ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সুমন্ত গুপ্ত

ইতি টানল ব্ল্যাক সাবাথ

প্রকাশিত: ০৫:২৭, ৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

ইতি টানল ব্ল্যাক সাবাথ

আয়রন ম্যান নামটা শুনে যদি আপনার প্রথমেই মার্ভেল কমিকসের চরিত্রটির আগে ব্ল্যাক সাবাথ ব্যান্ডের গানটির কথা মনে হয়- তাহলে আপনি ঠিক জায়গায় আছেন! সেই ১৯৭০ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি, শুক্রবার, আধ-পাগল এক ভোকাল অজি অসবোর্ন, ডান হাতের দুইটা আঙুলের মাথা কাটা যাওয়া এক গিটারিস্ট টনি আয়োমি, লিরিসিস্ট হিসেবে অসম্ভব প্রতিভাবান এক বেজিস্ট গিজার বাটলার আর এক পাগলাটে ড্রামার বিল ওয়ার্ড- মিলে বের করে ‘ইষধপশ ঝধননধঃয’ নামের এক গান। গানের শুরুর সেই ইনট্রো, যা ‘ডেভিলস ইন্টারভাল’ বলে খ্যাত, রক মিউজিকের শ্রোতাদের মনে একটা ধাক্কা দিল। ১৯৬৬ সালে ব্ল্যাক সাবাথের পথচলা শুরু হয়। এই বছর বার্মিংহামের চার তরুণ মিলে পলকা টাল্ক ব্লুুজ নামের একটি রক ব্যান্ড গড়ে তোলে। এ সময় ব্যান্ডটির লাইনাপ ছিলেন ওজি অসবোর্ন (ভোকাল), টোনি ইউম্মি (গিটার), টেরেন্স বাটলার (বেইজ গিটার), বিল ওয়ার্ড (ড্রামস)। ব্ল্যাক সাবাথ প্রথমদিকে রুজ রক ও হার্ড রক ধারার গান করত। তারা জিমি হেনডক্সের মতো বিখ্যাত রক তারকাদের গান করতেন। ব্যান্ড শুরুর ৩৫ বছর পরও নতুন এ্যালবাম দিয়ে কাঁপিয়ে তোলে বিশ্বকে ব্ল্যাক সাবাথ। ভেঙে দেয় টপ চার্টগুলোর রেকর্ড! ‘রোলিং স্টোনস’ ম্যাগাজিনের মতে ‘দ্য বিটলস অফ হেভি মেটাল’ কিংবা এমটিভির তালিকায় ‘দ্য গ্রেটেস্ট হেভি মেটাল’ ব্যান্ডের স্বীকৃতি পাওয়া ব্ল্যাক সাবাথ বিশ্বের মেটাল হেডদের কাছে পুজনীয়, ঈশ্বরতুল্য! ‘রেয়ার ব্রিজ’ ব্যান্ডের গিটারিস্ট টমি আইওমি এবং ড্রামার বিল ওয়ার্ড হঠাৎ করেই ব্যান্ডটিতে নিয়ে আসলেন ভোকাল ওজি অসবোর্ন এবং বেজিস্ট গিজার বাটলারকে। যেখান থেকেই মূলত সূচনা হয় ‘ব্ল্যাক সাবাথের’ এবং এই চারজনের লাইন আপকেই স্বীকৃতি দেয়া হয় সাবাথের ‘দ্য ক্লাসিক’ লাইনআপ হিসেবে। ১৯৭০ সালে তাদের দি এপোনিমাস ব্ল্যাক সাবাথ নামে তাদের প্রথম এলবাম প্রকাশিত হয়। এ্যালবামটি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই বিশ্বজুড়ে বিশাল জনপ্রিয়তা এবং সফলতা পায়। রকসঙ্গীতের ভক্তরা প্রথম হেভি মেটাল ধারণার সঙ্গে পরিচিত হন এ এ্যালবামের মাধ্যমে। মূলত ব্যান্ডের সদস্যরা শ্যালো টাইপ সঙ্গীতের প্রতিবাদ হিসেবে এই ধারার গানের সূচনা করেন। ষাটের দশকের খুব নরম অনুভূতির এক ধরনের গান ব্যাপক জনপ্রিয় ছিল। ব্ল্যাক সাবাথের সদস্যরা চিন্তা করলেন মানুষের মধ্যে একটু প্রতিবাদী এবং বিদ্রোহের ভাব থাকা উচিত- এ চিন্তা থেকেই মূলত হেভি মেটাল সৃষ্টি করে ব্ল্যাক সাবাথ। ১৯৯৭ সালে হঠাৎ করেই ‘ওজি অসবোর্ন’-এর একটি শোতে রিইউনিয়ন হয় সেই পুরনো ক্ল্যাসিক লাইন আপ টির; ‘আয়রন ম্যান’ পারফর্ম করে মাতিয়ে ফেলেন কনসার্টে আসা সবাইকে এবং পারফর্মেন্সটি জিতে নেয় গ্র্যামি এ্যাওয়ার্ড। কিন্তু ভক্তদের আরও একবার হতাশ করে দিয়ে ২০০১ সালে আবার ওজির সঙ্গে দ্বিমতের কারণে মোটামুটি পর্দার আড়ালে চলে যায় ব্যান্ডটি। ২০০৬ সালে ডিওর সঙ্গে ‘ডিহিউম্যানাইজার’-এর