ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

অমর একুশে গ্রন্থমেলা

পুরনো প্রতিষ্ঠানগুলোতে ধ্রুপদী সাহিত্য, ফেলে আসা দিনের স্মৃতি

প্রকাশিত: ০৫:৫৯, ৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

পুরনো প্রতিষ্ঠানগুলোতে ধ্রুপদী সাহিত্য, ফেলে আসা দিনের স্মৃতি

মোরসালিন মিজান ॥ মেলায় ঢুকেই অবাক হতে হয়। কত শত প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান! গুনে শেষ করা যায় না। কিছু প্যাভিলিয়ন ও স্টলের সামনে উপচে পড়া ভিড়। সব সময় বই বিক্রি হয়। এমন রমরমা অবস্থা এক সময় আরও অনেক প্রতিষ্ঠানের ছিল। এখন নেই। দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় বদলে গেছে অনেক কিছু। হারিয়ে গেছে। তবু প্রকাশনার ঐতিহ্য ধরে রেখেছে বহুকালের পুরনো প্রতিষ্ঠানগুলো। নিজেদের স্বর্ণযুগে প্রকাশিত সাহিত্য সম্ভার নিয়ে অংশ নিয়েছে মেলায়। চল্লিশ, পঞ্চাশ, ষাট ও সত্তরের দশকে যাত্রা শুরু করা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান প্রকাশনা শিল্পের আদি ইতিহাস মনে করিয়ে দিচ্ছে। অমর একুশে গ্রন্থমেলার অষ্টম দিনে বুধবার ঘুরে দেখা হলো নওরোজ কিতাবিস্তান, আহমদ পাবলিশিং হাউস, খান ব্রাদার্স এ্যান্ড কোম্পানি, স্টুডেন্ট ওয়েজ, মাওলা ব্রাদার্সের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর স্টল। দেখতে দেখতেই দেখা হয়ে গেলো ফেলে আসা দিন। আরও কত কত কী! সেই চল্লিশের দশকে প্রকাশিত বই এখনও বের হচ্ছে। আজকের বিখ্যাত লেখক কবিদের বই তাদের প্রথম জীবনের সৃষ্টি সম্পর্কে ধারণা দিচ্ছে। সব মিলিয়ে অন্যরকম এক অভিজ্ঞতা। বাংলা বাজারের পুরনো প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলোর অন্যতম নওরোজ কিতাবিস্তান। ৬৮ বছরের পুরনো প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান এখনও সচল। মেলার একেবারে দেখা যায় না এমন একটি জায়গায় স্টল পেয়েছে। অনেক খুঁজে সেটি বের করা সম্ভব হয়। স্টলের সামনে সাজানো আছে সৈয়দ ওয়ালী উল্লাহর কালজয়ী রচনা ‘লাল সালু।’ বইটির পাতা উল্টাতেই দেখা যায়, প্রথম প্রকাশ ১৯৪৯ সাল! এখন পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটি এই প্রকাশনা অব্যাহত রেখেছে। একই লেখকের ‘নয়নচারা’ প্রথম প্রকাশ হয়েছিল ১৯৮৫ সালে। প্রতিষ্ঠানটি একসময় সত্যজিৎ রায়ের প্রচুর বই প্রকাশ করেছে। এখনও বিক্রি হচ্ছে কিংবদন্তি চলচ্চিত্রকারের বই। আহমদ পাবলিশিং হাউস যাত্রা করে ১৯৫৪ সালে। এখনও বই প্রকাশ করছে। অংশ নিচ্ছে মেলায়। এবার স্টল পেয়েছে মুক্তমঞ্চের পাশে। নতুন পুরনো অনেক বই। পুরনোগুলো নিয়েই ছিল বেশি আগ্রহ। প্রতিষ্ঠানটি থেকে এসেছে আবুল মনসুর আহমদের বেশ কয়েকটি বিখ্যাত গ্রন্থ। স্টলে পাওয়া গেল তার বহুল পঠিত রম্যরচনা ‘ফুড কনফারেন্স।’ প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৬৯ সালে। মুনীর চৌধুরীর সারা জাগানো নাটক ‘কবর’ এখনও বিক্রি হচ্ছে। এখান থেকে এটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৩৯০ বঙ্গাব্দে। বেশ কিছু বই আছে আরেক বিখ্যাত লেখক বন্দে আলী মিয়ার। আরও খুঁজতে গিয়ে পাওয়া গেল ১৯৪২ সালের একটি প্রকশনা। গোলাম মোস্তফার লেখা ‘বিশ্বনবী’ প্রথম প্রকাশ হয়েছিল ওই বছরের অক্টোবরে। সেই থেকে এখনও প্রকাশিত হচ্ছে। স্টলের দায়িত্বে থাকা রবিউল হোসেন জানান, পুরনো প্রকাশনাগুলো নিয়ে এখনও দারুণ আগ্রহ দেখান পাঠক। তাই প্রকাশনা অব্যাহত আছে। মালিক পক্ষের অন্য ব্যবসা থাকলেও, এটি নিয়ে আলাদা আবেগ কাজ করে বলে জানান তিনি। খান ব্রাদার্স এ্যান্ড কোম্পানি যাত্রা শুরু করেছিল ১৯৬৮ সালে। প্রতিবারের মতো এবারও মেলায় অংশ নিয়েছে। স্টলও পেয়েছে ভাল জায়গায়। এখানে পাওয়া গেল নির্মলেন্দু গুণের কাব্যগ্রন্থ। আরও অনেক স্টলে খ্যাতিমান কবির বই আছে। তবে এখানে প্রথম দিককার রচনা। উদাহরণ হতে পারে ‘প্রেমাংশুর রক্ত চাই।’ কবির বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থটি খান ব্রাদার্স থেকে প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৭০ সালের নবেম্বর মাসে। দুই বছর পর, দেশ যখন স্বাধীন, প্রকাশিত হয় আরেক বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ ‘না প্রেমিক না বিপ্লবী।’ একই বছর জুন মাসে এখান থেকে প্রকাশিত হয় আরেক জনপ্রিয় কবি মহাদেব সাহার ‘এই গৃহ এই সন্যাস।’ বইগুলো হাতে নিয়ে দেখতে দেখতে সময়টাও যেন দেখা হয়ে যায়! স্টলের দায়িত্বে থাকা রাসেল জানান, কে এম ফিরোজ খানের নামে খান ব্রাদার্স। তিনিই দেখাশোনা করেন প্রতিষ্ঠানের সব। স্টুডেন্ট ওয়েজ ৬৬ বছরের পুরনো প্রতিষ্ঠান। স্টলে সাজানো আছে নজরুলের ‘কুহেলিকা।’ আছে বেদুঈন সামাদের ‘বেলা শেষে।’ বইটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৫৬ সালে। বিপুল বিক্রি হওয়া বই এখনও প্রকাশিত হচ্ছে। অনেক বইয়ের ফাঁকে জ্বলজ্বল করছিল দীনেশচন্দ্র সেনের ‘ময়মনসিংহ গীতিকা।’ প্রচ্ছদ দেখেই বোঝা যায়, এটি প্রথম দিককার। এখানে আরও আছে কায়কোবাদের ‘মহাশ্মশান।’ প্রথম প্রকাশ কবে বইয়ের গায়ে তার উল্লেখ নেই। আছে ২০ বছর আগে প্রকাশিত আনোয়ার পাশার বিখ্যাত রচনা ‘রাইফেল, রোটি, আওরাত।’ প্রতিষ্ঠানটির সব দেখাশোনা করেন লিয়াকত আলী। তিনি জানান, কিছু বিখ্যাত বই তাদের পরিচিতির অংশ হয়ে গেছে। পাঠকও চায়। তাই করেন। একইভাবে অনেক বই আর প্রকাশ হয় না বলেও জানান তিনি। ‘মুক্তধারা’র কথাও বলতে হয়। চিত্তরঞ্জন সাহা এবং মুক্তধারা থেকেই আজকের মেলা। চিত্ত রঞ্জন অনেক আগে থেকে প্রকাশনার সঙ্গে। ‘মুক্তধারা’ নামে শুরু করেন ১৯৮৫ সালে। প্রতিষ্ঠানটি প্রতিবছরই মেলায় অংশ নেয়। এবারও আছে। অবদানের কথা স্মরণে রেখে বাংলা একাডেমি অংশে স্থান দেয়া হয়েছে। সেখানে