ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

দিনেশ মাহাতো

শিশুদের বিনোদন ও শিশুতোষ চলচ্চিত্র

প্রকাশিত: ০৫:২৭, ৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

শিশুদের বিনোদন ও শিশুতোষ চলচ্চিত্র

শিশুদের দেশীয় সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্য বিষয়ে সচেতন করে তোলা দরকার বিভিন্ন সৃজনশীল প্রকাশের মধ্যদিয়ে। পড়াশোনার পাশাপাশি প্রত্যেকটা শিশুর সুস্থ বিনোদন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। চলচ্চিত্র বিনোদনের একটি অন্যতম মাধ্যম। আর শিশুতোষ চলচ্চিত্র শিশুদের জন্য খুবই দরকার। বছরে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন ছবি মুক্তি পেলেও শিশুদের নিয়ে তেমন কোন চলচ্চিত্র নির্মাণ হতে দেখা যায় না। হাতেগোনা কিছু ছবি নির্মাণ হয়েছে। আমাদের দেশের শিশুদের বিনোদন বলতে এখন তেমন কিছু নেই বললেই চলে। স্কুলে খেলার মাঠ নেই। মাঠের খেলার পরিবর্তে এখন কম্পিউটারে গেম খেলে বড় হচ্ছে শিশুদের একটি বড় অংশ। পাশাপাশি স্কুলে বা কোচিংয়ে বাচ্চাদের একের পর এক পরীক্ষা। খেলার সময় কোথাই। স্কুল ছুটির পর কোচিং বা প্রাইভেট। তার পরে যে সময় শিশুরা হাতে পায় মোবাইল, কম্পিউটারে গেম খেলে কিংবা টেলিভিশনে কার্টুন দেখে। শিশুদের বিনোদনের তেমন কোন ব্যবস্থা নেই। তাই শিশুদের আকৃষ্ট করে এমন শিশুতোষ চলচ্চিত্র তৈরি হওয়া আরও দরকার। কেননা শিশুদেরকেই বলা হয় আগামী দিনের ভবিষ্যত। দেশের ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, আমাদের ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপট নিয়ে আজ পর্যন্ত যেসব শিশুতোষ চলচ্চিত্র নির্মাণ হয়েছে তা খুবই সামান্য। সাধারণভাবে শিশুতোষ চলচ্চিত্র বলতে বোঝায় শিশুদের উদ্দেশ্য করে, তাদের চারপাশের জগত, বোঝাপড়া ও কল্পনার জগতকে কেন্দ্র করে চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হয়। শিশুদের চলচ্চিত্র শুধুমাত্র শিশুদের অভিনীত চলচ্চিত্র নয়। বড়দের অভিনীত চলচ্চিত্রও শিশুদের উপযোগী চলচ্চিত্র হতে পারে। বিশ্বজয়ী বাংলা চলচ্চিত্র নির্মাতা সত্যজিৎ রায়ের গুপি-বাঘা সিরিজের চলচ্চিত্রগুলো তার স্পষ্ট প্রমাণ। আবার শিশু অভিনেতা-অভিনেত্রী থাকার কারণেও শিশুতোষ চলচ্চিত্র হয় না। তার প্রমাণ সত্যজিৎ রায়ের পথের পাঁচালি চলচ্চিত্রটি। এই চলচ্চিত্রটির প্রধান দুই চরিত্র অপু আর দুর্গা দুজনই শিশু। কিন্তু চলচ্চিত্রটাকে কোন অর্থেই শিশুতোষ চলচ্চিত্র বলা যায় না। শিশুতোষ চলচ্চিত্র নির্ভর করে চলচ্চিত্রটির বিষয়বস্তুর উপর। স্বাধীনতার এত বছর পরেও সেই অর্থে বাংলাদেশে শিশুতোষ চলচ্চিত্র নির্মাণের সংস্কৃতি এখনও গড়ে ওঠেনি। তবে ১৯৬৬ সালে ফজলুল হক পরিচালিত ‘সান অব পাকিস্তান’ বাংলাদেশে শিশু চলচ্চিত্র নির্মাণের একটি ভিত তৈরি করে দিয়ে গিয়েছিল নিঃসন্দেহে। স্বাধীন বাংলাদেশে সুভাষ দত্ত পরিচালিত ‘ডুমুরের ফুল’ (১৯৭৮) -কে শিশুদের উপযোগী চলচ্চিত্র নির্মাণের প্রথম চেষ্টা বলা যায়। তবে স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৮০ সালে প্রথম সর্বাঙ্গীন শিশু চলচ্চিত্র হিসেবে নির্মিত হয় ‘এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী’। বাদল রহমান পরিচালিত এই ছবিটি সরকারী অনুদানে নির্মিত হয়েছিল। আজিজুর রহমানের ‘ছুটির ঘণ্টা (১৯৮০), শেখ নজরুল ইসলামের ‘এতিম’ (১৯৮০) এবং ‘মাসুম’ (১৯৮১), শহীদুল আমিনের ‘রামের সুমতি’ (১৯৮৫) ইত্যাদি চলচ্চিত্রের প্রধান চরিত্র ছিল শিশুরা। তারপরে দীর্ঘসময় শিশুদের নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ তেমন দেখা যায়নি। ১৯৯৩ সালে লেখক মুহাম্মদ জাফর ইকবালের গল্প অবলম্বনে নির্মাতা মোর্শেদুল ইসলাম তৈরি করেন ‘দীপু নাম্বার টু’ ও পরে ‘আমার বন্ধ রাশেদ’। দুটি ছবিই ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। শিশুদের নিয়ে ভাল চলচ্চিত্র নির্মাণ হলে মানুষ তা গ্রহণ করবে এ ছবিগুলোই তার প্রমাণ। তাছাড়া বাংলাদেশ শিশু একাডেমি ১৯৮০ সাল থেকে শিশুদের উপযোগী চলচ্চিত্র নির্মাণ করার চেষ্টা চালিয়ে আসছে। প্রতিষ্ঠানটির নির্মিত বেশিরভাগ চলচ্চিত্রের দৈর্ঘ্য ৩০ থেকে ৬০ মিনিটের। তবে আশার কথা এই যে বর্তমান সরকার শিশুদের সুস্থ বিনোদনের বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করেছে এবং সরকারী অনুদানে শিশুতোষ চলচ্চিত্রসহ বিভিন্ন ধরনের ভাল চলচ্চিত্র তৈরি হচ্ছে। বর্তমানে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রেও পরিবর্তনের হাওয়া লেগেছে এবং ভাল ভাল ছবিও তৈরি হচ্ছে। এই পরিবর্তনের ছোঁয়া এসে লাগুক শিশুতোষ চলচ্চিত্রেও এই কামনা আমাদের সবার। তৈরি হোক মানসম্মত শিশুতোষ চলচ্চিত্র। নতুন প্রজন্মের কাছে চলচ্চিত্র হয়ে উঠুক সুস্থ বিনোদন ও জীবন গঠনের হাতিয়ার। কেননা এই শিশুরাই গড়বে আগামীর বাংলাদেশ।
×