ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

দর্শক খড়ায় বাংলা সিনেমাহল

প্রকাশিত: ০৫:২৫, ৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

দর্শক খড়ায় বাংলা সিনেমাহল

ফিরে যাই ’৭০, ৮০-এর দশকে। হলগুলোতে উপচে পড়া ভিড়, লাইনে দাঁড়িয়ে টিকেট পাওয়া যাচ্ছে না। চড়া দাম হাঁকাচ্ছে কালবাজারীরা, চিৎকার করছে রিয়ার সার্কেল, ড্রেস সার্কেল, ফার্স্টক্লাস। এর মাঝে সৌভাগ্যবানরা হাতে টিকেট পেয়ে হাসছে বিজয়ের হাসি । জাতীয় পতাকা দেখানোর সঙ্গে সঙ্গে সবাই দাঁড়িয়ে গেল, পিনপত নীরবতা, সিনেমা শুরু হয়ে গেল। নায়কের আবির্ভাবে করতালি আর সিটিতে প্্রকম্পিত প্রেক্ষাগৃহ, কখনওবা টানটান উত্তেজনা, আবার করুণ দৃশ্যে হাপোস নয়নে মধ্যবিত্ত গৃহিণীর কান্না, এদিক-ওদিক তাকিয়ে চোখ মুছা-হায় বাংলা সিনেমা কোথায় হারিয়ে গেল সেই স্বর্ণালী দিনগুলো। হারিয়ে গেল যৌবন। আজকের অগ্রসরমান প্রযুক্তি কারিগরি দিক থেকে সিনেমাকে যেভাবে সমৃদ্ধ করেছে বাংলা সিনেমায় তার প্রতিফলন অনুপস্থিত। প্রেক্ষাগৃহ এমন একটি স্থান সেখানে যাওয়ার জন্য একটি পূর্ব প্রস্তুতি প্রয়োজন। পরিবার অথবা বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে একটি সময় নির্ধারণ করে প্রেক্ষাগৃহে যাওয়া হয়। এটি ছিল আমাদের একটা সংস্কৃতি আজ যা বিলীন প্রায়। দৈনন্দিন জীবনের কর্মব্যস্ততা বা প্রযুক্তির সহজলভ্যতাকে এর জন্য দায়ী করা চলবে না। মানুষ যত ব্যস্ত হবে সে তত নিজেকে পুনর্সতেজ করতে চায়। আর একটি ছবি সেই সতেজতা দিতে পারে । কিন্তু আজ প্রেক্ষাগৃহ মানুষকে সেভাবে টানতে পারছে না। ’৯৫ পরবর্তী ২ দশক ধরে বাংলা ছবি এতটাই অধঃপাতে গিয়েছে যে মানুষ মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। ছবিতে অশ্লীলতা দিয়ে দর্শক ধরে রাখার একটা প্রয়াস প্রতীয়মান ছিল। কিন্তু শিল্প যখন তার স্বকীয়তা হারায়, নান্দনিকতা লোপ পায় তখন তা আর মানুষের কাছে তথা সমাজে গৃহীত হয় না, এক্ষেত্রেও তার অন্যথা হয়নি। এর মধ্যেও কিছু ভাল কাজ হয়েছে কিন্তু এতই নগণ্য যে মানুষকে প্রেক্ষাগৃহে টানতে পারেনি। বাংলা সিনেমার এই দৈন্যদশা প্রেক্ষাগৃহের পারিপার্শ্বিক পরিবেশটুকুও নষ্ট করে ফেলেছে। লক্ষণীয় যে, বেশিরভাগ প্রেক্ষাগৃহের পাশে গড়ে উঠেছে অবৈধ ব্যবসা, দালাল চক্রের আধিপত্য, নোংরা পরিবেশ যা সভ্য মানুষের পরিবার নিয়ে যাওয়া অসম্ভব। প্রেক্ষাগৃহের সেই পবিত্রতা আর নেই। বাংলা