ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ভিনদেশী ভাষার সেবাদাস!

প্রকাশিত: ০৩:৫১, ৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

ভিনদেশী ভাষার সেবাদাস!

‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি’ এই শাশ্বত সত্যকে আজ আমরা অতি সম্মান ও গৌরবের সঙ্গে বুকে ধারণ করেছি প্রিয় মাতৃভাষা ‘বাংলা’র কারণেই। যে কারণে পুরো ফেব্রুয়ারি মাসকে আমরা ভাষার মাসও বলে থাকি। এটি আমাদের জন্য অত্যন্ত গৌরবের যেমন, তেমনি গুরুত্বপূর্ণও বটে। এ কথা যৌক্তিক নিরিখে অনুধাবনযোগ্য যে, মানুষ তার বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ থেকে বিভিন্ন সুর বা স্তরে কণ্ঠধ্বনি চর্চা শুরু করেছিল প্রয়োজনের তাগিদে। প্রথম যুগে তারা বিভিন্ন ধ্বনির মাধ্যমে পরস্পর দৃষ্টি আকর্ষণ বা ভাবের আদান-প্রদান করত। দীর্ঘ সময়ের স্রোত বেয়ে কালের বিবর্তনে এক সময় মানুষ ভাষার উদ্ভব ঘটায়। আরও কালের বিবর্তনে সেই ভাষা আজ মানব জাতির বিকাশের বড় মাধ্যম হয়ে উঠেছে। ভাষার জগতে স্ব স্ব মাতৃভাষার গুরুত্ব অপরিসীম। এমন মাতৃভাষার বা রাষ্ট্রভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন-সংগ্রাম এবং রক্তপাতের ঘটনা বিশ্বের মধ্যে একমাত্র বাংলাদেশেই ঘটেছে। যে কারণে বাঙালীর মহান গৌরবের ‘একুশে ফেব্রুয়ারি ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে আজ বিশ্ব দরবারে ঠাঁই নিয়েছে। জাতিসংঘের ইউনেস্কো কর্তৃক বিগত ১৯৯৯ সালের ১৭ নবেম্বর তারিখ ‘২১ ফেব্রুয়ারি’ দিনটিকে আন্তর্জাতিক পরিসরে স্বীকৃতি প্রদান করে। যা বাঙালী জাতির জন্য বিশাল এক গৌরবের কথা। ভাষা শহীদ সালাম, জব্বার, রফিক, শফিক ও বরকতের রক্তে পরিশুদ্ধ হয়ে ওঠা এই বাংলা ভাষা এখন কেমন আছে? গৌরবের এই মাতৃভাষা ‘বাংলা’ এখন অনেকের কাছেই অবহেলিত। যাদের কাছে অবহেলিত তারা ভিনদেশী ভাষার সেবাদাস। তারা স্বীয় মাতৃভূমি ও মাতৃভাষাকে ভালবাসে না। তাদের দ্বারা এ ভাষার মধ্যে ঘটছে নানা দূষণ এবং বিকৃতি। যেই স্বদেশের মাটিতে জন্ম এবং যার আলো-বাতাসে বেড়ে ওঠা, সেই স্বদেশে প্রেম এবং মাতৃভাষার প্রতি চরম ঔদাসীন্য কিছু মানুষের মধ্যে প্রতিনিয়ত লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এমন কিছু মানুষ আছে যারা- দিন দিন কোন এক ভিনদেশী ভাষার মোহাচ্ছন্ন হয়ে পড়ছে। যা অত্যন্ত দুঃখজনক তো বটেই, এমন। ভিনদেশী ভাষার প্রতি মোহগ্রস্ততা বাঙালী জাতিসত্তার বিকাশের ক্ষেত্রে হুমকিস্বরূপ। এ দেশের মাটিতে ইতোপূর্বে এমনও দেখা গেছে যে, এ রকম ভাষা চেতনার ফেব্রুয়ারি মাসে একটি রাজনৈতিক দলের কর্মীরা দলীয় কর্মসূচীর মিছিল করতে গিয়ে স্বগৌরবে সেøাগানে হেঁকেছিল, ‘এ্যাকশন-এ্যাকশন, ডাইরেক্ট এ্যাকশন।’ যারা বাংলা ভাষাকে রাজনৈতিক চেতনায় ধারণ করবে, তাদের মুখেই এমন! আমাদের বুঝতে হবে, বিভিন্নভাবে আমাদের মাতৃভাষার ওপর ভিনদেশী ভাষার আগ্রাসন চলছেই। উল্লেখ্য, হাল ফ্যাশনের কিছু তরুণ-তরুণী বাংলা ভাষা ও শব্দকে ইংরেজী স্টাইলে (অনেকের মতে বাংলিশ) বলতে গিয়ে স্বদেশীয় মাতৃভাষার বিকৃতি ঘটাচ্ছে। পৃথিবীর একমাত্র ভাষা আন্দোলনের দেশে এমনটি কখনও কাম্য হতে পারে না। শুধু কি তাই? এ দেশীয় যেই গণমাধ্যম মাতৃভাষা চর্চার ওপর বেঁচে আছে সেই গণমাধ্যমের কোথাও কোথাও এবং শিক্ষাঙ্গনেরও অনেক ক্ষেত্রে অশুদ্ধ উচ্চারণ এবং ভুল বানানে লেখা হয়ে থাকে। এমনটি বন্ধের উদ্যোগের কথা অতীতে অনেকভাবে শোনা গেলেও কার্যত লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। মাতৃভাষাকে যেখানে অতি যতœ ও মমত্ববোধের সঙ্গে শুদ্ধ উচ্চারণে ও লিখন-পঠনের মাধ্যমে চর্চা করা দরকার, সেখানে তার বিপরীতটাই ঘটছে। জগতে মাতৃভাষার গুরুত্ব এ জন্য যে, এ ভাষায় সহজবোধ জ্ঞানানুশীলন দ্বারা মিথ্যার জঞ্জাল ঝেড়ে ফেলে দিয়ে মুক্ত বুদ্ধি চর্চার মাধ্যমে প্রকৃত সত্যকে উপলব্ধি করা যায়। এমন মাতৃভাষার প্রতি নির্মল ভালবাসা সৃষ্টি করে এর সঠিক চর্চা না হলে ভিনদেশী ভাষার আগ্রাসনে গৌরবের এ ভাষা এক সময় অস্তিত্ব সঙ্কটের মুখে পড়তে পারে। আনন্দবাজার বন্দর, চট্টগ্রাম থেকে
×