ দিয়ে যাচ্ছেন। চূড়ান্ত নোটিস তিনি দিলেন যে, অমুক তারিখের মধ্যে টাকা ফেরত দিতে হবে, নইলে ‘খবর’ আছে। ঋণগ্রহীতা বিপদ বুঝে তার ছেলেদের ডেকে বললেন- চিতা সাজা। মহাজন অমুক দিন তাগাদায় আসবে। তোরা বলবি, বাবা মারা গেছেন। এই দেখুন চিতা, বাবার ‘মুখাগ্নি’ হবে। ঋণদাতা মহাজন আসার পর ছেলেরা বলল, বাবা মারা গেছেন। মহাজন চিতায় গিয়ে দেখেন সত্যি সত্যি ঋণগ্রহীতা ‘মুখাগ্নি’র অপেক্ষায়। মহাজনের সন্দেহ হওয়ায় একটু উঁকিঝুঁকি দিয়ে দেখলেন, না ভদ্রলোক দিব্যি জীবিত আছে। মরার ভান করে শুয়ে আছে। মহাজন ছেলেদের ডেকে বললেন, আমার টাকার দরকার নেই, চিতা তুলে ফেল। যিনি ঋণ পরিশোধ না করার জন্য চিতায় পর্যন্ত যেতে রাজি, তার টাকা আমি মাফ করে দিলাম। ঋণী বাঙালী হাঁফ ছেড়ে বাঁচল, ঋণ পরিশোধ করতে হলো না। আমি এই কাহিনী পড়ার পর মনে মনে কতবার যে হেসেছি তার হিসাব নেই। বহু বন্ধুকে বলেছি এই গল্পের কথা। এবং বাঙালীর আরেকটি বিশ্বাসের সঙ্গে মিলিয়েছি। ছোটবেলার অভিজ্ঞতা, এখনও হয়ত আছে। দোকানে দোকানে গ্লাসের ফ্রেমে লেখা ‘আজ নগদ, কাল বাকি; বাকির নাম ফাঁকি’। একটু বয়স্ক যারা তাদের কেউ এই আপ্তবাক্য দেখেনি? এই যে ‘আজ নগদ কাল বাকি, বাকির নাম ফাঁকি’র কথা দোকানে দোকানে ছবির ফ্রেমের মতো ফ্রেমে বাঁধানো তার সঙ্গে কী চিতার বাঙালীর মিল নেই? আলবত মিল আছে। বাঙালী ঋণ, ক্রেডিট, ধার-দেনা ইত্যাদি সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা পোষণ করে। তাই সাধারণভাবে কেউ কাউকে ধার দিতে চায় না। ‘ট্রেড-ক্রেডিট’ বলে একটা ব্যবসায়িক প্রথা চালু ছিল গ্রামে গ্রামে। সেই ব্যবস্থাও ঝুঁকির মধ্যে। ব্যবসা ক্ষেত্রে দুই বাঙালী ‘পার্টনারশিপ’ও পছন্দ করে না বলে মুখে মুখে শুনেছি। উপরোক্ত মনোজগতের বাঙালী ধীরে ধীরে ব্যবসা-বাণিজ্যে এগিয়ে চলেছে। সে এখন আন্তর্জাতিক বাণিজ্যও করছে। আর এই বাঙালীর জন্যই ব্যাংকাররা ‘ঋণের ব্যবসা’ করছে। কঠিন কাজ একটি। কেউ টাকা নিয়ে টাকা ফেরত দিতে চায় না। আর ব্যাংকের টাকাকে তো অনেক ঋণগ্রহীতা মনে করে তাদের নিজেদের টাকা। একবার নিতে পারলেই হলো। তারপর দেয়ার আর নাম নেই। যদি তা না হতো তাহলে ঋণখেলাপী সমস্যায় আমরা শীর্ষ স্থানে থাকব কেন? বিশ্বব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও ভারত আমাদের দলে। এশিয়ার অন্যান্য দেশের অবস্থা আমাদের চেয়ে অনেক ভাল। তবে কী আফগানিস্তান, পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও ভারত একই ঐতিহ্যের মধ্যে পড়ে- ঋণের টাকা ফেরত দেব না; আজ নগদ কাল বাকি! এটা এক বিশাল সমস্যায় পরিণত হয়েছে। যে বাঙালী ‘টাকা মাটি মাটি টাকার’ এই বিশ্বাস নিয়ে মানুষ হয়েছে, আউল-বাউল কমিউনিস্ট বাঙালী ‘এন্টি-মানি’ হয়েছে সেই বাঙালী টাকার মুখ দেখে এখন এমন হয়েছে যে, টাকা দেখলেই সে নিজের পকেটে