ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

উত্তরায় কিশোর গ্যাংস্টারের ৩০ গ্রুপ সক্রিয়

আদনান হত্যায় জড়িত ডিসকো বয়েজ ও বিগ বসের ৮ জন আটক

প্রকাশিত: ০৬:০১, ৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

আদনান হত্যায় জড়িত ডিসকো বয়েজ ও বিগ বসের ৮ জন আটক

আজাদ সুলায়মান ॥ রাজধানীর উত্তরায় কিশোর গ্যাং স্টারের প্রথম আত্মপ্রকাশ ঘটে ‘কাঁকড়া’ নামের একটি সংগঠনের মাধ্যমে। এই গ্যাং স্টারের হামলায় এক যুুবক নিহত হওয়ার পর কাঁকড়া নাম বাদ দিয়ে ব্ল্যাকরোজ নামে আত্মপ্রকাশ ঘটে। এরপর এ ধরনের অন্তত ৩০ গ্রুপ গজিয়ে ওঠে। এদেরই দু’গ্রুপের দ্বন্দ্বে প্রাণ হারায় আদনান নামে এক কিশোর। এ হত্যাকা-ে চাঞ্চল্য ছড়িয়ে পড়ে উত্তরাসহ গোটা রাজধানীতে। মঙ্গলবার রাতে এই ৩০ গ্রুপের দুটির ৮ সক্রিয় সদস্য র‌্যাবের আকস্মিক অভিযানে ধরা পড়ে। তাদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে এ ধরনের চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে আসে। আটক ৮ জন আদনান কবীর হত্যার সঙ্গে জড়িত। তারা কথিত ডিসকো বয়েজ ও বিগ বস গ্যাং গ্রুপের। তাদের মধ্যে মামলার এজাহারভুক্ত তিন নম্বর আসামি ও ডিসকো বয়েজ গ্যাং গ্রুপের দলনেতা শাহরিয়ার বিন সাত্তার ওরফে সেতু ওরফে রায়হান আহমেদ সেতু ওরফে ডিসকো সেতু (২২)। এজাহারভুক্ত পাঁচ নম্বর আসামি বিগ বস গ্যাং গ্রুপের দলনেতা আক্তারুজ্জামান ছোটন (১৯)। বাকিরা হলোÑ শাহীনুর রহমান (১৭), রমজান মোবারক (১৭), সেলিম খান (২৩), ইব্রাহীম হোসেন ওরফে সানি (২৮), মিজানুর রহমান সুমন (২২) ও জাহেদুল ইসলাম জুইস (২২)। তাদের কাছ থেকে তিনটি চাকু, দুটি চাপাতি, দুটি রড, তিনটি চেইন, তিনটি স্প্রে কালার বোতল, দুটি স্কুল ব্যাগ ও চার পুরিয়া গাঁজা উদ্ধার করা হয়। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তারা আদনান হত্যায় সম্পৃক্ত ছিল বলে জানিয়েছে। র‌্যাব জানায়, উত্তরায় ও আশপাশের এলাকায় কমপক্ষে ৩০ গ্যাং গ্রুপ রয়েছে। উত্তরার গজিয়ে ওঠা এই ৩০ ছোট-বড় বিভিন্ন গ্যাং গ্রুপের সদস্যরা অধিকাংশই বিত্তবান পরিবারের সদস্য। এদের অন্যতম সক্রিয় গ্রুপ গুলো হলোÑ কাঁকড়া গ্রুপ, জি ইউনিট গ্রুপ, ব্ল্যাকরোজ গ্রুপ, রনো গ্রুপ, কে নাইট গ্রুপ, ফিফটিন গ্রুপ, ডিসকো বয়েস গ্রুপ, নাইন স্টার গ্রুপ, নাইন এম এম বয়েজ গ্রুপ, পোটলা বাবু গ্রুপ, সুজন গ্রুপ, আলতাফ গ্রুপ, ক্যাসল বয়েস গ্রুপ, ভাইপার গ্রুপ। এদের সদস্য ১৭২। এ সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০১৫ সালে এসব গ্যাং সংগঠিত হয়ে বড় আকারে ‘ফিফটিন গ্রুপ’ নামে আত্মপ্রকাশ করে। তারপর অন্তর্কোন্দলের ফলে মূল তিনটি ভাগÑ ডিসকো ও এর সহযোগী (বিগ বস), নাইন স্টার এবং নাইন এমএম গ্রুপ নামে বিভক্ত হয়। গ্যাং গ্রুপ সদস্যরা সবাই উঠতি বয়সী কিশোর-যুবক; এদের কেউ কেউ উত্তরা এলাকায় বিভিন্ন নামীদামী স্কুল-কলেজের ছাত্র। এছাড়াও এলাকার কিছু অছাত্রও এই গ্রুপগুলোর