ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

ড. জীবেন রায়

আমেরিকায় হ-য-ব-র-ল এবং বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ০৩:৩৯, ৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

আমেরিকায় হ-য-ব-র-ল এবং বাংলাদেশ

মাত্র তিন সপ্তাহ হতে চলেছে মার্কিন নতুন প্রশাসনের কার্যকাল। মিডিয়ার দৃষ্টিতে এবং রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে যদি বলতে হয়, তা হলে বলব, একটা জঘন্য হ-য-ব-র-ল অবস্থা, যা আগে কখনও হয়নি। সাধারণ জনগণ এসব নিয়ে মাথা ঘামায় না। তবে গত নবেম্বর ইলেকশনে এই মার্কিন দেশের গ্রামভিত্তিক জনগণ এবং কিছুটা বঞ্চিত জনগণ ব্যালট বক্সে কাজটা সেরে নিয়েছে। এসব জনগণ কোন দিন কোন প্রটেষ্ট মার্চ করেনি। ভায়োলেন্স করেনি, পেট্রোলবোমাও মারেনি। কিন্তু কাজের সময় ‘ওদের দৃষ্টিতে’ সঠিক কাজটিই করে ফেলেছে। মিডিয়াতে বিভাজন বেড়েই চলেছে। তার পরও একজন মার্কিন বাসিন্দা হিসেবে বলব, সব ঠিকঠাক। যেমন চলছিল আগে, তেমনি চলছে আমাদের কাজকর্ম, নিত্যনৈমিত্তিক দিনগুলোয় এবং গ্যালাপ পোল কেউ বুঝতেই পারেনি। তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা এবং ধর্তব্যে না আনা একজন প্রার্থী প্রেসিডেন্ট হয়ে যাবে! নতুন প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে যেভাবে কথা বলতেন, প্রেসিডেন্ট হয়েও একইভাবে কথা বলছেন ট্রাম্প। নিজের নমিনেটিং রাজনৈতিক দলই বলুন, এমনকি বিচারকই বলুন, কাউকে পাত্তা দেন না। এমনকি মিডিয়াকেও না। উদ্ভট সব যুক্তি নিয়ে কথা বলেন। রাজনৈতিক ব্যক্তি নয় বলেই তা করতে পারছেন। ‘এমনকি রাশিয়া যদি কিলার হয়ে থাকে, যুক্তরাষ্ট্রও কম কিসের?’ ইরাকের উদাহরণ টেনে কথাটা সম্প্রতি বলেছেন তিনি। অর্থাৎ নিজের দেশকেও কিলার হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। নিজের দেশকে সিকিউর করার জন্য তিনি এক্সিকিউটিভ অর্ডার দিতেই পারেন। কিন্তু বিচারকও তার মতামত দিয়ে তাৎক্ষণিক খারিজ করে দেন। তবে কোর্টে লড়াই চলছে। এখন প্রতিক্ষণেই আমার মতো মানুষ নতুন নতুন খবরের অপেক্ষায় থাকছেন। মজার খবর হলো, সম্প্রতি কুয়েতও ৫টি দেশের নাগরিকদের জন্য নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। ’৯/১১ এর মাস্টার মাইন্ড, পাকিস্তান কেন নয়’- সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তরে নতুন প্রশাসনের মুখপাত্র বলেছেন, বিবেচনায় আছে। যুক্তরাষ্ট্র-মেক্সিকোর বর্ডারে ওয়াল হবে- সবাই ভেবেছিল এটা একটা কথার