ঢুকাতে চায়। আর ব্যাংকের টাকা হলে তো কথাই নেই। এই মনোজাগতিক সমস্যার জন্য আমার ধারণা- দিন দিন ঋণখেলাপী সমস্যা জটিল হচ্ছে! তার হয়ত আরও অনেক কারণ আছে, এসবে আমি আজ আর যাব না। আমি যাব ক্যান্সারসম ঋণখেলাপী সমস্যার বোঝা কে বহন করে তার আলোচনায়। স্পষ্টতই এই বোঝা বহন করে আমানতকারীরা (ডিপোজিটররা)। আমানতকারী ছাড়া ব্যাংক হয় না। বহুকাল আগে ব্যাংকিং শুরু হয়েছিল ‘লেন্ডিং’ দিয়ে। আমানতের বালাই ছিল না। ধনাঢ্য ব্যক্তিরা, মহাজনরা নিজের ধন দিয়ে ব্যাংকিং ব্যবসা করত। ‘গচ্চা’ গেলে তার নিজের যেত। সেই অবস্থা এখন আর নেই। এখন ‘আমানত’ আগে, ‘ঋণ’ পরে। মালিকদের টাকা নয়, আমানতকারীদের টাকাই ব্যাংকের ভিত্তি। তারাই মূল লোক। তাদের টাকাতেই ব্যাংকের ব্যবসা- পরের ধনে ‘পোদ্দারি’। অথচ দেখা যাচ্ছে আজকালকার ব্যাংকার-কর্মচারীরা এবং ব্যাংকের মালিকরা সেই সোনার হাঁসকে ধীরে ধীরে মেরে ফেলছে। ভাবা যায়, ব্যাংক এখন আমানতকারীদের কোন সুদ দেয় না। মূল্যস্ফীতির যে হার তার চেয়ে কম হচ্ছে আমানতের ওপর সুদের হার। আজ থেকে তিন-চার বছর আগেও আমানতে ১২-১৩ শতাংশ সুদ পাওয়া যেত। এখন তা ৫ শতাংশে নেমেছে। কেবল ২০১৬ সালেই আমানতের ওপর প্রদত্ত সুদের গড় হার এক শতাংশ কমেছে এবং এই প্রবণতা অব্যাহত। কারণ কী? বিশাল বিশাল ব্যাংকাররা, বিশাল বিশাল বেতনের নির্বাহী, প্রধান নির্বাহীরা জানেন না কী করে দক্ষতা বাড়াতে হয়, জানেন না কী করে অপচয় রোধ করতে হয়, জানেন না কী করে খেলাপী ঋণ কমাতে হয়, টাকা কীভাবে আদায় করতে হয়, কাস্টমার কীভাবে চিহ্নিত করতে হয়। ৫৭-৫৮ ব্যাংক বিনা প্রয়োজনে অসুস্থ প্রতিযোগিতায়। খেলাপী ঋণ তৈরিতে ব্যস্ত। মালিকদের ‘সেবা’ করতে করতে ব্যাংকাররা যে ঋণখেলাপীর সংখ্যা বাড়াচ্ছেন, খেলাপী ঋণের পরিমাণ বাড়াচ্ছেন তার দিকে তাদের কোন খেয়াল নেই। খেয়ালের প্রয়োজন নেই। কারণ, বলির পাঁঠা হিসেবে রয়েছে আমানতকারীরা, যারা সংগঠিত নয়। আশার কথা কেন্দ্রীয় ব্যাংক দেখলাম সজাগ হয়েছে। গবর্নর ফজলে কবীরের কিছু বক্তব্য কাগজে পড়লাম। তিনি বলেছেন, ঋণের ওপর সুদের হার সে হারে কমছে না যে হারে কমছে আমানতের ওপর সুদের হার। তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। বলেছেন আমানতের ওপর সুদের হার মূল্যস্ফীতির হারের নিচে চলে গেছে। এটা অশনি সংকেত। এতে মানুষের সঞ্চয়ের অভ্যাস কমবে। এক সময় ব্যাংকিং খাত এর জন্য ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আমানতের ওপর ন্যায্য সুদ না পেয়ে মানুষের ভোগপ্রবণতা বাড়ছে। বাড়ছে ‘আনপ্রোডাকটিভ’ খরচ। ব্যাংকারদের তিনি সাবধান করে দিয়েছেন। বলেছেন, এটা চলবে না। খেলাপী ঋণ আদায় করুন, খরচ কমান, বাহুল্য হ্রাস করুন। দক্ষতা বাড়ান। অহেতুক আমানতকারীদের ওপর চড়াও হবেন না। গবর্নর ফজলে কবীরকে ধন্যবাদ, অসংখ্য