ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

সরকারের কাছে সাহায্যপ্রার্থী

মুক্তিযোদ্ধা শিল্পী গোলাম আম্বিয়া জীবনযুদ্ধে আজ পরাজিত

প্রকাশিত: ০৫:৪৬, ৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

মুক্তিযোদ্ধা শিল্পী গোলাম আম্বিয়া জীবনযুদ্ধে আজ পরাজিত

জান্নাতুল মাওয়া সুইটি ॥ এক বছর চার মাস ধরে ক্যান্সারে ধুঁকে ধুঁকে জীবন ক্ষয় করছেন লোকগানের অন্যতম শিল্পী সৈয়দ গোলাম আম্বিয়া। বাংলাদেশের লোকগানের মধ্যে পল্লীগীতি ও ভাওয়াইয়া গানের একনিষ্ঠ চর্চা করে গেছেন যারা, তাদের একজন তিনি। হামদ ও নাতের শিল্পী হিসেবেও প্রচুর সুনাম কুড়িয়েছেন আম্বিয়া। তিনি শুধু একজন শিল্পী নন, তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা। এক সময় দেশের জন্য যুদ্ধে নেমেছিলেন এ যোদ্ধা। কিন্তু কখনও ভাবেননি নিজের জীবন বাঁচাতে তাকে প্রতি পদক্ষেপে যুদ্ধ করতে হবে। পেটে তিনটি টিউমার নিয়ে ভুগছেন তিনি। মূলত টিউমারই তার ক্যান্সারের উৎপত্তিস্থল। প্রথমে কিডনিতে তারপর ক্যান্সার ছড়িয়ে গেছে লিভারেও। নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী ব্যাংককে উন্নত চিকিৎসা করতে গিয়ে তার জমানো সঞ্চয় শেষ করেছেন। কিন্তু টাকার অভাবে পুনরায় দেশের বাইরে গিয়ে চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়ার অবস্থানে নেই এ অকুতোভয় মানুষটি। তার লিভার ট্রান্সপ্লান্ট করতে প্রায় তিন কোটি টাকা প্রয়োজন। অথচ আত্মসম্মানের দিকে চেয়ে কারও কাছে হাত পাততেও নারাজ তিনি। এখন তার শেষ ভরসা সরকার। প্রধানমন্ত্রীকে তার শারীরিক অসুস্থতার কথা জানিয়ে সাহায্য চেয়ে আবেদনপত্র পাঠানোর এক বছর পার হলেও সরকারী তহবিল থেকে এখনও কোন সাহায্য পাননি তিনি। সোমবার দুপুরে সরেজমিন সিপাহীবাগের মিনারা মসজিদসংলগ্ন তার দোতলা বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল, বিছানায় শুয়ে আছেন শিল্পী ও মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ গোলাম আম্বিয়া। শারীরিক অবস্থার কথা জানতে চাইলে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললেন, ‘আমার এখন ভাল আর খারাপ সব একই! মাসে মাসে কেমোথেরাপি নিচ্ছি। সেই সঙ্গে রক্তও নিতে হয়।’ তবুও এ মানুষটি ভাল থাকার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন নিজের মনোবলের মধ্য দিয়ে। একদিন তিনি সুস্থ হয়ে উঠবেন, গান গাইবেন! এখনও মাঝে মাঝে গুন গুন করে হামদ-নাত গেয়ে চোখের জল ফেলেন বলে জানালেন তার স্ত্রী শিল্পী সালেহা বেগম লিয়া। প্রখ্যাত এ শিল্পীর গাওয়া গানগুলোর মধ্যে রাসূল নামে কে এলো মদিনায়, পিতা গুরু মাতা গুরু/তুমি তাদের ভক্তি করো, খালি হাতে পুলসিরাত কেমনে হবি পার এবং আজি দুঃখের কথা ভাবি- গানগুলো বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। পুরনো দিনের কথা বলতে বলতে চোখের পানিতে সিক্ত হয়ে এ সময় শিল্পী গোলাম আম্বিয়া বললেন, “জীবনে কখনও কারও অপকার করিনি। যতদিন ভাল ছিলাম সবার সমস্যায় এগিয়ে গেছি। তাদের সাহায্য করেছি। মানুষের ধর্মই একে অন্যকে সাহায্য করা। কিন্তু অসুস্থ হয়ে ঘরে শুয়ে আছি, পরিচিত ও সতীর্থরা খোঁজ নেয়া তো দূরের কথা; ফোন ধরে ‘হ্যালো’ বলতে ভয় পায়। আমি এখন পর্যন্ত কারও কাছে হাত পাততে নারাজ। আমার চিকিৎসা বাবদ ৪০ লাখের বেশি টাকা খরচ হয়েছে। যতদিন বাঁচব আমাকে চিকিৎসা চালিয়ে যেতেই হবে। ব্যাংকক থেকে চলে আসার পর ল্যাবএইড, ইউনাইটেড, ইবনে সিনার মতো হাসপাতালের বিশেষজ্ঞদের শরণাপন্ন হয়েছি। প্রতি মাসে একবার-দুবার করে কেমো দিতে