ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

প্রাণিজ আমিষের ৬০ ভাগ মাছ থেকে এলেও মূল্যায়ন নেই জেলেদের

প্রকাশিত: ০৫:৩৯, ৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

প্রাণিজ আমিষের ৬০ ভাগ মাছ থেকে এলেও মূল্যায়ন নেই জেলেদের

স্টাফ রিপোর্টার ॥ মৎস্য খাত প্রাচীনকাল থেকেই দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। এ খাত থেকে দেশের মোট রফতানি আয় প্রায় ৩ শতাংশ, জিডিপির ৪.৩৭ শতাংশ এবং মোট কৃষি খাতের ২৩.৭ শতাংশ ভাগ অর্জিত হয়েছে। মাছ বাংলাদেশের মানুষের দৈনন্দিন খাবারের অন্যতম একটি উপাদান যা প্রাণিজ আমিষের প্রায় ৬০ শতাংশ সরবরাহ করে। প্রচুর পরিমাণে স্বাদু পানির মাছ উৎপাদনের পরেও দেশ জেলেদের ধৃত মাছের উপরে বহুলাংশে নির্ভরশীল। দেশজ মাছের উৎপাদন ১০-১২টি উপকূলীয় জেলাকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত। কিন্তু এসব অঞ্চলের প্রায় ৫ লাখ জেলেরা তাদের অবদানের মূল্যায়ন এখনও সঠিকভাবে পাচ্ছে না। দেশের মূল ভূখ- হতে বিচ্ছিন্ন থাকার ফলে জেলেরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই জীবিকার নানাবিধ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এবং প্রায়শই ন্যায় বিচার ও সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মকা-ের সুবিধা ভোগ করতে পারছে না। সম্প্রতি, ‘উপকূলীয় জেলেদের আইনগত অধিকার ও জীবনমান উন্নয়ন বিষয়ক একটি গবেষণা প্রতিবেদনে ভোলা জেলার উপকূলীয় জেলেদের দুর্দশার চিত্র উঠে এসেছে। সুবিধাবঞ্চিত অসহায় দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ন্যায় বিচারের জন্য সহযোগিতা করার লক্ষ্যে কোস্ট ট্রাস্ট যুক্তরাজ্য সরকারের অর্থায়নে ‘কমিউনিটি লিগ্যাল সার্ভিস’ এর সহায়তায় ‘নিরাপত্তার জন্য ন্যয়বিচার : কমিউনিটির জন্য আইনী সেবা প্রদানের একটি উদ্যোগ’ শীর্ষক প্রকল্পটি ভোলা জেলায় বাস্তবায়ন হয়েছে। এ প্রকল্পটির পক্ষ থেকে সম্প্রতি উপকূলীয় জেলেদের আইনগত অধিকার ও জীবনমান উন্নয়ন বিষয়ক একটি গবেষণা প্রতিবেদন তৈরি হয়েছে। বুধবার সকাল সাড়ে ১০টায় সিরডাপ মিলনায়তনে ‘জাতীয় পর্যায়ে জেলেদের অবদানের মূল্যায়ন ও স্বীকৃতি’ শীর্ষক এক সেমিনারে এ গবেষণা প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন গ্রামীণ বিকাশ ফাউন্ডেশনের লিড কনস্যালন্টেট রেশাদ আলম। প্রতিবেদন উপকূলীয় এলাকায় মৎস্য সম্পদের গুরুত্ব ও জাতীয় অর্থনীতিতে এর অবদান, ভোলা জেলার জেলেদের আর্থ-সামাজিক জীবিকা, জেলে সমাজের সার্বিক সমস্যাসমূহ, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, ইলিশ সংরক্ষণ এবং আর্থিক অনুদান, টিকে থাকার জন্য জীবিকার কৌশল, করণীয়সমূহ ও নীতিমালা বাস্তয়নের সুস্পষ্ট সুপারিশমালা তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিবেদন অনুসারে, ভোলা জেলার উপকূলীয় মৎস্য সম্পদ এবং জাতীয় অর্থনীতিতে ব্যাপক ভূমিকা রাখছে। এ জেলায় প্রতিবছর সর্বোচ্চ পরিমাণে উৎকৃষ্ট মানের ইলিশ আহরিত হয়। প্রজনন মৌসুমে ইলিশের স্থান পরিবর্তনের মূল নদীগুলো ভোলা জেলার ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ার ফলে সারা বছরই এ জেলার নদীতে প্রচুর পরিমাণে ইলিশ মাছ পাওয়া যায়। সেখানকার জেলেরা প্রতিবছর প্রায় ১ লাখ ১৪ হাজার ৬৪৬ মেট্রিক টন ইলিশসহ মোট ১ লাখ ৬০ হাজার ৮০৮ মেট্রিক টন আহরণ করে। এজন্যই উপকূলীয় এলাকার জেলেরা ইলিশের প্রাচুর্য ও উচ্চ মূল্যের কারণে এ মাছ শিকারের উপরে ব্যাপকভাবে নির্ভশীল। কিন্তু পরিবেশের সমন্বিত বিপর্যয়, জলবায়ু পরিবর্তন এবং মাছের ভ্রমণস্থল, জৈবাবস্থা ও প্রজনন স্থানের পরিবর্তনের কারণে প্রতিনিয়তই মাছের উৎপাদন কমছে। বিভিন্ন প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সময় সবচেয়ে বেশি প্রাণ ভয়ে থাকেন উপকূলীয় এলাকার জেলেরা। জেলেরা দেশের জাতীয় অর্থনীতিতে যথেষ্ট অবদান রাখা সত্ত্বেও তারা উন্নত জীবিকা নিশ্চিত ও ন্যায়বিচার প্রাপ্তিতে নিজেদের অধিকার আদায়ের দাবি উত্থাপনের জন্য যথাযথ অনুপ্রেরণা পায় না। জেলে সমাজের মূল সমস্যা হিসেবে প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে, অসন্তোষজনক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, ঋণ প্রাপ্তির সুযোগের অভাব, সুশাসন সংশ্লিষ্ট সমস্যাসমূহ, উপকূলীয় এলাকায় ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগের আঘাত, সামাজিক প্রতিষ্ঠানের অভাব, অবকাঠামোর অভাবসহ আইনী ও নীতিগত কাঠামোর অভাব পরিলক্ষিত হয়েছে। এছাড়া জেলেদের জন্য যে অনুদানের ব্যবস্থা রয়েছে তা মূলত তালিকাকেন্দিক। মৎস্যবিভাগ কর্তৃক প্রস্তুতকৃত এ আলিকায় অনেক জেলেদেরই নাম নেই। জেলেদের তালিকায় শুধু তাদেরই নাম আছে যাদের জাতীয় পরিচয়পত্র আছে এবং যাদের বয়স ১৮ বছরের বেশি। ফলে প্রায় ৫০ শতাংশ জেলে অনিবন্ধিত রয়ে গেছে। সেইসঙ্গে সরকার কর্তৃক খাদ্যের মজুদ হিসেবে ৩-৪ মাস সময়ের জন্য পরিবারের সদস্য নির্বিশেষে প্রতি পরিবারকে মাসিক ৩০ কেজি করে চাল বিতরণের কথা থাকলেও অনেক জেলেরাই ৩০ অথবা ২০ কেজি করে চাল পাচ্ছে। দেশের মূল উপকূলীয় এলাকার প্রায় ৫ লাখ প্রান্তিক জেলেরা একটি নির্দিষ্ট সময় ধরে তাদের অধিকার ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে পারছে না।
×