ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

সংসদে শোক প্রস্তাব

জনগণকে আকর্ষণের চমৎকার ক্ষমতা ছিল ॥ প্রধানমন্ত্রী

প্রকাশিত: ০৭:৪৫, ৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

 জনগণকে আকর্ষণের চমৎকার ক্ষমতা ছিল ॥ প্রধানমন্ত্রী

সংসদ রিপোর্টার ॥ সংসদীয় গণতন্ত্রের আজীবন পূজারী ও বর্ষীয়ান রাজনীতিক সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের মৃত্যুতে তার প্রতি সর্বসম্মত শোক জানাল জাতীয় সংসদ। শোক প্রস্তাবের ওপর আলোচনায় সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের মৃত্যুতে দেশ একজন বিজ্ঞ, অভিজ্ঞ ও সংগ্রামী পার্লামেন্টারিয়ান ও রাজনীতিককে হারাল। তিনি আজীবন প্রগতিশীল, অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে বিশ্বাস করতেন। বহু গুণে গুণান্বিত এই পার্লামেন্টারিয়ান যে কোন বিষয়ে তাৎক্ষণিক যুক্তি ও রেফারেন্স দিয়ে কথা বলতে পারতেন। অনেক কঠিন বিষয়ও হাস্যরসের মাধ্যমে সবার সামনে প্রাঞ্জলভাবে তুলে ধরতে পারতেন। জনগণকে আকর্ষণ করার এক চমৎকার ক্ষমতা ছিল এই রাজনীতিকের। গণপরিষদে একজন বিরোধী দলের নেতা হিসেবেও তিনি ছিলেন একাই এক শ’। আবেগজড়িত কণ্ঠে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সত্তর সালের প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের মধ্যে আর মাত্র ৬ জন বেঁচে আছেন। একে একে সবাইকে আমরা হারিয়ে ফেলছি। সময় হলে আমরাও চলে যাব। কিন্তু নতুন সংসদ সদস্য ও নতুন প্রজন্মের যারা রাজনীতিতে রয়েছেন তাদের কাছে একটাই কামনা- তারা যেন বঙ্গবন্ধুর নীতি আদর্শ বুকে ধারণ করেই দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেন। রবিবার জাতীয় সংসদ অধিবেশনে বর্ষীয়ান রাজনীতিক ও প্রবীণ পার্লামেন্টারিয়ান সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের মৃত্যুতে উত্থাপিত শোক প্রস্তাবের ওপর আলোচনায় অংশ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন। আলোচনা শেষে শোক প্রস্তাবটি ভোটে দিলে তা সর্বসম্মতক্রমে গৃহীত হয়। এরপর সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে সংসদ সদস্যরা নিজ নিজ আসনে দাঁড়িয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করেন। শোক প্রস্তাব গ্রহণ শেষে সাংবিধানিক রেওয়াজ অনুযায়ী দিনের অন্যান্য কার্যসূচী স্থগিত রেখে সংসদ অধিবেশন আজ সোমবার বিকাল ৪টা পর্যন্ত মুলতবি ঘোষণা করেন স্পীকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী। অধিবেশনের শুরুতেই শোক প্রস্তাব উত্থাপন করেন স্পীকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী। শোক প্রস্তাবের ওপর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাড়াও আলোচনায় অংশ নেন বিরোধীদলের নেতা বেগম রওশন এরশাদ, শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু, বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী, স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, বিমানমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন, তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, রেলমন্ত্রী মুজিবুল হক, অর্থ প্রতিমন্ত্রী এম এ মান্নান, ডেপুটি স্পীকার ফজলে রাব্বি মিয়া, চীফ হুইপ আ স ম ফিরোজ, সরকারী দলের সংসদ সদস্য ড. মহিউদ্দিন খান আলমগীর, ড. আবদুর রাজ্জাক, হুইপ মোহাম্মদ শাহাবুদ্দিন, সাবেক ডেপুটি স্পীকার শওকত আলী, সাবেক চীফ হুইপ উপাধ্যক্ষ আবদুস শহীদ, আবদুল মতিন খসরু, অধ্যাপক আলী আশরাফ, মৃণাল কান্তি দাস, ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস, মুহিবুর রহমান মানিক, আবদুল মজিদ খান, আমাতুল কিবরিয়া কেয়া চৌধুরী, স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য ডাঃ রুস্তম আলী ফরাজী, জাসদের মইন উদ্দীন খান বাদল, জাতীয় পার্টির জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু, এবিএম রুহুল আমীন হাওলাদার, জিয়াউল হক মৃধা ও পীর ফজলুর রহমান। প্রধানমন্ত্রী আরও যা বলেন ॥ শোক প্রস্তাবের ওপর আলোচনায় অংশ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, মানুষ মরণশীল। তবে মানুষ চলে যায়, রেখেন যায় তার কীর্তি। সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে সঙ্গে নিয়ে আমরা অনেক আন্দোলন-সংগ্রাম করেছি। তিনি আজীবন প্রগতিশীল, অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে বিশ্বাস করতেন। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের আত্মত্যাগের কথা তুলে ধরতে গিয়ে সংসদ নেতা বলেন, রাজনৈতিক জীবনে অনেক জেল-জুলুম সহ্য করতে হয়েছে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধান সংশোধন করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেছি, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে জাগ্রত করেছি। সেই সংগ্রাম ও কর্মকা-েও আমাদের অন্যতম সাথী ছিলেন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। গণপরিষদে বিরোধীদলের নেতা হিসেবে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের ভূমিকার কথা তুলে ধরতে গিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, জনগণকে আকর্ষণ করার এক চমৎকার গুণ ছিল সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের। গণপরিষদে সংবিধান রচনার সময় অনেক তর্ক-বিতর্ক হয়েছে। তখন বিরোধীদলের সদস্য হিসেবে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের ভূমিকা ছিল ‘একাই এক শ’। বঙ্গবন্ধু তাকে সবসময়ই উৎসাহ দিতেন। অন্য নেতারা যা বলেন ॥ শোক প্রস্তাবের ওপর আলোচনায় অংশ নিয়ে বিরোধীদলের নেতা রওশন এরশাদ বলেন, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ছিলেন সংসদীয় গণতন্ত্রের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। মাটি ও মানুষের নেতা ছিলেন তিনি। তার এতগুণ ছিল তা বলে শেষ করা যাবে না। কিন্তু বেঁচে থাকতে আমরা সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে যথাযথ মূল্যায়ন করিনি। যতদিন সংসদীয় গণতন্ত্র থাকবে ততদিন দেশের মানুষ তাকে চিরদিন শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে। শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সহকর্মী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত আমৃত্যু অকুতভয়, দৃঢ়চেতা নেতা ছিলেন। বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ আবেগজড়িত কণ্ঠে বলেন, এই উপমহাদেশের মধ্যে অন্যতম পার্লামেন্টারিয়ান ছিলেন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। বঙ্গবন্ধু তাকে খুবই পছন্দ করতেন। সংসদীয় ইতিহাসে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের নাম আজীবন স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, কিছুদিন আইন পেশায় জড়িত থেকে সারাজীবনে রাজনীতি ছাড়া অন্য কোন পেশা ছিল না সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের। তিনি ছিলেন আপাদমস্তক জনপ্রিয় রাজনীতিবিদ। কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী বলেন, সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের দীর্ঘ সংসদীয় প্রাকটিসে তার যুক্তি ও বাগ্মিতা ছিল অপরিসীম। তার মৃত্যুতে এক বিশাল শূন্যতা ও বিষাদময় পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এভাবেই মুক্তিযুদ্ধের একটি জেনারেশন শেষ হয়ে যাচ্ছে। তিনি জনগণের অধিকার আদায়ে সবসময় সংগ্রাম করে গেছেন। স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেন, মাটি ও মানুষের নেতা ছিলেন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। আমরাও রাজনীতি করি, কিন্তু তার বক্তৃতা আমরা কখনও দিতে পারিনি। তার বিরোধী দলে থাকার সময় ভূমিকা ছিল অপরিসীম। শেখ ফজলুল করিম সেলিম বলেন, বর্ণাঢ্য ও দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে বেশিরভাগ সময়ই সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে স্রোতের বিরুদ্ধে রাজনীতি করতে হয়েছে। ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি ও বিমানমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন প্রয়াত নেতা সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের সঙ্গে রাজনীতির স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধেও কথা বলার সাহস দেখিয়েছেন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। ড. মহিউদ্দিন খান আলমগীর বলেন, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত একজন উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠ পার্লামেন্টারিয়ান ও দেশপ্রেমিক ছিলেন। জাসদ সভাপতি ও তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বলেন, মানুষ মাত্রই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হয়। কিন্তু সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের মৃত্যু মেনে নিতে কষ্ট হয়। জাতীয় পার্টির মহাসচিব এ বি এম রুহুল আমীন হাওলাদার বলেন, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত একজন প্রাজ্ঞ রাজনীতিক, উচ্চমাপের পার্লামেন্টারিয়ান ছাড়াও সংবিধান ও গণতান্ত্রিক চর্চার অগ্রসেনানী ছিলেন। জাসদের মইন উদ্দীন খান বাদল বলেন, সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের স্মৃতির ভা-ার ছিল অপরিসীম।
×