লাইন আপ আবার একত্র হয় এবং ‘হেভেন এ্যান্ড হেল’ নামে তারা ‘ডা ডেভিল ইউ নো’ এ্যালবাম রিলিজ করে। কিন্তু ২০১০ এ ডিও মারা যাওয়ার পর ‘হেভেন এ্যান্ড হেল’ আর কোন এ্যালবাম রিলিজ করেনি। ২০১১ সালে আবার ক্ল্যাসিক লাইনআপের একত্রিত হয় এবং নতুন এ্যালবামের কাজ শুরু“করে। যদিও পরে আবার ওয়ার্ড চলে যান এবং তার জায়গায় আসেন রেইজ এগেইন্সট দ্য মেসিনের ড্রামার ব্র্যাড উইল্ক। ২০১৩ সালে বের হয় তাদের ১৯তম এ্যালবাম ‘১৩’। ভেঙে দেয় অতীত সব রেকর্ড। যে ব্ল্যাক সাবাথকে তার ভক্তরা পাগলের মতো ভালবাসত, সেই ব্ল্যাক সাবাথ তাদের সেই পুরনো ডামি এবং ডার্ক স্টাইল ফিরিয়ে নিয়ে আসে তাদের গানে। ৭০ মিলিয়নেরও বেশি এ্যালবাম বিক্রির রেকর্ডধারী কিংবদন্তি এই হেভি মেটাল ব্যান্ড অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে অন্যান্য ব্যান্ডকে। ‘নিও ওয়েভ অফ ব্রিটিশ হেভি মেটাল’, ‘ব্ল্যাম মেটাল’, ‘থ্র্যাস মেটাল’, ‘ডেথ মেটাল’ থেকে শুরু“করে ‘গ্রাঞ্জ’, ‘অল্টার রক’, ‘প্রগ্রেসিভ রক’- এ রকম আরও অসংখ্য জনরার অসংখ্য ব্যান্ড তাদের অনুপ্রেরণার উৎস খুঁজে নেয় এই ব্ল্যাক সাবাথের কাছ থেকেই। গত ৪ ফেব্রুয়ারি ব্ল্যাক সাবাথ তাদের জন্মস্থান বার্মিংহামের ঘঊঈ অৎবহধ তে তাদের শেষ পরিবেশনা নিয়ে হাজির হন হেভি মেটাল প্রেমীদের কাছে। ব্ল্যাক সাবাথ তাদের ৪৯ বছরের সঙ্গীতায়োজনের ইতি টানল। বার্মিংহামের ঘঊঈ অৎবহধ কানায় কানায় পূর্ণ হেভি মেটাল প্রেমীর ব্ল্যাক সাবাথ একে একে পরিবেশন করেন ১৫টি গান। ব্ল্যাক সাবাথপ্রেমী সাজ্জাদ কবির জয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার অনুভূতি প্রকাশ করেন ঠিক এইভাবে- সত্তরের দশকের শেষ দিকে গায়ক অজি অসবোর্নকে দল থেকে বের করে দেয়া হয়, নতুন গায়ক হিসেবে নেয়া হয় আগে রেইনবো ব্যান্ডে কাজ করা রনি জেমস ডিয়োকে। সবাই যখন ভাবছিল ব্ল্যাক সাবাথ বস্তুত: মারাই গিয়েছে, হেভেন এ্যান্ড হেল এ্যালবাম দিয়ে তারা আবার ফিরে আসে, সবাই আবিষ্কার করে এটি ব্যান্ডের নবজন্মের চাইতেও বেশি কিছু। বছরের পর বছর ব্যান্ডের কলাকুশলী বদলেছে, মুখ থুবড়ে পড়েছে, কিন্তু ব্ল্যাক সাবাথের মৃত্যু কখনওই হয়নি। প্রতিটি এ্যালবাম এই ব্যান্ডের স্বতন্ত্র, একেবারে নতুন এক অভিজ্ঞতা নিয়ে হাজির হয়েছে। সর্বশেষ ২০১৩ সালে ‘১৩’ এ্যালবাম বের হয়। আদি তিন সদস্য হাজির থাকলেও ড্রামার বিল ওয়ার্ড কন্ট্রাক্ট সংক্রান্ত জটিলতার কারণে সঙ্গে থাকেননি। প্রায় অর্ধশত বছরের জীবদ্দশায় ব্ল্যাক সাবাথ আক্ষরিক অর্থেই কিংবদন্তি হয়ে উঠেছে। ‘হেভি মেটাল’ সঙ্গীত এই ব্যান্ডটির প্রায় নিজে হাতে গড়া। মেটালিকার লার্স আলরিখের মতে, ‘ব্ল্যাক সাবাথ সব সময়ের জন্য হেভি মেটালের প্রতিশব্দ।’ হেভি মেটাল এবং এর যাবতীয় প্রায় সবগুলো উপশাখা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ব্ল্যাক সাবাথের কাছ থেকে অনুপ্রাণিত। ব্যক্তিগতভাবে, ব্ল্যাক সাবাথ আমার জন্য একটা গানের দল থেকে বেশিকিছু। আমার জীবনকে পরিষ্কারভাবে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। ব্ল্যাক সাবাথ শোনার আগে এবং পরে। একটা ব্যান্ডকে কতটা ভাল লাগে সেটা বোঝাবার জন্য এর থেকে বেশি আর কী বলা যায়?
×