ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

চীনের বলয়ে কম্বোডিয়া

প্রকাশিত: ০৫:২০, ৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

চীনের বলয়ে কম্বোডিয়া

চীন-কম্বোডিয়া গভীরভাবে আলিঙ্গনাবদ্ধ হয়েছে। অর্থাৎ দুটি দেশের মধ্যে হৃদ্যতা বাড়ছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় চীনের প্রভাব যে বাড়ছে এ ঘটনা তার অন্যতম নিদর্শন। কম্বোডিয়ার পশ্চিমে থাইল্যান্ড যার জনসংখ্যা কম্বোডিয়ার চার গুণ। পূর্বে ভিয়েতনাম যার জনসংখ্যা প্রায় ছয় গুণ। ভিয়েতনাম ১৯৭৯ সালে কম্বোডিয়ায় হামলা চালিয়ে ১০ বছর দখল করে রেখে ছিল। এ অবস্থায় ছোট একটি দেশ সর্বদা যা করে থাকে কম্বোডিয়াও তাই করেছে। দেশটা এক ত্রাণকর্তার সন্ধান করে বেরিয়েছে এবং চীন সেই ত্রাণকর্তার ভূমিকায় আবির্ভূত হয়েছে। সেই ২০০৬ সালে কম্বোডিয়ার প্রধানমন্ত্রী হুনসেন চীনকে তার দেশের সবচেয়ে বিশ্বস্ত বন্ধু বলে ঘোষণা করেছিলেন। চীনের বিগত তিন প্রেসিডেন্টের সবাই কম্বোডিয়া সফর করেছেন, অকাতরে সাহায্য দিয়েছেন, অর্থ বিনিয়োগের ঘোষণা দিয়েছেন। বর্তমান প্রেসিডেন্ট জি জিনপিং তাদের তুলনায় বেশি ছাড়া কম করেননি। চীন কম্বোডিয়ার সরাসরি বৈদেশিক বিনিযোগের এ পর্যন্ত সবচেয়ে বড় উৎস। ২০১৫ সালে অন্য সব দেশ মিলে কম্বোডিয়ায় যত বিনিয়োগ করেছে চীনের একার বিনিয়োগ ছিল তার চেয়েও বেশি। কম্বোডিয়ার ব্যাপারে চীনের আগ্রহ আজকের নয়, অনেক আগে থেকেই বিদ্যমান। ১৯৭০ সালে মার্কিন সমর্থনপুষ্ট লৌহমানব থনপল কম্বোডিয়ার ক্ষমতা দখল করলে চীন ক্ষমতাচ্যু রাজা নরোদম সিহানুক ও খেয়াররুজকে সমর্থন দিয়েছেন। এই খেমাররুজ ১৯৭৫ সালে লন নলকে হটিয়ে ক্ষমতা দখল করে। ভিয়েতনামী হামলায় খেমাররুজ বিতাড়িত হওয়ার পরও তাদের প্রতি চীনা সমর্থনও অব্যাহত থাকে। তবে ভিয়েতনামের আশ্রয় প্রশ্রয় পাওয়া হুনসেন ১৯৯০ এর দশকে নিজের ক্ষমতা সুসংহত করে নেয়ার পর চীন ধৈর্যের সঙ্গে তঁকে কাছে টানার চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকে। চীন কম্বোডিয়ার সামরিক সাহায্য দেয়। এই সাহায্যের মধ্যে ইউনিফর্ম, সামরিক যান, হেলিকপ্টার কেনার ঋণ ও ট্রেনিং আছে। চীনা ফার্মগুলো ২০১১ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে কম্বোডিয়াকে প্রায় ৫শ’ কোটি ডলার ঋণ ও বিনিয়োগ দিয়েছে যা সে দেশে শিল্প খাতে মোট বিনিয়োগের প্রায় ৭০ শতাংশ। চীনারা কম্বোডিয়ায় গার্মেন্টস ও খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্প, নির্মাণ শিল্প, খনি শিল্প, অবকাঠামো ও জলবিদ্যুত প্রকল্প চালায়। কিছু কিছু কৃষি কাজেও তারা জড়িত। কম্বোডিয়া সরকার চীনা ফার্মগুলোর জন্য আইনকানুন শিথিলও করে থাকে। একটি চীনা ফার্ম দেশের প্রধান বন্দর সিহানুক ভিলের প্রান্তে জাতীয় পার্কের