হচ্ছে। প্রতিটি কেমোথেরাপি নিতে ২০ হাজার টাকা গুনতে হচ্ছে। মাসে তো কখনও দুবার কেমো নিতে হয়। এছাড়া প্রতিদিনের ওষুধ তো আছেই। কিন্তু এত টাকা আমি কোথায় পাই প্রতি মাসে? আমার সামর্থ্যে আর কুলাচ্ছে না এর চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়ার।” প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একবার বিটিভির রোজার সময়কার অনুষ্ঠানে গোলাম আম্বিয়ার দুটো গান শুনে আরও একটি গান গাওয়ার অনুরোধ করেছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর সে অনুরোধ তার শিল্পী জীবনের পরম পাওয়া বলে এখনও স্মরণ করেন তিনি। ভেবেছিলেন সরকার তো অনেককেই সাহায্য করছে, তাকে করবে না কেন? নিজের আত্মবিশ্বাসের জোর থেকেই প্রধানমন্ত্রীর কাছে সাহায্য চেয়ে তার দফতরে একটি অনুরোধ বার্তা পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু সেখান থেকে এখনও কোন উত্তর আসেনি। গোলাম আম্বিয়া বললেন, ‘প্রধানমন্ত্রী অবশ্যই আমাকে সাহায্য করবেন। আমার বিশ্বাস আছে। হয়ত সে পত্র এখনও হাতে পাননি প্রধানমন্ত্রী। যদি তিনি পত্রটি হাতে পেতেন তবে অবশ্যই তিনি আমাকে একটি টাকা হলেও দিয়ে সাহায্য করতেন। বঙ্গবন্ধুকন্যার মমতার কথা সবারই জানা আছে।’ ১৯৬৭ সাল থেকে বিটিভিতে গান গাওয়া শুরু করেন প্রখ্যাত শিল্পী গোলাম আম্বিয়া। পরবর্তীতে বিশেষ গ্রেডের শিল্পীর মর্যাদা অর্জন করেন সৈয়দ গোলাম আম্বিয়া। এমনকি সঙ্গীত পরিচালক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। শুধু তাই নয়, বিটিভি ও বাংলাদেশ বেতারে বহুদিন গানের বিচারক হিসেবেও নিয়োজিত ছিলেন লোকগানের অমর শিল্পী আব্দুল আলীমের শিষ্য সৈয়দ গোলাম আম্বিয়া। বিটিভির বিশেষ গ্রেডের শিল্পী, সেই সঙ্গে বাংলাদেশ বেতারের নিয়মিত শিল্পী হওয়া সত্ত্বেও সরকারী ফান্ড থেকে এখনও কোন সহায়তা পাননি তিনি। এছাড়া মুক্তিযোদ্ধা হওয়া সত্ত্বেও মাসিক ভাতা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন তিনি। তিনি জানালেন, ‘তিন বছর আগেই আবেদন করেছিলাম। এখনও তা প্রক্রিয়াধীন।’ লোকসঙ্গীতশিল্পী গোলাম আম্বিয়া মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখান থানার বিক্রমপুরের পুরসাইল ও তালতলা এলাকায়। একজন মুক্তিযোদ্ধা ও প্রখ্যাত শিল্পী হয়ে এখনও তিনি স্বাধীনতা পদক এমনকি একুশে পদকও পাননি। রাষ্ট্রীয়ভাবে পাননি তিনি কোন মর্যাদা। অথচ এক সময় বাংলাদেশের লোকগানের প্রাণ ছিলেন তিনি। মায়াভরা কণ্ঠ নিয়ে দাপিয়ে বেড়িয়েছেন দেশের এ জায়গা থেকে অন্য জায়গায়। একনামে লোকে চিনেছে গোলাম আম্বিয়াকে। কিন্তু সেদিন আর নেই। দিন বদলেছে। বুঝতে পেরেছেন এ শিল্পী। তাই আক্ষেপে বলেই ফেললেন, ‘ক্ষমতা না থাকলে কেউ কাউকে মূল্যায়ন করে না। আমার ক্ষমতা নেই। তাই আমি কারও সাহায্যও পাচ্ছি না। যদি প্রধানমন্ত্রী আমাকে সাহায্য না করেন তাহলে হয়তবা আর্থিক দীনতায় আমার চিকিৎসা হঠাৎই থেমে যাবে।’ বিছানায় শুয়ে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়া এ লড়াকু সৈনিক বুকের মধ্যে নানা অভিমান নিয়ে এখন শুধু অতীতের স্মৃতি রোমন্থন করে ও চোখের জল ফেলে সময় কাটাচ্ছেন। প্রখ্যাত এ লোকসঙ্গীতশিল্পী ও তার পরিবারের সদস্যরা সরকারী সহায়তাসহ সমাজের বিত্তবান ব্যক্তি ও দাতা প্রতিষ্ঠানের সহায়তা কামনা করেছেন। তার চিকিৎসায় দেশ ও দেশের মানুষকে এগিয়ে আসার অনুরোধ রইল। সহায়তা পাঠানোর ঠিকানাÑ সৈয়দ গোলাম আম্বিয়া, সঞ্চয়ী হিসাব নম্বর-৪২৫ ৮১০ ১০১ ৬৫৪৩, পূবালী ব্যাংক, সিপাহীবাগ বাজার শাখা, খিলগাঁও, ঢাকা; মোবাইল নম্বর- ০১৯১৮৯০৪০২৮।
×