ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

মাঠে আওয়ামী লীগ

প্রকাশিত: ০৫:৪৮, ৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

মাঠে আওয়ামী লীগ

উত্তম চক্রবর্তী ॥ আগামী জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে প্রায় দুই বছর আগে থেকেই প্রস্তুতিপর্ব শুরু করেছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। সার্বিক পরিস্থিতি নিজেদের অনুকূলে থাকলেও নির্বাচনে বৈতরণী পার হতে কোন ধরনের ঝুঁকি নিতে চায় না দলটি। মুখে যাই-ই বলুক, বিএনপি নির্বাচনে আসবে। এটা নিশ্চিত ধরে নিয়েই নির্বাচনে বিজয়ী হতে দুই বছরের মহাপরিকল্পনা নিয়েই মাঠে নামতে চায় দলটি। টানা তৃতীয় মেয়াদে নির্বাচনের ফল নিজেদের পক্ষে রাখতে আগাম নির্বাচনী মিশনে নেমেছে ক্ষমতাসীন দলটি। সময় নষ্ট না করে এখন থেকেই নির্বাচনী ইশতেহার তৈরি, দফায় দফায় মাঠ জরিপের ভিত্তিতে প্রার্থী বাছাই, অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ও কোন্দল মিটিয়ে সংগঠনে দৃঢ় ঐক্যে সৃষ্টি, সরকারের উন্নয়ন কর্মকা- তুলে ধরে জনগণের মন জয়ের লক্ষ্যে ইতোমধ্যেই মাঠে নেমে পড়েেেছন দলটির নীতিনির্ধারক নেতারা। দেশকে বদলে দেয়ার মতো সব উন্নয়ন ও সফলতাগুলো ভোটারদের সামনে তুলে ধরে এখন থেকেই দেশজুড়ে নৌকার পক্ষে গণজোয়ার তোলার লক্ষ্য নিয়ে মাঠে নামার সব ধরনের প্রস্তুতিও সম্পন্ন করেছে আওয়ামী লীগ। এর মাধ্যমে কার্যত আগামী নির্বাচনের মাঠ গুছিয়ে আনছে ক্ষমতাসীনরা। দলের নীতিনির্ধারকরা জানিয়েছেন, সময় নষ্ট না করে সরকারের আট বছরের উন্নয়ন কর্মকা-ের তালিকা নিয়ে জনপ্রতিনিধিদের সমন্বয়ে তৃণমূলে আওয়ামী লীগের পক্ষে জোয়ার তৈরি করার মূল লক্ষ্য নিয়ে সাংগঠনিক প্রস্তুতিপর্ব তৈরির কাজ চলছে। সাধারণ মানুষের দোরে দোরে গিয়ে উন্নয়নচিত্র তুলে ধরে আওয়ামী লীগের পক্ষে ভোট চাওয়াই হবে এ পরিকল্পনার প্রধান লক্ষ্য। সেইসঙ্গে সারাদেশে সংগঠনকে সংগঠিত করা, অন্তঃকোন্দল কমিয়ে আনা এবং সর্বশেষ জেলায় জেলায় সভা-সমাবেশ ও কর্মীসভার মাধ্যমে ব্যাপক জনমত সৃষ্টি ও বিএনপি-জামায়াত জোটের অগ্নিসন্ত্রাস, নাশকতা ও পুড়িয়ে মানুষ হত্যার চিত্রগুলোও জনগণের সামনে তুলে ধরারও টার্গেট রয়েছে ক্ষমতাসীন দলটির। জানা গেছে, কেন্দ্রীয় হাইকমান্ডের নির্দেশ পেয়ে ইতোমধ্যেই নির্বাচনী মাঠে নেমে পড়েছেন দলটির মন্ত্রী-এমপি ও মনোনয়ন প্রত্যাশী প্রার্থীরা। নেতারা শুধু রাজনৈতিক কর্মসূচীতেই নয়, অংশ নিচ্ছেন বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানেও। নিজ নির্বাচনী এলাকা ছাড়াও জেলা-উপজেলায় নিয়মিত উপস্থিতি বেড়েছে কেন্দ্রীয় নেতাদেরও। এসব অনুষ্ঠানে সরকারের উন্নয়ন কর্মকা- এলাকার মানুষের সামনে তুলে ধরছেন তারা। দলের নতুন সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও প্রতিসপ্তাহে দুই-তিনটি জেলা সফরে গিয়ে সংগঠনকে শক্তিশালী ও নেতাকর্মীদের চাঙ্গা করার মিশন চালিয়ে যাচ্ছেন। এর মাধ্যমে কার্যত আগামী নির্বাচনের মাঠ গুছিয়ে আনছেন ক্ষমতাসীনরা। গত ১৪ জানুয়ারি দলের একটি সভায় আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচনী প্রস্তুতি নিতে নেতাকর্মীদের নির্দেশ দেন দলটির সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, আমরা তিন বছর পূর্ণ করে চার বছরে পা দিয়েছি। কাজেই এখনকার পথ হবে আরও কঠিন। তাই এখন থেকেই নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে হবে। জনগণের ঘরে ঘরে গিয়ে উন্নয়নের কথা প্রচার চালাতে হবে। ব্যাপকভাবে সরকারের বিশাল উন্নয়ন ও সফলতাগুলো প্রচার করতে হবে। নির্বাচনের জন্য দলের ইশতেহারের কাজ শুরু হয়েছে জানিয়ে জনসম্পৃক্ততা বাড়ানোর পাশাপাশি সরকারের গৃহীত ব্যাপক উন্নয়ন কর্মকা- জনগণের সামনে তুলে ধরারও নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী। কার্যত এই নির্দেশের পর পরই সরকারে থাকা মন্ত্রী এমপিরা নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকায় গণসংযোগ বাড়িয়ে দিয়েছেন। সম্মেলনে নতুন নেতৃত্ব গঠনের পর দলটির নবনির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও বলেছেন, এখন থেকে বাকি দুই বছর আমাদের প্রতিটি কর্মকা- হবে নির্বাচনকেন্দ্রীক। জনগণের মন জয় করাই হচ্ছে আমাদের মূল লক্ষ্য। আর আমরা যথাসময়েই নির্বাচন করব। কাউন্সিল থেকে আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু করব। আমরা অলরেডি তা শুরু করেও দিয়েছি। আওয়ামী লীগ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বের মাধ্যমে তৃণমূল থেকে সংঘবদ্ধ হয়ে আমরা নির্বাচনে জয় লাভ করব। এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম জনকণ্ঠকে বলেন, যদিও নির্বাচনের এখনও দু’বছর বাকি। কিন্তু একটি নির্বাচনের পরদিন থেকেই আসলে পরবর্তী নির্বাচনের দিকে তাকাতে হয়। আমরা তাই করছি। আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখেই আওয়ামী লীগের নেতারা গণসংযোগ বাড়িয়ে দিয়েছেন, বিভিন্ন এলাকা সফর করছেন। উন্নয়ন কর্মকা-গুলো নিজেরা তদারকি করছেন। এসবের মাধ্যমে জনসম্পৃক্ততা বাড়ানোর কাজটিও হচ্ছে। সার্বিকভাবে বলতে গেলে আমরা নিজেদের নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত করছি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্লান্তিহীন পরিশ্রম করে দেশের চেহারাই পাল্টে দিয়েছেন। আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, দেশের জনগণ আবারও শেখ হাসিনার পক্ষেই গণরায় দেবেন। আর একমাত্র নির্বাচনই যেহেতু গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সরকার পরিচালনার সুযোগ করে দিতে পারে, আমরা সেই নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার লক্ষ্যে কাজ করছি। দলীয় সূত্র জানায়, দুই বছর আগে থেকেই নির্বাচনের নানা প্রস্তুতি শুরু করেছে ক্ষমতাসীনরা। শুরু হয়েছে সাংগঠনিক সফর। ৮ বিভাগীয় টিমে ভাগ হয়ে দ্রুতই আনুষ্ঠানিকভাবে সাংগঠনিক সফরও শুরুর পরিকল্পনাও নিয়েছে দলটি। দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের থেকে শুরু করে দলের সিনিয়র সব নেতাই প্রতিসপ্তাহেই নানা জেলা সফরে গিয়ে সমাবেশ, জনসভা, প্রতিনিধি সম্মেলনের পাশাপাশি সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মসূচীতে অংশ নিয়ে জনগণের কাছে ভোট চাওয়াও শুরু করেছেন। তুলে ধরছেন দেশের উন্নয়ন ও সরকারের অর্জনগুলো। নির্বাচনকে সামনে রেখে দলকে চাঙ্গা করে তুলতে গণসংযোগ ও প্রচারের