কথা। কিন্তু তা নয়। সে ব্যাপারেও অর্ডার হয়েছে। ৪০ বিলিয়ন ডলার খরচ করে বর্ডার হবে? বিষয়টা এখন দেখার বিষয়। কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, ইউরোপ যাই বলুক, সত্যিকার অর্থে, বর্তমান প্রেসিডেন্টের তেমন কোন মিত্র নেই। মিত্র নিয়ে উনি কেয়ারও করেন না। নিজের স্টাফদের মধ্যে আলোচনা না করেই কথাবার্তা বলে ফেলেন এবং পরবর্তীতে ভাইস প্রেসিডেন্টসহ অন্যান্যরা জোড়াতালি দিয়ে সাপোর্ট করে থাকে। তবে আট বছর পর রিপাবলিকানরা ডোনাল্ড ট্রাম্পের রশি ধরে অপ্রত্যাশিতভাবে ক্ষমতার স্বাদ পাচ্ছে, কাজেই কংগ্রেস এবং সিনেটের এসব সদস্য যদি বিগড়ে না যায়, তাহলে ইমúিচমেন্ট হওয়ার ভয় নেই। ৪ বছরকাল ক্ষমতার দাপট দেখাতে পারবেন ট্রাম্প। তবে সন্ত্রাসী কর্মকা- প্রতিরোধ কতটা কার্যকর হয়- একমাত্র সময়ই বলতে পারবে। কিন্তু মার্কিন জনগণ দেখতে চায় ভাল কাজের কতটা ব্যবস্থা হলো? বর্তমান অর্থাৎ ওবামা থেকে পাওয়া অর্থনৈতিক অবস্থা বেশ ভালই পেয়েছেন ট্রাম্প। শুধু দেখার বিষয় হেলথ কেয়ার নিয়ে কি ব্যবস্থা করেন, যদিও এক্সিকিউটিভ অর্ডার হয়ে গেছে ওবামা কেয়ার রিপিল করার জন্য। এখন রিপিল না রিপ্লেইস তা নিয়ে রিপাবলিকানরা ভাবছে। তবে বর্তমান সরকার থেকে নিউক্লিয়ার ওয়ার্নিং পাওয়াটা যে কোনো দেশের জন্যই হতে পারে, বিশেষ করে নর্থ কোরিয়া এবং ইরানের বিরুদ্ধে। রাশিয়ার সাথে বন্ধুত্ব গড়তে পারলে, ওয়ার্নিং দেয়াটা সহজ হবে। তবে অবশ্যই আইসিসের অস্তিত্ব নিশ্চিহ্ন করতে সর্বদাই তৎপর থাকতে হতো। ব্যক্তিগতভাবে ট্রাম্প তেমন একজন কনজারভেটিভ নন। তবে রিপাবলিকান টিকেটে নির্বাচিত হয়েছেন বলেই কাজকর্মে কনজারভেজিটভ দেখাতে হবে। তাই সুপ্রীম কোর্টে একজন সেন্টপারসেন্ট কনজারভেটিভকে মনোনয়ন দিয়েছেন। এখন দেখার বিষয় ডেমোক্র্যাটরা তা ঠেকাতে পারেন কিনা? বাংলাদেশের জন্য ট্রাম্প হয়ত ভালই হবে। বাংলাদেশ জঙ্গী সন্ত্রাসীদের যেভাবে উৎপাটিত করেছে এবং করে যাচ্ছে, তা দিয়েই যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রশাসনের সঙ্গে মিল মহব্বত হয়ে যাবে। অধিকতর অর্থ সাহায্যও মিলে যেতে পারে। ট্রাম্পের কর্মকা- নিয়ে বাংলাদেশের কোন মন্তব্য না করা এমনকি কোন গোষ্ঠীর প্রটেস্ট মার্চ না হওয়াটা একটা বড় ভাল দৃষ্টান্ত নতুন প্রশাসনের সঙ্গে মিত্র হিসেবে জায়গা করে নেয়ার। দেখুন, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া কেমন চুপচাপ আছে! বাংলাদেশ শুধু শুধু উচ্চবাচ্য করবে কেন? প্রধানমন্ত্রীর ডিপ্লম্যাসির