সিনেমার সেই স্বর্ণালী দিনগুলো যখন আমরা পেয়েছিলাম জহির রায়হান, খান আতাউর রহমান, সুভাষ দত্ত, এহেতেশাম, চাষী নজরুল ইসলাম, আমজাদ হোসেন, শিবলি সাদিক, এজে মিন্টু, সোহানুর রহমান সোহান, কাজী হায়াৎ, আলমগীর কবির, এফ কবির চৌধুরী, ছটকু আহমেদ, শহীদুল ইসলাম খোকন প্রমুখ নির্মাতাদের যারা দুই দশক ধরে বাংলা সিনেমাকে যতটুকু সমৃদ্ধ করেছিলেন পরবর্তী দুই দশকে সিনেমা ততটাই জনপ্রিয়তা হারিয়েছে। তাই আজ দর্শককে সিনেমা হলে নিয়ে যাওয়াটা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রবাদ আছে ‘সর্বাঙ্গে ব্যথা, ওষুধ দেব কোথা’ আজ চলচ্চিত্রের সর্বক্ষেত্রে সংস্কার প্রয়োজন। সেন্সর বোর্ড, এফডিসিকে দায়িত্ব নিতে হবে- চলচ্চিত্রকে দিতে হবে শিল্পের ছাপ। শুধুমাত্র পয়সা খরচ করে সিনেমা তৈরি করে কিছু লাভে বিক্রি করার মানসিকতা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। হিন্দী সিনেমার কপি, কয়েকটি সিনেমার কপি করে যে সিনেমাগুলো তৈরি করা হচ্ছে তার সংখ্যাও নেহায়ত কম নয়। এমতাবস্থায় দর্শকের আস্থা নষ্ট হয়। ফলশ্রুতিতে আজ বক্স অফিসে সিনেমা এক সপ্তাহ চলছে না। প্রতি সপ্তাহে নতুন নতুন চাকচিক্যময় পোস্টার দেখা যায়, কিন্তু সিনেমা হলগুলোর ভেতরে চাকচিক্যতা নেই, নেই মানুষের ভিড়। ’৯৫ পূর্ববর্তী সময়ে অনেক সিনেমা মাসের পর মাস এমনকি বছর ধরে চলার নজির এ বাংলায় ছিল। নায়করাজ রাজ্জাক, কবরী, ওয়াসিম, জসিম, আলমগীর, ববিতা, শাবানা, সুচন্দা, সুচরিতা. চম্পা, বুলবুল আহমেদ, জাফর ইকবালের উত্তরসূরি সালমান শাহ পর্যন্ত বাংলা সিনেমার ভা-ার ছিল সমৃদ্ধ। সালমান শাহের অকাল মৃত্যুতে বাংলা চলচ্চিত্র নায়ক শূন্য হয়ে পড়েছিল এবং সেই থেকে শুরু হয় সিনেমার অন্ধকার জগত যা এখনও আলোর দেখা পায়নি। প্রয়াত লেখক, কবি, সাহিত্যিক, চলচ্চিত্র নির্মাতা হুমায়ূন আহমেদ কিছু দিকনির্দেশনা দিয়ে গেছেন যা জনপ্রিয়তা পেয়েছিল, মোস্তফা সারওয়ার ফারুকীর নির্মিত সিনেমাগুলোও দর্শক ধরেছে। দিন ফিরছে মেধাবী তরুণ নির্মাতা ও কলাকুশলীদের কাঁধে ভর দিয়ে আবার বাংলা সিনেমা ফিরে পাবে তার সেই যৌবন, রূপ, মানুষের ঢল নামবে সিনেমা হলে, সিনেমা দেবে বিনোদন, ফিরিয়ে আনবে বাঙালী সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, দেবে নৈতিক শিক্ষা- সেদিন দূরে নয় দর্শক হিসেবেও আমাদের কাঁধে কাঁধ মেলাতে হবে সিনেমার পুনরুত্থানে- দ্বায়িত্ব নিতে হবে সর্বস্তরের।
×