গিয়ে দেখা যায়, নতুন পুরনো বইয়ের সম্ভার। খুব পুরনো বইগুলো এখন আর নেই বললেই চলে। কিছু বই সাজানো আছে। তবুও মুক্তধারা। পাঠক কৌতূহল নিয়ে তাকাচ্ছেন। বই কিনছেন। বিদ্যা প্রকাশও বেশ পুরনো। এখানে পাওয়া গেল প্রখ্যাত কবি আবুল হাসান ও রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহর বিপুল জনপ্রিয় কাব্যগ্রন্থ। প্রথম প্রকাশ করেছিল বিদ্যা। এখনও আছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, এখান থেকে প্রকাশিত কবিতাগুলোই পাঠকের মুখে মুখে ফেরে। কাছাকাছি সময়ের দিব্য থেকে এসেছিল হেলাল হাফিজের অমর সৃষ্টি ‘যে জলে আগুন জ্বলে।’ খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মেলায় এখনও সর্বোচ্চ বিক্রির তালিকায় আছে কাব্যগ্রন্থটি। অতি পুরনো প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য আরেকটি নাম মাওলা ব্রাদার্স। তবে এই প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানটি এখন যার হাতে, তার সঙ্গে সব মহলই সচেতন দূরত্ব বজায় রাখেন। দূরত্ব রাখতে বাধ্য হন। ফলে সাম্প্রদিক কোন তথ্য সংগ্রহ করা যায় না। এদিনও সম্ভব হয়নি। ১০৯ নতুন বই ॥ মেলার অষ্টম দিনে নতুন বই এসেছে ১০৯টি। গ্রন্থমেলার প্রথম সপ্তাহে (১Ñ৭ ফেব্রুয়ারি) পর্যন্ত বাংলা একাডেমির নিজস্ব স্টলে বিক্রয় হয়েছে ১৯,৫৫,৫২৮ টাকা। মোড়ক উন্মোচন ॥ এদিন সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে স্থাপিত মঞ্চে ১৪টি নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করা হয়। মেলা মঞ্চের আয়োজন ॥ গ্রন্থমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় ‘সরদার জয়েন উদ্দীনের জন্মশতবার্ষিকী’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। মূলপ্রবন্ধ উপস্থাপন করেন অধ্যাপক বিশ্বজিৎ ঘোষ। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন কথাসাহিত্যিক হরিশংকর জলদাস, অধ্যাপক বায়তুল্লাহ কাদেরী, সরদার জয়েন উদ্দীনের পুত্র জ্যোতি জয়েন উদ্দীন এবং মোবাশ্বিরা ফারজানা মিথিলা। সভাপতিত্ব করেন ড. মোহাম্মদ জয়নুদ্দীন। প্রাবন্ধিক বলেন, সাতচল্লিশ-উত্তর কালখ-ে পাকিস্তানী প্রভাবিত গদ্যের জঞ্জাল থেকে আমাদের সাহিত্যকে সম্মিলিত সাধনায় যারা উদ্ধার করেছিলেন, সরদার জয়েন উদ্দীন তাদের অন্যতম। জীবনে স্থিত হওয়ার সুযোগ তেমন পাননি, সব সময় তাকে তাড়িয়ে বেরিয়েছে অভাব ও দারিদ্র্য, সর্বদা ছিল পেশাগত অনিশ্চয়তাÑ তবু জীবনার্থের সঙ্গে তিনি আপোস করেননি কখনও, নিজেকে কখনও গুটিয়ে নেননি সৃজনভুবন থেকে। তিনি বলেন, সাংবাদিকতা এবং সাহিত্যের জগতে সরদার জয়েন উদ্দীন সর্বদা ছিলেন প্রগতির পক্ষে, মানবতার পক্ষে। সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সঙ্গীত পরিবেশন করেন নাদিরা বেগম, আবুবকর সিদ্দিক, আজগর আলীম এবং শফিউল আলম রাজা।
×