পাশাপাশি দলের অভ্যন্তরীণ বিরোধ মেটাতেও তৎপর হয়েছে আওয়ামী লীগ। দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের যেখানেই যাচ্ছেন দলের বিভেদের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করছেন। বিরোধ মেটাতে কাজ করছেন বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদকরাও। বিরোধীপূর্ণ এলাকায় গিয়ে কিংবা ফোনের মাধ্যমে কথা বলে দ্বন্দ্ব বিভেদ মেটানোর চেষ্টা করছেন। প্রতিটি স্থানেই নেতারা বলছেন, আওয়ামী লীগ ঐক্যবদ্ধ থাকলে কেউই তাদের হারাতে পারবে না। কারণ দেশের জনগণ জঙ্গীবাদ-অগ্নিসন্ত্রাসের বদলে উন্নয়ন-অগ্রগতির পক্ষেই অর্থাৎ শেখ হাসিনার পক্ষেই রয়েছেন। শুধু নির্বাচনী প্রচারই নয়, আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে প্রার্থী বাছাইয়ের কাজও শুরু করেছে দলটি। দলটির একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত তিনটি নির্বাচনে কারা প্রার্থী ছিলেন, কে কত ভোট পেয়েছিলেন, এখন দলে কার কি অবস্থান, এসব বিষয় দলের সভাপতি শেখ হাসিনার অজানা নয়। তিন শ’ আসনের দলীয় প্রার্থীকে তিনি ব্যক্তিগতভাবেও চেনেন। এছাড়া কয়েক দফা মাঠ জরিপের মাধ্যমেও বর্তমানে মন্ত্রী-এমপিদের নিজ নিজ এলাকায় জনপ্রিয়তার ব্যারোমিটার কেমন, কেউ জনবিচ্ছিন্ন হয়েছে কিনা কিংবা পরাজয়ের আশঙ্কা রয়েছে এমন সংসদ সদস্যদেরও একটি পৃথক তালিকা প্রণয়নের কাজ চলছে। দলটির একাধিক সূত্র জানায়, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে না এসে বিএনপি যে ভুল করেছে, আগামী নির্বাচনে তারা সে ভুল আর করবে না। মুখে যাই বলুক, আগামী নির্বাচনে তারা অংশ নেবে। এ কারণে কোন দুর্বল প্রার্থীকে মনোনয়ন দিয়ে পরাজয়ের কোনই ঝুঁকি নেবে আওয়ামী লীগ। ভোটারদের মুখের ভাষা এবং নির্বাচনী এলাকার বাস্তবচিত্র অনুধাবন করেই প্রতিটি আসনে শক্তিশালী প্রার্থী দিয়ে টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় বিজয়ী হয়ে আসতে চায় দলটি। এ কারণে গত ৮ বছরে যেসব মন্ত্রী-এমপির বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, তাদের বাদ দিয়ে স্বচ্ছ, পরিচ্ছন্ন ইমেজের নতুন জনপ্রিয় প্রার্থী বাছাইয়ের কাজও আগেভাগেই শেষ করার কাজও পুনরুদ্যমে চালিয়ে যাচ্ছেন ক্ষমতাসীনরা। সম্ভাব্য প্রার্থীদের বিষয়ে তথ্য সংগ্রহের কাজও চালাচ্ছে দলটি। সূত্রগুলো আরও জানায়, প্রার্থী বাছাইয়ের পাশাপাশি প্রতিটি নির্বাচনী আসনে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির প্রার্থী কে হতে পারেন, এলাকায় তাদের জনসমর্থন কেমন- তাও মাঠ জরিপের মাধ্যমে সংগ্রহ করছে আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড। একইসঙ্গে বিরোধী পক্ষের প্রার্থীদের অতীত কর্মকা-, দুর্নীতি, সন্ত্রাস কিংবা অনৈতিক কী কী কর্মকা-ে লিপ্ত ছিল তারও একটি তালিকা প্রস্তুত করছে দলটি। পাশাপাশি নির্বাচনের সময় সমমনা ১৪ দলের প্রার্র্থীদের বর্তমান অবস্থা, মহাজোটের প্রার্র্থীদের কার কোথায় শক্তিশালী অবস্থান এবং নির্বাচনের সময় দল মনোনীত প্রার্থীর বিপক্ষে দলেরই কোন কোন নেতা বিরোধিতা করতে পারেন, তাদেরও তালিকা করে আগে থেকেই সবকিছু নিরসনের পরিকল্পনা নিয়েও মাঠে নেমেছেন ক্ষমতাসীন দলটির নীতি নির্ধারকরা।
×