সদস্য রয়েছে। তাদের মধ্যে উচ্চ, মধ্য ও নি¤œবিত্তসহ সব ধরনের পরিবারের সন্তান রয়েছে। মূলত, গ্যাংগুলো এলাকা ভিত্তিক বিস্তার। তাদের মূল কাজ হচ্ছেÑ এলাকার আধিপত্য বিস্তার, স্কুল-কলেজে র‌্যাগিং করা, স্কুল-কলেজের ছাত্রীদের উত্ত্যক্ত করা, মাদক সেবন, ছিনতাই, উচ্চ শব্দ করে মোটরসাইকেল বা গাড়ি চালিয়ে জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি করা, ছিনতাই, অশ্লীল ভিডিও শেয়ার করাসহ এলাকায় ত্রাস সৃষ্টি করা। এরা এলাকার নিরীহ ও মেধাবী যুবক ও কিশোরদের চাপে রেখে জোরপূর্বক দলে আসতে বাধ্য করে। আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে পূর্বে মারামারি বা আঘাত-প্রতিঘাত হতো। গ্যাং ভিত্তিক এদের নিজস্ব লোগো রয়েছে যা দেয়াল লিখন ও ফেসবুকে ব্যবহার করে। এরা ড্রিংকস করা বা সীসা খাওয়ার ছবি ফেসবুকে আপলোড করে। ফেসবুকে এক গ্রুপ অন্য গ্রুপকে হুমকি দিয়ে স্ট্যাটাস দেয় এবং পরস্পরের আইডি হ্যাকের চেষ্টা করে। র‌্যাব জানিয়েছে, আটক ৮ আসামির মধ্যে ডিসকো বয়েজ গ্যাং গ্রুপের প্রধান সেতুসহ দুইজন ও বিগ বস গ্যাং গ্রুপের প্রধান ছোটনসহ ছয়জন রয়েছে। এদের মধ্যে ছোটনের নামে আগে থেকে থানায় মামলা রয়েছে। সেতু বর্তমানে ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটির বিবিএর ছাত্র। তার বাবা এয়ারপোর্টের এক সিএ্যান্ডএফ এজেন্ট। সে উচ্চ-মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। ডিসকো গ্রুপের অপর সদস্য জুইস উত্তরা স্কুল এ্যান্ড কলেজের দশম শ্রেণীর ছাত্র। তার বাবা একজন মুদি দোকানি। বিগ বস গ্রুপের আটককৃতরা নিম্নবিত্ত পরিবারের সদস্য। এর মধ্যে ছোটন ইউনিক এডুকেয়ারের দশম শ্রেণীর ছাত্র, সুমন এসএসসি পাস। আর অন্যদের মধ্যে সানি ইজিবাইক চালক, সেলিম গার্মেন্টসে চাকরি করে, রমজান সাউন্ড সিস্টেম ভাড়া ব্যবসায়ের কর্মচারী আর শাহীন ট্রান্সপোর্টে চাকরি করে। র‌্যাবের গণমাধ্যম শাখার পরিচালক মুফতি মাহমুদ খান সাংবাদিক সম্মেলনে জানান, মঙ্গলবার রাতভর ঢাকা ও আশপাশের বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারকৃতরা কথিত ‘ডিসকো বয়েজ’ ও ‘বিগ বস’ গ্যাংয়ের সদস্য। এদের মধ্যে শাহরিয়ার বিন সাত্তার সেতু ডিসকো বয়েস গ্রুপের ‘গ্যাং লিডার’। এই গ্রুপের গ্রেফতার আরেক সদস্য জুইস উত্তরা স্কুল এ্যান্ড কলেজে দশম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ালেখা করেছে। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে বাকি ছয়জন বিগ বস গ্রুপের সদস্য। বিগ বস গ্রুপের লিডার হচ্ছে আক্তারুজ্জামান ছোটন। ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটিতে বিবিএতে অধ্যায়নরত ছোটনের নামে আগেও একটি মামলা রয়েছে। এই গ্রুপে গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে সুমন এইচএসসি পাস বলে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে র‌্যাবকে বলেছে। গ্রেফতারকৃত অন্যদের স্কুলে যাতায়াত নেই বললেই চলে। তিনি জানান, বিগ বস গ্রুপে ছোটন এবং সুমন দুই ভাই। এরা হকার ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। সানি ইজিবাইক চালক, সেলিম পোশাক কারখানায় চাকরি করে, রমজান সাউন্ড সিস্টেম ভাড়া ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী আর শাহীন পরিবহন সেক্টরে চাকরি করে। ২০০১ সালে উত্তরা এলাকায় গ্যাং কালচার শুরু হয়। সেই সময় কাঁকড়া নামে একটি গ্রুপ তৈরি হয়। তবে ওই গ্রুপটি বেশি দিন টেকেনি। পরে ২০০৯ সালে ডিসকো বয়েস গ্রুপ চালু হয়। মুফুতি মাহমুদ খান বলেন, র‌্যাবের অনুসন্ধানে উত্তরায় আরও দু’ডজন গ্রুপ চালু থাকার তথ্য পাওয়া গেছে। অধিকাংশ গ্রুপের সদস্য সাধারণত স্কুল ড্রপ বালক। এসব গ্রুপে বাইরের সদস্যরা প্রধান হয় এবং তারা প্রভাব বিস্তার করে। আদনান হত্যাকা-ে গ্রেফতারকৃতরা জড়িত ছিল কিনা জানতে চাইলে মুফতি মাহমুদ বলেন, গতরাতে তাদের ধরেছি। বেশি জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারিনি। তবে জুইস ঘটনার সময় ছিল বলে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছে। গত ৬ জানুয়ারি সন্ধ্যায় উত্তরার ১৩ নম্বর সেক্টরের ১৭ নম্বর রোডে ট্রাস্ট স্কুল এ্যান্ড কলেজের অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র আদনান কবীরকে খেলার মাঠে পিটিয়ে এবং কুপিয়ে মারাত্মক আহত করে প্রতিপক্ষ। আহতাবস্থায় তাকে উত্তরার একটি হাসপাতালে নেয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। এ ঘটনায় আদনানের বাবা কবীর হোসেন বাদী হয়ে উত্তরা পশ্চিম থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। এ সম্পর্কে-ডিসকো বয়েস’ গ্রুপের সঙ্গে স্থানীয় ‘নাইন স্টার’ গ্রুপের দ্বন্দ্বে ওই হত্যাকা- হয় বলে ঘটনার পর জানিয়েছিল পুলিশ। পুলিশের মতে, গত বছর ‘নাইন স্টার গ্রুপের’ নেতা ‘তালাচাবি রাজু’ কে ছুরিকাহত করেছিল ‘ডিসকো বয়েজ গ্রুপের’ সদস্যরা। তারপর থেকে তাদের দ্বন্দ্ব চলছিল। আদনান হত্যাকা-ের আগে নিজেদের মধ্যে কয়েক দফা মারামারি হয়। তবে তা গুরুতর না হওয়ায় কেউ বুঝতে পারেনি। এ সম্পর্কে র‌্যাব জানায়, গত ৬ জানুয়ারি ডিসকো গ্রুপ ও বিগ বস গ্রুপ এক হয়ে নাইন স্টার গ্রুপের লিডার ‘তালাচাবি রাজুকে’ আক্রমণ করার পরিকল্পনা করে এবং সেই অনুযায়ী আক্রমণও করে। রাজু ওই সব পালিয়ে যেতে পারলেও আদনান পালাতে পারেননি। তারা তাকে কুপিয়ে পালিয়ে যায়। আদনান নাইন স্টার গ্রুপের সদস্য কিনা জানতে চাইলে মুফতি বলেন, আদনান ওই গ্রুপের সদস্য কিনা তা জানা যায়নি। তবে আদনান রাজুর ঘনিষ্ঠ ছিল। ছেলের মৃত্যুর পর আদনানের বাবা মোঃ কবির হোসেন উত্তরা পশ্চিম থানায় নয়জনের নাম উল্লেখ করার পাশাপাশি অজ্ঞাত পরিচয় আরও ১০-১২ জনকে আসামি করে একটি হত্যা মামলা করেন। আসামিদের সবার বয়স ১৬ থেকে ২২ বছরের মধ্যেয়। হত্যাকা-ের পর পুলিশ ডন ও সাদাফ নামের দু’জনকে গ্রেফতার করে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদও করে।
×