ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

আমানত ও ঋণের সুদ

প্রকাশিত: ০৩:৩৩, ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

আমানত ও ঋণের সুদ

ব্যাংকের ঋণ ও আমানতের সুদ হারের ব্যবধান বা স্প্রেড আবারও বাড়ছে। সার্বিকভাবে আমানতের সুদের পাশাপাশি ঋণের সুদহার কমতে থাকায় ব্যাংকিং খাতে গত বছরের শেষে গড় ব্যবধান দাঁড়িয়েছে চার দশমিক একষট্টি শতাংশ। ঋণের ওপর সুদের সর্বোচ্চ হার ছিল তেরো শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংক এই সিলিং তুলে নেয়ার পর ব্যাংকগুলো এখন ইচ্ছেমতো সুদের হার নির্ধারণ করতে পারছে। বাংলাদেশ ব্যাংক অবশ্য সব ধরনের ঋণের ওপর প্রযোজ্য সুদের হারের সর্বোচ্চ সিলিং তুলে নেয়নি। রফতানি ঋণ, কৃষি ঋণ, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র আমদানির জন্য ঋণ ইত্যাদির ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সিলিং প্রযোজ্য রয়েছে। নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হয়েছে ব্যবসায়ী ঋণের ওপর থেকে। যাকে বলা যায় ‘ট্রেড ফিন্যান্সিং। অবশ্য অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এই সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে অর্থাৎ ঋণের ওপর সুদের হার কমানো আমানতের ওপর সুদের হারের কী হবে। ঋণ খাতে সুদ বাবদ যে ক্ষতি হবে, তা পুষিয়ে নেয়ার হাতিয়ার ব্যাংকের হাতে দুটো। হয় তারা দক্ষতা বৃদ্ধি করে তা পুষিয়ে নেবেন, নতুবা আমানতের ওপর সুদের হার কমিয়ে তা পুষিয়ে নেবে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক যা ভাবেনি তা হচ্ছে ঋণের মূল্য কমানোর ফলে সে ঋণের অপব্যবহার হতে পারে। ঋণের টাকা ‘ডাইভার্ট’ হতে পারে। তা রোধের কোন পদক্ষেপ নেই। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো যথেচ্ছ ব্যবহার করেছে ঋণ প্রদান ক্ষেত্রে। বিপরীতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মনিটরিং হয়েছে কম। কেন্দ্রীয় ব্যাংক যখন ঋণের ওপর সুদ কমায়, তখন ব্যাংকগুলোর দক্ষতা বৃদ্ধির দিকে ধাবিত হওয়া সঙ্গত ছিল। প্রশাসনিক ব্যয় হ্রাস, অপচয় রোধ, অপচয় হ্রাস, ফান্ড ম্যানেজমেন্টে দক্ষতা আনয়ন, শ্রেণী বিন্যাসিত ঋণ আদায় ইত্যাদি মারফত ব্যাংকগুলো তাদের সুদ-আসল পুষিয়ে নিতে পারে। তবে তারা সেই পথে ধাবিত হয়নি। ব্যাংকগুলো বরং খোলাবাজারী প্রতিযোগিতার নীতি বিসর্জন দিয়ে দলবদ্ধ হয়ে সিন্ডিকেট তৈরি করে আমানতের ওপর সুদের হার হ্রাস করে। এই হ্রাসের হার ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণের ওপর সুদের হার কমায় ভাল উদ্দেশ্য নিয়ে কিন্তু ব্যাংক সেই উদ্যোগটিকে নস্যাত করে দিয়ে আমানতকারীদের পথে বসায় অথচ ঋণখেলাপী সংস্কৃতি বহাল তবিয়তে রয়ে গেল আমানতকারীদের