ধন্যবাদ। কারণ তার সাবধানী বাণীটি যথাযথ সময়ে উচ্চারিত হয়েছে। আমানতের ওপর সুদের হার কমে যাওয়াতে সাধারণ সঞ্চয়কারী, মধ্যবিত্ত, চাকরিজীবী, অবসরভোগী, মুক্তিযোদ্ধা, বেওয়া-বিধবা, রেমিটেন্স প্রাপকরা ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। এদের ওপর সকল বোঝা চাপিয়ে দিয়ে ব্যাংকাররা বাহবা নিচ্ছেন। তারা ব্যাংকের মুনাফা বৃদ্ধি করছেন। অথচ লাখো কোটি আমানতকারীর আয় এক-তৃতীয়াংশে পৌঁছেছে। এতে ভোগ হ্রাস পাচ্ছে। অথচ ভোগ বৃদ্ধি না পেলে ‘জিডিপি’ প্রবৃদ্ধির হার অর্জন সম্ভব হবে না। এই প্রেক্ষাপটেই বাংলাদেশ ব্যাংক যথাসময়ে সাবধান বাণী উচ্চারণ করেছে। আরও দুঃখের কথা, ব্যাংকগুলো আমানতকারীদের ঠকিয়ে মুনাফা অর্জন করছে একদিকে, অন্যদিকে বেসরকারী ও সরকারী ব্যাংকের সেবার মান হ্রাস পাচ্ছে। বাড়ছে বহু ব্যাংকের বিরুদ্ধে অভিযোগ। কাগজে দেখলাম (৮.২.১৭) গ্রাহক হয়রানিতে ১০টি ব্যাংক শীর্ষে। এই দশটি ব্যাংক হচ্ছে- সোনালী, ব্র্যাক, অগ্রণী, ইসলামী, জনতা, ডাচ্-বাংলা, কৃষি ব্যাংক, পূবালী, রূপালী ও ইস্টার্ন। আগে জানতাম সেবা দেয় বেসরকারী ব্যাংক আর হয়রানি করে সরকারী ব্যাংক। এখন হয়রানির শীর্ষে দেখা যাচ্ছে ৫টি বেসরকারী ব্যাংকও। এর মধ্যে ব্র্যাক ব্যাংকও রয়েছে, যার প্রাণপুরুষ বিশ্ববিখ্যাত লোক। এটা কেমন হলো? যিনি সারা বিশ্বে আদৃত তার ব্যাংকে গ্রাহক হয়রানি, তার ব্যাংকে কেউ চাকরি করতে চায় না। এটা বোধ হয় বাঙালীর কপাল। বিশ্বে আদৃত, দেশে ব্যর্থ। এছাড়া আর কী বলব? ইসলামী ব্যাংক, ডাচ্-বাংলা, ইস্টার্ন ব্যাংকের কত সুনাম শুনি বাজারে। এখন দেখা যাচ্ছে তাদের মধ্যেও গলদ। ব্যাংকের পর ব্যাংক হচ্ছে দেশে। দুইদিন পরে হয়ত প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো ঘরে ঘরে ব্যাংক হবে। এতে তো আশা ছিল প্রতিযোগিতা হবে, সেবার মান বাড়বে। গ্রাহক হয়রানি কমবে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে ঘটনা, বিদ্যমান বাস্তবতা উল্টো। প্রকৃতপক্ষে ব্যাংক কর্মকর্তারা গ্রাহকদের পেয়ে বসেছে। কোন কোন ব্যাংক আছে অসুস্থ গ্রাহকদের বসার পর্যন্ত জায়গা নেই। ‘সিনিয়র সিটিজেনদের’ দেখার মতো ব্যবস্থাই নেই। বলা হচ্ছে ব্যাংকের বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ‘সেলে’ অভিযোগ করা যায়। অভিযোগ তো অনেক আছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সেবার বিরুদ্ধেও। অতএব করণীয় হচ্ছে আলাদা কর্তৃপক্ষ গঠন করা যারা নিরপেক্ষভাবে ‘ভোক্তা অধিকার’ দেখবে। প্রতিবেশী দেশে এটা আছে। এখানে করতে কোন বাধা দেখি না। ভোক্তাপণ্যের ক্ষেত্রে ভোক্তা অধিকার কর্তৃপক্ষ আছে বলে জানি। সেখানে কী ব্যাংকের সেবা ‘কভার’ করা আছে? মনে হয় না। এমতাবস্থায় বিষয়টি নিয়ে নতুনভাবে ভাবা যায়। লেখক : সাবেক শিক্ষক, ঢাবি
×