ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

গ্রামে-মফস্বলেই খেলাধুলার প্রকৃত জনপ্রিয়তা

প্রকাশিত: ০৫:৫২, ৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

গ্রামে-মফস্বলেই খেলাধুলার প্রকৃত জনপ্রিয়তা

স্পোর্টস রিপোর্টার ॥ ঢাকা থেকে প্রায় ৮০ কিলোমিটার দূরে প্রত্যন্ত একটি গ্রাম দক্ষিণগাঁও। গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলায় গ্রামের অবস্থান প্রায় ১৫ কিলোমিটার প্রত্যন্তে। ভলিবল প্রতিযোগিতায় মুখোমুখি হয়েছিল জাতীয় দলের দুই গ্রুপ। তাদের ‘হায়ার’ করে নিয়েছিল স্থানীয় দু’টি ক্লাব। খেলা শুরু হওয়ার আগেই গোটা মাঠ কানায় কানায় পূর্ণ। ২০ হাজার দর্শকের মুর্হুমুহু করতালি ও উল্লাসধ্বনির মধ্য দিয়ে শুরু হয় খেলা। দর্শকের এই প্রাণবন্ত ‘ওয়েভ’ সম্ভবত জাতীয় দলের অধিনায়ক জাবির ও তার সহকর্মীদের মধ্যে অন্যরকম এক উম্মাদনা জাগিয়েছিল, যা তাদের শারীরিক ভাষায় ছিল স্পষ্ট। জাবির এবং তার সহকর্মীরা জাতীয় দলের হয়ে অনেক আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে থাকেন। এসব প্রতিযোগিতায় থাকে জেতার তাগাদা। তেমন দর্শক পান না রাজধানী কিংবা বিদেশের মাটিতে এসব প্রতিযোগিতায়। দক্ষিণগাঁওয়ের মাঠে জেতার চেয়ে দর্শকদের ওয়েভ ছিল তাদের খেলার প্রাণ। এক-একটা বল, এক-একটা পয়েন্ট যেন তাদের জয়-পরাজয় নির্ধারণ করে দিয়েছিল। এ কারণে প্রত্যন্ত গ্রামের দু’টি ক্লাবের এই মামুলি খেলায় ছিল অসম্ভব প্রাণের ছোঁয়া। এমন প্রাণের ছোঁয়ায় যে কোন খেলাকেই করে দিতে পারে সমৃদ্ধ। একটা সময় ছিল শহর এবং গ্রামে বা মফস্বলে দারুণ জনপ্রিয় ছিল ফুটবল, ভলিবল, কাবাডিসহ আরও অনেক খেলা। কালের পরিক্রমায় এসব খেলাধুলার চর্চা এখন খুব একটা দেখা যায় না। মাঠ স্বল্পতা, উদ্যোক্তার অভাব, তরুণদের অবক্ষয় এর মূল কারণ। তবে শহর বাদ দিলে গ্রামে-গঞ্জে বা মফস্বলে এখনও কোন খেলার আয়োজন করা হলে সেটা দেখতে যে পরিমাণ দর্শক উপস্থিত হয়, তা যথেষ্ট আশাব্যঞ্জক এবং কৌতূহল জাগানিয়া। দক্ষিণগাঁও গ্রামের সাম্প্রতিক ‘আনোয়ার সাঈদ স্মৃতি ভলিবল টুর্নামেন্টে’র ফাইনাল খেলা এই সত্যই প্রমাণ করে। প্রতিযোগিতায় দু’টি দল ছিল নরসিংদীর মনোহরদী উপজেলার কীর্তিবাসদী বাবলু স্মৃতি সংসদ এবং শিবপুর উপজেলার আলীনগর মিতালী সংঘ। ফাইনালে দুই দলের হয়েই খেলেন জাতীয় ভলিবল দলের দশ খেলোয়াড়। কীর্তিবাসদী দলে ৬ এবং আলীনগর দলে ৪ জন। দারুণ উত্তেজনাপূর্ণ ও হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ে জিতে চ্যাম্পিয়ন ট্রফি নিজেদের করে নেয় কীর্তিবাসদী বাবলু স্মৃতি সংসদ। তারা প্রাইজমানি হিসেবে লাভ করেন দেড় লাখ টাকা (রানার্সআপ দল পায় এক লাখ টাকা)। চ্যাম্পিয়ন দলের হয়ে খেলেন জাতীয় ভলিবল দলের অধিনায়ক আল-জাবির, হরষিত, আলী, সোহেল, আতিক ও ইসা। খেলাটি যারা দেখেছেন তাদের অভিমত, জিত-হার বড় কথা নয়, আসল ব্যাপার হচ্ছে দুই দলের দৃষ্টিনন্দন লড়াকু খেলা, মাঠে উপস্থিত প্রায় ২০ হাজার দর্শকের প্রাণভরে খেলা উপভোগ করা। সাইকেল, মোটর সাইকেল, অটো, নসিমনে চেপে খেলাটি দেখতে পঙ্গপালের মতো মাঠে ছুটে আসেন নানা বয়সের দর্শক। এই খেলা দেখতে ঢাকার মহাখালী থেকে স্কুটি চালিয়ে ৭০ বছর বয়সী মোঃ ইব্রাহিম দক্ষিণগাঁওয়ে চলে আসেন। আশেপাশের তিন-চার থানার লোকজনও তাই। ১২ বছর বয়সী সীমান্ত। পড়ে ক্লাস সিক্সে। চার কিলোমিটার দূর থেকে ফাইনাল দেখতে আসে বড় ভাইয়ের সাইকেলে চেপে। ভলিবলও খেলতে পারে এই বয়সেই। খেলা দেখে আনন্দ লাগে তারও। স্বপ্ন বড় হয়ে ভলিবলার হতে চায় সে। শহরের চেয়ে গ্রামেগঞ্জে ভলিবলের জনপ্রিয়তা যে অনেক বেশি, সেটা প্রমাণ হয় তাতেই। এ রকম প্রত্যন্ত গ্রামে এত দর্শক এবং এত উম্মাদনা জাতীয় দলের খেলোয়াড়রাও দারুণ উপভোগ করেছেন। বাস্তবতা হচ্ছেÑ ইট-কাঠের রাজধানীতে কোন আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টেও এত দর্শকের উপস্থিতি থাকে না। ভলিবল টুর্নামেন্টের সফলতার নেপথ্য রূপকার দক্ষিণগাঁওয়ের সফল ব্যক্তি, শিল্পপতি আলম আহমেদ। সন্ত্রাস, জঙ্গী এবং মাদকের মরণ ছোবল থেকে নিজ এলাকার কিশোর-যুবাদের রক্ষার মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছেন খেলাধুলাকে। বাড়ির পাশেই নিজের জমিতেই (জমির সীমানার নামকরণ করেছেন মরিয়ম ভিলেজ, মরিয়ম হচ্ছেন আলমের মা) তৈরি করেছেন খেলার মাঠ। প্রথমবারের মতো এই ভলিবল আসর আয়োজন করেই থামতে চান না আলম। তিনি তার উদ্যোগকে আরও সম্প্রসারিত করতে চান। তিনি জানান, ফুটবল, ক্রিকেট, ব্যাডমিন্টনসহ আরও সব টুর্নামেন্টের আয়োজন করবেন ভবিষ্যতে। পরিকল্পনায় আরও রয়েছে মেয়েদেরও খেলাধুলায় সম্পৃক্ত করা। একটি পূর্ণাঙ্গ খেলার মাঠ এবং স্পোর্টস একাডেমিও তৈরি করার পরিকল্পনা আছে তার। তিনি আশা করেন, সরকারের পক্ষ থেকেও যেন গ্রাম-গঞ্জে এমন প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। জাতীয় পর্যায়ে ভবিলবল শুধু নয়, জনপ্রিয় ফুটবল-ক্রিকেটসহ প্রায় সবধরনের খেলার প্রতিযোগিতা রাজধানীতে অনুষ্ঠিত হয় দর্শক খরায়। সেসব প্রতিযোগিতা গ্রামে বা মফস্বলে নিয়ে যাওয়া হলে দর্শকের প্রাণের ছোঁয়ায় খেলাগুলো আবারও প্রাণ ফিরে পাবে- এমনটাই ক্রীড়ামোদীদের প্রত্যাশা।
×