আয়ের ওপর আঘাতই হানা হয়। দেখা যায় ঋণের সম্প্রসারণ ঘটে মাত্রার বাইরে, বিপরীতে আমানত সেভাবে বাড়েনি। অর্থাৎ ঋণ ও আমানতের অনুপাত বাংলাদেশ ব্যাংকের সীমার বাইরে চলে যায়। পাশাপাশি মনিটরিংয়ের অভাবে ঋণের টাকা চলে গেল ‘ডাইভার্টেড’ হয়ে ‘ক্যাপিটেল মার্কেটে’। ফল দাঁড়াল অবাক করার মতো মূল্যস্ফীতি শেয়ারবাজারে ধস। এ অবস্থা সামলাতে বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণ সঙ্কোচনের নীতি গ্রহণ করে নির্দেশ দেয় এখন থেকে পাঁচ শতাংশের পরিবর্তে ছয় শতাংশ নগদ টাকা আমানত রাখতে হবে ব্যাংকে। ব্যাংকে এমনিতেই আমানত বৃদ্ধি ঘটেছে কম হারে। আগের মতো টাকা নতুন আমানত হিসেবে আসেনি। গ্রাহক মেয়াদী আমানতের পরিবর্তে তলবী আমানতের দিকে ঝুঁকে পড়ে। অর্থাৎ অধিকতর লাভের জন্য শেয়ারবাজার জমি, ফ্ল্যাট, সোনা ইত্যাদিকে অর্থ লগ্নি করে। গ্রাহকরা ব্যাংকের সমস্যার জন্য নগদে টাকা রাখায় আমানতে ভাটা পড়ে। প্রচুর ব্যাংক পড়ে তারল্য সঙ্কটে। পরিস্থিতি এখন এমন, যেসব ব্যাংক এতদিন আমানতকারীকে দরজা থেকে বিদায় করে দিয়েছে তারাই এখন আমানতকারীর পেছনে হন্যে হয়ে দৌড়াচ্ছে। এখানে কোন নীতি-নৈতিকতা নেই যেন। আমানতের বাজার হয়েছে চরম অস্থিতিশীল, এক ব্যাংকের টাকা আরেক ব্যাংক অনৈতিকভাবে উচ্চতর সুদ দিয়ে নিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আপত্তি ধোপে টিকছে না। উচ্চতর সুদ দিয়ে আমানত নিচ্ছে সবাই। তিন বছর আগে আমানতে বিশেষ করে এক বছরী মেয়াদী আমানতে ১২-১৩ শতাংশ সুদ পাওয়া যেত, যেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকে ঋণের ওপর সুদের হার কমল সেই তারা দলবদ্ধ হয়ে আরও বেশি হারে আমানতের ওপর সুদের হার কমিয়ে আট থেকে নয় শতাংশ করে। তারা নিয়ম করে এর বেশি সুদ দিতে পারবে না। অপূর্ব বাজার অর্থনীতি। সিন্ডিকেট করে আমানতের ওপর সুদের হার হ্রাস। এখন দিন এমন বদলেছে যে, ওই ব্যাংকগুলোই আবার সুদ দিচ্ছে ১২ থেকে ১৩ শতাংশ। প্রচার রয়েছে, কোন কোন ব্যাংক আরও বেশি দেয়। বাস্তবতা হচ্ছে ব্যাংক ঋণের ওপর সুদ কমাতে এবং বিপরীতে আমানতের ওপর সুদ বাড়াতে পারে। কিন্তু খেলাপী ঋণ গ্রহীতারা সব সুবিধা পেয়ে ফেলছে। বড় ঋণখেলাপীদের রেয়াত দিতে গিয়ে অন্যের ওপর সুদের হার বাড়াতে হচ্ছে। আর শাস্তি দিতে হচ্ছে আমানতকারীদের। ব্যবসায়ীরা ব্যাংক ঋণ নির্ভরতা কমিয়ে পুঁজিবাজারে যেতে পারে। দেশের সাধারণ মানুষ ব্যাংকে আমানত রাখে অর্থকড়ি মুনাফার আশায় কিন্তু সেই মুনাফার পরিমাণ কম হলে বিপাকে পড়াই স্বাভাবিক। ব্যাংকগুলো জনগণের আমানতের ওপর সুদের হার বাড়ালে সাধারণ মানুষ যেমন উপকৃত হয় তেমনি অর্থ প্রবাহও বাড়ে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে ভুল পথ থেকে সরে এসে সঠিক পন্থায় এগিয়ে যাওয়া উচিত।
×