ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

বড়পুকুরিয়া তাপ বিদ্যুত কেন্দ্রের পাশে পূর্ব দুধিপুর গ্রাম

ফ্লাই এ্যাশে নানান রোগে আক্রান্ত গ্রামবাসী

প্রকাশিত: ০৪:১০, ৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

ফ্লাই এ্যাশে নানান রোগে আক্রান্ত গ্রামবাসী

শ.আ.ম হায়দার পার্বতীপুর থেকে ॥ দেশের একমাত্র কয়লাভিত্তিক বড়পুকুরিয়া তাপ বিদ্যুতের বয়লারের চিমনী দিয়ে উদগিরণ ফ্লাই এ্যাশের (সূক্ষ্ম ছাই) কারণে পূর্ব দুধিপুর গ্রামের মানুষ ভয়াবহ পরিবেশ দূষণে আক্রান্ত। সেখানে দেখা দিয়েছে চরম মানবিক বিপর্যয় সুবিধা বঞ্চিত মানুষগুলো মূল স্রোতধারা থেকে আলাদা হয়ে পড়েছে। সরজমিনে দেখা গেছে, গ্রামের ৫শ’ নারী-পুরুষ ও শিশু সকলেই ভুগছে চোখের অসুখে। ইতোমধ্যে ২ জন দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছেন। এরা আঃ খালেক (৬৫) ও শামসুল আলম (৪৬)। অন্যদের অবস্থা ভাল নয়। স্কুলগামী শিশু শ্রেণীর মরিয়ম, প্রথম শ্রেণীর হানিফা, মোঃ তামিম, চতুর্থ শ্রেণীর তানভির আহমেদ , ষষ্ঠ শ্রেণীর জোবায়ের ম-ল, দশম শ্রেণীর রিপন হোসেন চোখের অসুখের কারণে নিয়মিত লেখাপড়া ও স্কুলে যেতে পারে না। চোখ জ্বালা পোড়া ও এই বয়সে চোখে ঝাপসা দেখে বলে তারা জানায়। শতকরা ৭০ ভাগ মানুষ বিভিন্ন চর্ম রোগে আক্রান্ত। ভুগছে শ^াস কষ্টে। আর্থিক সঙ্কটে বিনা চিকিৎসায় তারা জীবন পার করছেন। জমিতে আশঙ্কাজনকভাবে ফলন কমে গেছে। ধান হয় তবে অর্ধেক চিটা। সুপারি, নারিকেল, কাঁঠাল, লিচু ,জাম ইত্যাদি ফলজ গাছ ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু ফল ধরে না। আমের মুকুল আসে না। আসলেও অকালে ঝরে যায়। শিম, বরবটিসহ অনান্য শাক-সবজি ফলে না। তাপ বিদ্যুতের গভীর নলকূপের কারণে গ্রামে পানির সমস্যা। গভীর নলকূপ থেকে প্রতি বাড়িতে পানি সাপ্লাই দেয়া হলেও তা পর্যাপ্ত নয়। দমকা বাতাস প্রবাহিত হওয়া শুরু হলে গ্রামের ওপর ঝিরঝির করে নিক্ষেপ হতে থাকে গরম ছাইয়ের সূক্ষ্ম কনা। তখন বাইরে থাকা যায় না। সাংবাদিকদের আগমনে গ্রামবাসীরা এসে ভিড় জমায়। দুপুর বেলা পুরুষরা জীবিকার কারণে বাইরে থাকায় শুধু মহিলাদের দেখা যায়। গৃহবধূ লূৎফুন নেছা, জীবননাহার , মোশরেকা, আমেনা, রওশনআরা, তাজনূর, ফজিলাসহ আরও অনেকে ব্যক্ত করেন দুঃসহ যন্ত্রণার কথা। বলেন তাপ বিদ্যুত আমাদের জীবনে অভিশাপ বয়ে এনেছে। কার কাছে নালিশ জানাব। তাপ বিদ্যুতের অফিসাররা থাকেন আরামে, এয়ারকন্ডিশনে। বাউন্ডারি ওয়ালের অপর পারে গ্রামের অসহায় মানুষদের দুরাবস্থা তারা কি কোনদিন দেখতে এসেছেন? এ সময় তারা এমনও কথা বলেছেন বসবাসের অযোগ্য ও রোগে আক্রান্ত হওয়ার ভয়ে সম্প্রতি এ গ্রামে কেউ নতুন করে মেয়ে বিয়ে ও আত্মীয়তা করতে চায় না। গ্রামের বাসিন্দা বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, তাপ বিদ্যুত আমাদের জাতীয় সম্পদ। এর বিপক্ষে আমরা নই। তবে প্রতিষ্ঠানের পাশর্^ প্রতিক্রিয়ায় জনপদের মানুষ ধ্বংস হয়ে যাবে তা তো মেনে নেয়া যাবে না। তিনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে সরজমিনে এসে বাস্তব অবস্থা দেখে ক্ষতিগ্রস্তদের বাঁচানোর আহ্বান জানান। জানতে চাইলে দিনাজপুরের হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ ও শরীর তত্ত্ব বিভাগের প্রধান ডক্টর শ্রী দিপতি শিকদার জানান, সাধারণত রান্না বান্নার ধোঁয়ায় কিছুটা ক্ষতি হলেও অত ইফেকটিভ নয়। বাতাসে মিশে বিলীন হয়ে যায়। তবে এই ধোঁয়ার কয়লা পোড়া কার্বন ও ধুলো একসঙ্গে মিশে নিশ^াসের সঙ্গে সরাসরি ফুসফুসে গিয়ে রক্তের সঙ্গে মিশে যায়। এমনিভাবে ব্লাডে আর্বজনা জমে অক্সিজেন যাওয়ার পথে বাধা পড়ে মানব দেহ নানাবিধ বিপর্যয় ও দুরারেগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হতে পারে। এর প্রাথমিক উপসর্গ শ^াসকষ্ট। অপর দিকে কয়লা পোড়া কার্বনের কনাগুলো গাছপালা, ফসল, শাক সবজির ক্ষতি করে। এসবের উপরে আবরণ জমে উৎপাদন ক্ষমতা নষ্ট করে। এখন পরিবেশের বিষয় খুবই স্পর্শকাতর। মেশিন ঠিকমতো চললে এভাবে ধোঁয়া উদগিরিন হবে না। প্রশ্ন হলো পরিবেশের কথা না ভেবে বয়লার, চিমনী ঠিক না রেখে পাওয়ার প্লান্ট কেন চালানো হবে ? বাস্তবতা হলো কয়লার বয়লারে পরিবেশ দূষণ হবেই। তবে তার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। ধোঁয়া নিয়ন্ত্রক যন্ত্রটির নাম বংঢ় (ইলেকট্রো স্পেসিক প্যাসিপিকেটর)। বয়লারের চিমনীর আগে একটি বড় আকারের ঘর রয়েছে। এখানে ৮০ কেভি হাইভোল্টেজের কত রড রয়েছে। বয়লারে কয়লা জ্বলার পর ধোঁয়া আকারের সাদা কার্বনের সূক্ষ্ম কনাগুলো রডে আটকানোর সঙ্গেই ঝাঁকুনি খেয়ে নিচে পড়ে যায়। এগুলো যন্ত্রের সাহায্যে সাইলোতে নিয়ে যওয়া হয়। তারপর পাম্পের সাহায্যে পানি মিশ্রিত করে এ্যাশ পন্ডে (পুকুর) নিয়ে গিয়ে জমা করা হয়। এই ব্যবস্থায় চিমনীর চোং দিয়ে শুধু গরম বাতাস বের হয়ে যায়। খালি চোখে যা দেখাই যাবে না। প্লান্ট চালুর পরই এসপি পুরোপুরি কার্যকর হতে ১ থেকে দেড় ঘণ্টা সময় লাগে। এই সময়ে ধোঁয়া বের হবে। পরে আর হবে না। যদি দেখা যায় চিমনী দিয়ে সাদা বা কাল ধোঁয়া বের হচ্ছে তখন বুঝতে হবে ভোল্টেজ কমে গেছে অথবা ট্রাসফর্মার কাজ করছে না। বড়পুকুরিয়া তাপ বিদ্যুতের সহকারী প্রধান প্রকৌশলী আবু রায়হান, ব্যবস্থাপক (সংরক্ষণ) হারুনুর রশীদ সিদ্দিকী ও প্রধান রসায়নবিদ ডক্টর আজাদ জানান, পূর্ব দুধিপুরে পরিবেশ বির্পযয়ের বিষয়টি সম্পর্কে তারা বিস্তারিত জানেন না। তবে অস্বীকারও করেন না। তারা আরও বলেন আমরা গ্রামবাসীদের অসম্মান করতে চাই না। তবে এই সমস্যা নিয়ে গ্রামবাসীরা কোনদিন তাপ বিদ্যুতে এসে তাদের জানায়নি। জানালে পরীক্ষা-নিরীক্ষা সহ সেখানে মেডিক্যাল টিম পাঠানোর ব্যবস্থা করা যেত। পরিবেশের বিষয়ে সতর্ক থেকে পাওয়ার প্লান্ট চালানো হয়। যাতে মানুষের সমস্যা না হয় যেজন্য আরও সতর্কতা অবলম্বন করা হবে বলে তারা জানান।
×