ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

চার কমিশনার হলেন মাহাবুব তালুকদার, রফিকুল ইসলাম, কবিতা খানম ও শাহাদত হোসেন চৌধুরী

রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিয়োগের পর গেজেট প্রকাশ ॥ নূরুল হুদা নতুন সিইসি

প্রকাশিত: ০৫:৫২, ৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিয়োগের পর গেজেট প্রকাশ ॥ নূরুল হুদা নতুন সিইসি

শাহীন রহমান ॥ এবার প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন সাবেক সচিব কে এম নুরুল হুদা। সোমবার রাত সাড়ে নয়টায় মন্ত্রিপরিষদ সচিব শফিউল আলম সিইসি হিসেবে কে এম নুরুল হুদার নাম ঘোষণা করেন। একই সঙ্গে অন্য চার কমিশনার হিসেবে যারা নিয়োগ পেয়েছেন তাদের মধ্যে রয়েছেন সাবেক অতিরিক্ত সচিব মাহবুব তালুকদার, সাবেক সচিব রফিকুল ইসলাম, রাজশাহীর সাবেক জেলা ও দায়রা জজ কবিতা খানম, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল অব. শাহাদত হোসেন চৌধুরী। তবে কমিশনার হিসেবে যারা নিয়োগ পেয়েছেন এদের মধ্যে মাহাবুব তালুকদারের নাম বিএনপির পক্ষ থেকে প্রস্তাব করা হয়। অপর দিকে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে সাবেক জেলা ও দায়রা জজ কবিতা খানমের নাম প্রস্তাব করা হয়েছে বলে মন্ত্রিপরিষদ সচিব শফিউল আলম সংবাদ সম্মেলনে উল্লেখ করেন। তিনি জানান, রাজনৈতিক দলের কাছ থেকে পাওয়া নামগুলো বাছাই করে এই নিয়োগ প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করা হয়েছে। এর আগে সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় সার্চ কমিটি পক্ষ থেকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্য চার কমিশনার হিসেবে নিয়োগের জন্য ১০ জনের তালিকা রাষ্ট্রপতি এ্যাডভোকেট মোঃ আবদুল হামিদের হাতে তুলে দেয়া হয়। ১০ জনের তালিকা থেকে রাষ্ট্রপতি এই ৫ জনকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও চার কমিশনার হিসেবে নিয়োগ দেন। সোমবার রাতেই তাদের নিয়োগ প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করে গ্রেজেট প্রকাশ করা হয়েছে। সার্চ কমিটির সুপারিশে নির্বাচন কমিশনার হিসেবে আরও যে চারটি নাম ছিল, তারা হলেন পরিকল্পনা কমিশনের সাবেক সদস্য আবদুল মান্নান, অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ, অধ্যাপক জারিনা রহমান খান ও অধ্যাপক নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ। এছাড়া প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে এবার সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমারের নাম সুপারিশ করা হয়েছিল। নতুন কমিশনারদের মধ্যে সাবেক সেনা কর্মকর্তা শাহাদৎ হোসেন ও বিচারক কবিতা খানমের নাম ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের কাছ থেকে এসেছিল বলে শফিউল আলম জানান। ১৯৭৩ ব্যাচের সরকারী কর্মকর্তা কে এম নুরুল হুদা দীর্ঘদিন ওএসডি থাকার পর ২০০৬ সালে সচিব হিসেবে অবসরে যান। নুরুল হুদার বাড়ি পটুয়াখালীতে। ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী এবং পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় এবং সংসদ সচিবালয় যুগ্মসচিব ও অতিরিক্ত সচিবের দায়িত্ব পালন করার অভিজ্ঞতা রয়েছে তার। গত ৩১ জানুয়ারি ২৮ রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে যেসব নামের তালিকা সার্চ কমিটিতে দেয়া হয়েছিল সেখান থেকেই বাছাই করে ১০ জনের তালিকা করা হয়েছে। এই ১০ জনের মধ্য থেকে একজন প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্য চার কমিশনার হিসেবে নিয়োগ দেন রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ। রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে সার্চ কমিটির কাছে ১২৮ জনের নামের তালিকা জমা দেয়া হয়। প্রত্যেক রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে ৫ জনের তালিকা জমা দেয়া হয়। সেখান থেকে প্রাথমিক বাছাইয়ে ২০ জনের সংক্ষিপ্ত তালিকা করা হয়। এরপর তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করে ২০ জনের তালিকা থেকে মোট ১০ জনের তালিকা সোমবার চূড়ান্ত করে রাষ্ট্রপতি কাছে জমা দেয়া হয়। সার্চ কমিটি সোমবার সন্ধ্যায় রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করে ইসিতে নিয়োগের জন্য বাছাইকৃত ১০ জনের নামের তালিকা জমা দেন। সেখান থেকে রাষ্ট্রপতি একজন সিইসি ও অন্য চারজনকে কমিশনার হিসেবে নিয়োগ দেন। সোমবার সার্চ কমিটির শেষ বৈঠকেই নামের তালিকা চূড়ান্ত করা হয়েছে। চূড়ান্ত তালিকা করে বৈঠক শেষে সার্চ কমিটি ছয় সদস্য সাড়ে ৬টায় রাষ্ট্রপতির কাছে সাক্ষাত করতে যান। এর আগে বেলা চারটায় সুপ্রীমকোর্টে জাজেজ লাউঞ্জে সার্চ কমিটির প্রধান সুপ্রীমকোর্টের বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বে কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে সার্চ কমিটির সব সদস্যই উপস্থিত ছিলেন। সোমবার সার্চ কমিটির ষষ্ঠ ও শেষ বৈঠক শেষে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব আবদুল ওয়াদুদ বলেন, রাজনৈতিক দলের দেয়া তালিকা থেকেই ইসিতে নিয়োগের জন্য ১০ জনের তালিকা চূড়ান্ত করা হয়েছে। তবে এই মুহূর্তে নাম প্রকাশের কোন সিদ্ধান্ত সার্চ কমিটি নেয়নি। তিনি বলেন, সার্চ কমিটি নামের তালিকা রাষ্ট্রপতির হাতে তুলে দেবেন। তিনি বলেন, বিশিষ্ট নাগরিকদের বৈঠকে তারা যে পরামর্শ সার্চ কমিটিকে দিয়েছেন সেই মানদ- বজায় রেখেই সার্চ কমিটি নামের তালিকা চূড়ান্ত করেছেন। নামের তালিকা চূড়ান্ত করার পর সার্চ কমিটির ছয় সদস্যই সন্ধ্যায় ছয়টায় রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাত করতে যান। বৈঠক শেষ হওয়ার আগেই মন্ত্রিপরিষদ সচিব শফিউল আলম বঙ্গভবনে চলে যান। অবশ্য এ সময় তিনি সাংবাদিকদের কিছু বলেনি। রাষ্ট্রপতি সার্চ কমিটি নামের তালিকা থেকে আগামীকালের মধ্যেই একজন প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্য চারজন কমিশনার নিয়োগ দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করবেন বলেন জানান মন্ত্রিপরিষদের অতিরিক্ত সচিব আব্দুল ওয়াদুদ। তবে সার্চ কমিটির পক্ষ থেকে নামের তালিকা প্রকাশ করা না হলেও বিরোধী রাজনৈতিক দল বিএনপির পক্ষ থেকে সোমবার এক সংবাদ সম্মেলনে সার্চ কমিটির সুপারিশ করা নামের তালিকা প্রকাশ করার আহ্বান জানিয়েছেন তারা। পল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, বিএনপির পক্ষ থেকে অনুসন্ধান কমিটির কাছে আহ্বান জানাচ্ছি শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন গঠনে সৎ, দক্ষ, যোগ্য ও নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের নামের তালিকা করে জাতির সামনে প্রকাশ করুন। তিনি বলেন, নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠন হলে দেশের বর্তমান রাজনৈতিক সংকট দূর হতে পারে। আশা করি জনগণের ইচ্ছাকে পদদলিত করে অনুসন্ধান কমিটি এমন কোন কাজ করবেন না যাতে দেশবাসী তাদের প্রতি আস্থাহীন হয়। সার্চ কমিটির প্রস্তাবিত নাম প্রকাশ করা হলে বোঝা যাবে অনুসন্ধান কমিটি ক্ষমতাসীনদের নির্দেশে কাজ করছে নাকি নিরপেক্ষভাবে কাজ করছে। গত ২৫ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ ইসিতে নিয়োগের জন্য যোগ্য ব্যক্তিদের বাছাই করতে ছয় সদস্যের সার্চ কমিটিন গঠন করেন। কমিটি গঠন করে জারি করা প্রজ্ঞাপনে বলা হয় সার্চ কমিটির ১০ দিনের মধ্যে নামের যোগ্য ব্যক্তিদের নামের তালিকা রাষ্ট্রপতির কাছে জমা দেবেন। সে অনুযায়ী সার্চ কমিটি সোমবারের বৈঠকেই ১০ জনের তালিকা সুপারিশ করে রাষ্ট্রপতির কাছে পৌঁছে দেন। মাত্র ছয়টি বৈঠকেই সার্চ কমিটি নামের তালিকা চূড়ান্ত করেছেন। এর মধ্যে সার্চ কমিটি নিজেদের মধ্যে ৪টি বৈঠকে অংশ নিয়ে রাজনৈতিক দলের দেয়া নামগুলো পর্যালোচনা করেন। অপর দুটি বৈঠক করেন দেশের ১৬ জন বিশিষ্ট নাগরিকের সঙ্গে বিশিষ্ট নাগরিকরা নির্বাচন কমিশনের নিয়োগ দিতে সৎ, যোগ্য, প্রশাসনের দক্ষ ও অভিজ্ঞ এবং চাপের কাছে নতি স্বীকার করবে না এমন সক্ষম ব্যক্তিদের বাছাই করতে সার্চ কমিটিকে পরামর্শ দেন। সোমবারের বৈঠকে শেষে মন্ত্রিপরিষদের অতিরিক্ত সচিব জানান, বিশিষ্টজনদের পরামর্শ অনুযায়ী তাদের দেয়া মানদ- বজায় রেখেই সার্চ কমিটি ১০ জনের তালিকা চূড়ান্ত করেছে। রাষ্ট্রপতির নিয়োগ দেয়া সার্চ কমিটি প্রধান করা হয় সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগের বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনকে। সার্চ কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি ওবায়দুল হাসান, সরকারী কর্মকমিশনের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাদিক, কম্পোট্রোলার এ্যান্ড অডিটর জেনারেল মাসুদ আহমেদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজী বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ মঞ্জরুল ইসলাম এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য শিরীন আকতার। সার্চ কমিটি গঠনের পর এই কমিটি গত ২৮ জানুয়ারি নিজেদের কর্মপদ্ধতি ঠিক করতে তারা প্রথম বৈঠকে বসেন। বৈঠকে সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তারা রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সংলাপের অংশ নেয়া ৩১ রাজনৈতি দলের কাছ থেকে ৫ জন করে নামের তালিকা জমা দেয়ার জন্য আহ্বান জানান। তাদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে ৩১ রাজনৈতিক দলের মধ্য থেকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিরোধী রাজনৈতিক দলসহ ২৮ রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে ১২৮ জনের নামের তালিকা গত ৩১ জানুয়ারি বিকেল ৩টার মধ্যে মন্ত্রিপরিষদের উপসচিবের (প্রশাসন ও বিধি) কাছে জমা দেন। ওইদিন নামের তালিকা নিয়ে পর্যালোচনা করা হয় সার্চ কমিটির পক্ষ থেকে। পর্যালোচনা শেষে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব শফিউল আলম সাংবাদিকদের জানান, তারা রাজনৈতিক দলের কাছ থেকে ভাল ভাল নাম পেয়েছেন। এসব নাম থেকে পর্যালোচনা করে ওইদিন ২০ জনের নামের তালিকা চূড়ান্ত করা হয়। তবে জানা গেছে, এবারে সার্চ কমিটি নিজেরা কোন নাম প্রস্তাব করেনি। শুধু রাজনৈতিক দলের তালিকা থেকেই পর্যালোচনা করেই চূড়ান্ত করে ২০ জনের নাম। এছাড়া তারা ১ ফেব্রুয়ারি ১২ জন বিশিষ্ট ব্যক্তি ও ৩ ফেব্রুয়ারি আরও চারজন বিশিষ্ট ব্যক্তির সঙ্গে যোগ্য ব্যক্তিদের বাছাইয়ের মানদ- নির্ধারণের জন্য পরামর্শ করেন। আগামীকাল বুধবার শেষ হচ্ছে বর্তমান নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব থাকা প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিবউদ্দীনসহ অন্য তিন কমিশনারের মেয়াদ। এরপর আগামী ১৪ ফেব্রুয়ারি বিদায় নেবেন। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া ॥ নতুন নির্বাচন কমিশন সম্পর্কে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ জনকণ্ঠকে বলেন, নির্বাচন কমিশনে যে পাঁচজনের নাম দেখেছি তাঁরা প্রত্যেকেই নিজ নিজ কর্মস্থলে অত্যন্ত দক্ষতা ও সুনামের সঙ্গে চাকরি জীবন শেষ করেছেন। প্রত্যেকেই যোগ্য ও অভিজ্ঞ ব্যক্তি। তাঁদের কারোর ব্যাপারে কর্মজীবনে কিংবা পরবর্তীতে কোন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার কোন কথা এখন পর্যন্ত আমরা পাইনি, শুনিনি। সেই দিক থেকে আমি মনে করি, নিঃসন্দেহে একটি ভাল নতুন নির্বাচন কমিশন হয়েছে। জাতির প্রত্যাশা পূরণে এই নির্বাচন কমিশন সক্ষম হবে।
×