প্রশংসা করতে হয়। শুনেছিলাম ওবামা সরকারের সকল এম্ব্যাসেডররাই রিপ্লেস হবেন। মিস বার্নিকাট এখনও আছেন, বক্তৃতা দিয়ে যাচ্ছেন জেনে ভালই লাগছে। নিজস্ব জীবন থেকে শুরু করে দেশ পরিচালনায় অর্গানাইজড অর্থাৎ গোছানোভাবে কাজ করতে পারলে ভাল কাজগুলো অতি উত্তম হয়ে ওঠে। ভারতে সাম্প্রতিককালে মোদি সরকার একটা ভাল কাজ করতে গিয়ে মানুষের দুর্দশা বাড়িয়ে দিয়েছে। অর্থাৎ তেমনভাবে তৈরি না হয়েই নির্দেশ জারি করে দিয়েছে। ঠিক তেমনি ট্রাম্প সরকারও এক্সিকিউটিব অর্ডার জারি করে দিয়েছে। কিন্তু সঠিক নির্দেশাবলী জানত না এয়ারপোর্ট সিকিউরিটির লোকজন। ফলে গ্রীন কার্ড হোল্ডারগণও যন্ত্রণায় পড়ে এবং প্রযোজ্য নয় তেমন অনেককেই সাময়িক স্ট্রেসে পড়তে হয়। প্রশাসনিক স্টাফরা স্বীকার করতে বাধ্য হয় এবং ভবিষতে আরও গোছানো হওয়ার অঙ্গীকারও করে। এই দুটো দেশের সরকারী ঘোষণা নিয়ে তৈরি জনতার দুর্গতি থেকে বাংলাদেশ সরকারের প্রশাসনকেও ভাবতে হবে। জনগণের কল্যাণের জন্য নিজেদের আটগাট বেঁধে কোন কিছুর ফরমান জারি করা উচিত। তবে বর্তমান অভিজ্ঞ সরকার হয়ত প্রয়োজনে সঠিকভাবেই সবকিছু পারবে। সন্ত্রাস দমন এবং বিচারিক ফলাফল তাই প্রমাণ করছে। নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের মামলায় ২৫ জনের ফাঁসি,অসম্ভব সাহসী এবং নজিরবিহীন রায়। নিজের দলের লোক অন্যায় তো করতেই পারে এবং করছেও, কিন্তু সেই সঙ্গে বিচারও হচ্ছে- সেটাই বড় কথা। পুলিশ হোক, র‌্যাব হোক, নিজের দলের মেয়র হোক কিংবা নেতা হোক- বিচারকে নিজস্ব গতিতে চলতে দিতে হবে। বর্তমান সরকার অবশ্যই সে জন্য ধন্যবাদ পেতে পারে। আমি নর্থ আমেরিকায় প্রথম আসি ১৯৭৯ সালে। ১৯৮৫ সালে দেশে ফিরে যাই। ২০০১ সালে দ্বিতীয় বার আসি। চাকরিহীন থাকিনি কখনও। বেশকিছু জায়গায় চাকরির ইন্টারভিউ দিয়েছি। সবক্ষেত্রে তো আমার চাকরি হয়নি, কিন্তু সে জন্য আমাকে ডিসক্রিমিনেট করা হয়েছে, সে কথা বলব না। অনেকে এই মার্কিন দেশে ডিসক্রিমিনেশনের কথা বলে। বর্তমান পরিস্থিতিতে কোথাও কোথাও হতে পারে বৈকি! কেননা আমেরিকা ফার্স্ট। গ্রীনকার্ড হোল্ডারগণ অথবা পড়াশোনা শেষে চাকরি পাওয়া কিংবা এইচ-১ ভিসা পাওয়াটা ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দিতে হবে। তবে উল্টোরথের জোয়ার এতই প্রবল হচ্ছে যে,এটা সাময়িক ব্যাপার মাত্র। ১৭৮৯ সালে জর্জ ওয়াশিংটনের সময় প্রণীত কনস্টিটিউশনের পুরোপুরি ফ্রিডম আবার আসবে ফিরে এই মহৎ দেশটিতে, আমার দৃঢ় বিশ্বাস। লেখক : আমেরিকা প্রবাসী অধ্যাপক
×