ভেতর একটি বিলাসবহুল রিসোর্ট বানাচ্ছে। আরেকটি ফার্ম কম্বোডিয়ার তটরেখার প্রায় ৮০ শতাংশে উন্নয়ন কাজের অধিকার পেয়েছে। মানবাধিকার সংগঠনগুলোর অভিযোগ, যুগ যুগ ধরে এই অঞ্চলে বাস করা জেলেদের হঠাৎ উচ্ছেদ করে অভ্যন্তর ভাগে নিয়ে যাওয়া হয়েছে এবং বলে দেয়া হয়েছে যে এখন থেকে তারা কৃষক। এই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থেকে দুটো দেশের প্রত্যেকেই কিছু না কিছু লাভবান হয়েছে। কম্বোডিয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় লাভটা অর্থনৈতিক। দেশটা দরিদ্র ও সাহায্যনির্ভর। চীনের অর্থে কম্বোডিয়ার কেনাকাটা ও নির্মাণ কাজ করতে পারছে। এক কর্মকর্তার ভাষায়, চীনের সাহায্য ছাড়া আমাদের কোথাও যাওয়ার উপায় নেই। আবার অন্যদিকে দু’তরফেরই কিছু স্ট্রাটেজিক সুবিধাও আছে। কম্বোডিয়া চীনকে ভিয়েতনামের বিরুদ্ধে পাল্টা শক্তি হিসেবে ব্যবহার করে। কম্বোডিয়ার সাধারণ মানুষের মধ্যে ভিয়েতনামবিরোধী মনোভাব অতি প্রবল। তাদের একাংশ আজকের ভিয়েতনামের অংশ মেকং নদীর বদ্বীপ ক্যাম্পুচিয়া ক্রোম প্রত্যর্পণ চায়। কারণ ওই এলাকায় বিপুলসংখ্যক কম্বোডিয়ার বাস এবং শত শত বছর ধরে এটি খেমার সাম্রাজ্যের অংশ ছিল। ভিয়েতনাম হুনসেনকে আশ্রয় প্রশ্রয় দেয়ায় বিরোধীরা তাকে ভিয়েতনামের ক্রীড়ানক বলত। এখন চীনের সঙ্গে হুনসেনের ঘনিষ্ঠতা হওয়ার সে ধারণা খ-িত হচ্ছে। কম্বোডিয়া চীনকে পাশ্চাত্যের বিরুদ্ধে রক্ষাপ্রাচীর হিসেবেও ব্যবহার করছে। চীনের সাহায্যের সঙ্গে কোন শর্ত যুক্ত থাকে না যা বেশিরভাগ বিদেশী সাহায্যের বেলায় থাকে। হুনসেন ১৯৯০ এর দশকে কোয়ালিশন শরিকদের বিরুদ্ধে শুদ্ধি অভিযান চালালে পাশ্চাত্যের দাতারা সাহায্য বন্ধ করেছিল। চীন সাহায্য বাড়িয়ে দিয়েছিল। অন্যদিকে চীনের লাভ হলে তারা ১০ সদস্যের দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া রাষ্ট্র সংস্থা বা আসিয়ানের অভ্যন্তরে একটি প্রক্সিরাষ্ট্র পেয়ে গেছে। দক্ষিণ চীন সাগরে সম্প্রসারিত ভূখ-গত দাবির জন্য চীনের সমালোচনা করে আসিয়ান যতবার বিবৃতি দেয়ার উদ্যোগ নিয়েছে ততবারই কম্বোডিয়া বাধা দিয়েছে। গত বছর কম্বোডিয়া সমুদ্রসীমা নিয়ে প্রতিযোগিতামূলক দাবিগুলোর সমাধানে দ্বিপক্ষীয় ভিত্তিতে হতে হবে এই মর্মে চীনের ভূমিকা সমর্থন করে। এর এক সপ্তাহের মধ্যে দেশটা চীনের কাছ থেকে ৬০ কোটি ডলারের প্যাকেজ সাহায্য পেয়ে যায়। চীন এ অঞ্চলে মার্কিন প্রভাব খর্ব করছে। গত ৮ বছর কম্বোডিয়া আমেরিকার সঙ্গে যৌথ সামরিক মহড়া করেছে। কিন্তু ক’দিন আগে নমপেন ঘোষণা করেছে যে তারা এ বছর বা আগামী বছর মহড়া করবে না। অন্যদিকে চীন ও কম্বোডিয়া গত নবেম্বর মাসে আট দিনের এক যৌথ সামরিক মহড়া করেছে। গত বছর দু’দেশের প্রথম যৌথ নৌমহড়াও অনুষ্ঠিত হয়। সূত্র : দি ইকোনমিস্ট
×