ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

অমর একুশে গ্রন্থমেলা

‘আন্তর্জাতিক’ চাপমুক্ত মেলা, বই কেনার সংস্কৃতি চাই

প্রকাশিত: ০৫:২১, ৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

‘আন্তর্জাতিক’ চাপমুক্ত মেলা, বই কেনার সংস্কৃতি চাই

মোরসালিন মিজান ॥ বেলা তিনটায় যখন মেলার শুরু, ভয়ঙ্কর রোদ! শীতকালের সূর্য। এর পরও গা ঘেমে যায়। কিন্তু মেলা শুরু হয়ে গেছে। আর শুরু হয়ে গেলেই হলো, পাঠকরা প্রবেশ করতে শুরু করেন। পঞ্চম দিনেও এর কোন ব্যতিক্রম হলো না। শনিবার উপস্থিতি একটু কম ছিল। সেটি পুষিয়ে দিল রবিবারের আসা যাওয়া। বিকেলে অনেকেই এসেছিলেন। সন্ধ্যার আগে আগে তো উৎসবের চেহারা। দিনের অন্য কাজ সেরে মেলায় আসছিলেন পাঠক। এর পর থেকেই বই দেখা। আড্ডা, গল্প। তার চেয়ে বড় কথা, এদিন থেকে ‘আন্তর্জাতিক’ চাপ মুক্ত হলো মেলা। অমর একুশে গ্রন্থমেলার মতো একটি স্বতন্ত্র আবেগ ভালবাসার মেলায় গত দু’বছর ধরে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে ‘আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলন।’ আলাদা কোন আয়োজন হতেই পারে। কিন্তু মেলার সঙ্গে এটি যুক্ত করে দেয়ার ঘটনা এক কথায় বিস্ময়কর। এর সমস্যা কত সমস্যা, এবার বিশেষভাবে দৃশ্যমান হয়েছে। মেলা আয়োজনে দুর্বলতার শেষ নেই। অব্যবস্থাপনা চরমে। অনেক লেখালেখি হচ্ছে। আন্তর্জাতিক নিয়ে ব্যস্ত থাকতে গিয়ে এই লেজেগোবরে অবস্থা বলেই ধারণা। একুশের মেলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। একইভাবে আক্রান্ত হয়েছে মেলা মঞ্চ। রীতি অনুযায়ী, প্রতিবছর একাডেমি অংশে নির্মিত বিশাল মঞ্চ থেকে প্রতিদিন সমকালীন বিষয়ে আলোচনা হয়। প্রবন্ধ পাঠ ও বিশ্লেষণ চলে। থাকে সাংস্কৃতিক পরিবেশনা। কিন্তু বহুদিনের ঐতিহ্য জলাঞ্জলি দিতে দুবার চিন্তা করেননি একাডেমির কর্তারা। আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলন নিয়ে অতিরিক্ত উৎসাহ। সেটি করতে গিয়ে মেলা মঞ্চ বন্ধ রেখেছিলেন চার দিন। পঞ্চম দিনে এসে শুরু হয় একুশের অনুষ্ঠানমালা। মেলায় আগত এক সাহিত্য সমালোচক ঠাট্টার হাসিটি হাসলেন। বললেন, জানেন তো আজ থেকে ‘আন্তর্জাতিক’ চাপ মুক্ত হলো মেলা! চাপ মুক্তির দিনে, আগেই বলা হয়েছে, লোক সমাগম ভাল ছিল। কিন্তু বই কেনা কি শুরু হয়েছে? এমন প্রশ্নের উত্তর চট করে দেয়া মুশকিল। খুব বিক্রি হচ্ছে না। আবার হচ্ছেও। দুটোই সত্য। বরাবরের মতোই জনপ্রিয় ধারার লেখকদের বই খুঁজে নিয়ে কিনছেন পাঠক। সিরিয়াস বইয়ের বিক্রিও বেশ। নাম ধরে বই চেয়ে নিতে দেখা গেছে। যতদিন যাবে ততই আসবে নতুন বই। আর নতুন বই মানেই বেশি আগ্রহ। বিক্রিও বাড়বে, লেখক প্রকাশক সবাই আশা করে আছেন। মুনতাসীর মামুনের সঙ্গে কথোপকথন ॥ পঞ্চম দিন মেলায় এসেছিলেন দেশের প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ লেখক মুনতাসীর মামুন। ভক্ত-অনুরাগীরা তাকে মোটামুটি ঘিরে রেখেছিল। সেই ভিড় ঠেলে কাছে যেতেই টেলিভিশন ক্যামেরা! কয়েক মিনিট আরও অপেক্ষা করতে হলো। তার পর কথা। বই বিক্রি হচ্ছে। আবার হচ্ছেও, কিভাবে ব্যাখ্যা করবেন বিষয়টিকে? এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, মেলা হচ্ছে। লোকজন আসছেন। যত লোক আসছেন সবাই যদি একটি করেও বই কিনতেন তাহলে মেলায় কোন বই থাকত না। এর পরও অনেকে কিনছেন। ঠিক আছে। কিন্তু একটি দুটি বই কেনা না কেনায় কিছু আসবে যাবে না বরং বই কেনাটাকে সংস্কৃতির অংশ করতে হবে। তাহলে এই বিশাল আয়োজন আরও সার্থক হবে। মুনতাসীর মামুন সারা বছরই লিখেন। কিন্তু অনেকেই মেলা আসলে ব্যস্ত হয়ে ওঠেন। বই বের করা চাই যে কোন মূল্যে। কিভাবে দেখেন বিষয়টিকে? জানতে চাইলে তিনি বলেন, হ্যাঁ, মেলাকেন্দ্রিক হয়ে যাচ্ছে প্রকাশনা। এখন একেকজন প্রকাশক প্রতি মেলায় ৫০ থেকে ১০০ বই প্রকাশ করছেন। একই সময় এত কাজ করতে গিয়ে তারা মান রক্ষা করতে পারছেন না। প্রচুর বানানে ভুল থাকছে। আরও নানা ত্রুটি পরিলক্ষিত হচ্ছে। বিষয়গুলো নিয়ে নজর দেয়ার সময় এসেছে বলে মন্তব্য করেন তিনি। প্রকাশকের কথা ॥ কাকলী প্রকাশনীর কর্ণধার নাসির আহমেদকে দেখা গেল নিজের প্যাভিলিয়নে। জনপ্রিয় ধারার বই বেশি করেন তিনি। জানালেন, তার এক ডজনের বই ইতোমধ্যে চলে এসেছে। হুমায়ূন আহমেদ আনিসুল হক সুমন্ত আসলামের বইগুলো বেশি চলছে। গত শুক্রবার মেলা বেশ জমে উঠেছিল জানিয়ে তিনি বলেন, সামনের দিনগুলো নিশ্চয়ই আরও ভাল যাবে। নির্বাচিত বই ॥ শেক্সপিয়ারের অনুবাদ অনেক হয়েছে। বিখ্যাত হ্যামলেটও বাদ যায়নি। তবে সৈয়দ শামসুল হক যখন ‘হ্যামলেট’ অনুবাদ করেন তখন এর আলাদা গুরুত্ব। মৃত্যুর কিছুদিন আগে হাসপাতালে শুয়ে বসেই লেখাটি শেষ করেন সব্যসাচী লেখক। শিল্পকলা একাডেমির জন্য অনুবাদ করা বইটি প্রকাশ করেছে অন্যপ্রকাশ। সৈয়দ হকের ভাষায়Ñ বিভিন্ন সম্পাদককৃত হ্যামলেটের যে পাঁচটি সংস্করণ আমার পাঠাগারে আছে, নিবিড়ভাবে পাঠ করতে শুরু করি; ক্রমে কখনও ধীর-সময় নিয়ে, কখনও বিদ্যুত চমকের মতো আবার কোনটিতে দৃশ্যগুলোর বাংলা মুখাবয়ব স্ফুট হতে থাকে। সুন্দর প্রচ্ছদে আসা বইটির মূল্য ২২৫ টাকা। একই প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকে এসেছে সাদিয়া মাহ্জাবীন ইমামের বই ‘রক্তমূলে বিচ্ছেদ।’ মানুষ যে প্রকৃতিরই অংশ, সে কথা নিজের মতো করে বলার চেষ্টা করেছেন লেখিকা। বইটির মূল্য ২২৫ টাকা। ঐতিহ্য প্রকাশ করেছে শারমিন আহমদের বই ‘মুক্তির কা-ারী তাজউদ্দীন কন্যার অভিবাদন।’ আগেও বাবাকে নিয়ে লিখেছেন শারমিন। সে ধারাবাহিকতায় এই রচনা। শ্রাবণ থেকে এসেছে সুদীপ্ত সালামের বই ‘গুলশান ট্র্যাজেডি ও আল-কায়েদা নেটওয়ার্ক।’ আন্তর্জাতিক জঙ্গী সংগঠন আল কায়েদার নেটওয়ার্ক সম্পর্কে একটি ধারণা বই থেকে পাওয়া যাবে। গুলশানে হলি আর্টিজান রেস্টুরেন্টে জঙ্গী হামলার ঘটনাটিও আলোচিত হয়েছে। আছে বিশ্লেষণ। ১১২ পৃষ্ঠার ছোট্ট পেপারব্যাক। মূল্য ২০০ টাকা। চট্টগ্রামের অদ্ভুত সুন্দর একটি প্রতিষ্ঠান বাতিঘর। মূলত বইয়ের দোকান। পাঠ ও কেনার চমৎকার সুযোগ আছে সেখানে। পাশাপাশি বইও প্রকাশ করছে। বাতিঘর থেকে এবার এসেছে মোহাম্মদ রফিকের ‘মানব পদাবলি।’ বইয়ের ভূমিকা থেকে বললেÑ ছন্দসচেতন এই কবি বাকচাতুর্যের বদলে উপহার দিতে চান মর্মাভিসারী ও সান্দ্র এক স্বরভঙ্গিমা। আর কবির বলাটি, ‘আমার মানচিত্রকে বিশ্বপৃষ্ঠে সংস্থাপন করতে হবে, নন্দন মেলাতে হবে বিশ্বচৈতন্যে, কবিতায়, গদ্যে। প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান প্ল্যাটফরম থেকে এসেছে নুরুন্নাহার শিরীনের গদ্য ‘দেখার দু-চোখ জগতজুড়ে।’ কোথাও কেউ নেই ॥ মেলা আয়োজনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের কেউ কোথাও নেই! সুবিধা অসুবিধা দেখবে, কে দেখবে? নেই কেউ। মেলার চতুর্থ দিন শনিবার একাডেমির দায়িত্বশীল কাউকে মেলায় পাওয়া যায়নি। রবিবারও তা-ই। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, একাডেমির কর্তাব্যক্তি শামসুজ্জামান খান গেছেন কলকাতা বইমেলায়। আর মেলা পরিচালনা কমিটির সদস্য সচিব হঠাৎ অসুস্থ। ঘটনাটিও বলার মতো। একাডেমি এবার মেলায় দু’টি খাবারের স্টলের অনুমতি দিয়েছে। একটি একাডেমির কর্মচারীরাই পরিচালনা করছেন। সেখানে খাবার খেয়েছিলেন ড. জালাল আহমেদ। আর তাতেই কুপোকাত! ফুড পয়জনিং। হাসপাতাল হয়ে এখন বাসায় আছেন তিনি। মেলায় আসতে পারছেন না। এখানেই শেষ নয়। জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতির নেতারাও গত দুই দিন মেলায় নেই। কলকাতায় গেছেন তারাও। সব মিলিয়ে ‘কোথাও কেউ নেই’ অবস্থা বৈকি! ২৭ নতুন বই ॥ মেলায় নতুন বই আসতে শুরু করেছে। প্রতিদিন কতগুলো বই আসছে সে তথ্য সংগ্রহ করা প্রায় অসম্ভব। তবে প্রকাশকরা নতুন বইয়ের একটি করে কপি জমা দেন একাডেমির তথ্যকেন্দ্রে। সে হিসাব অনুযায়ী, মেলায় পঞ্চম দিনে রবিবার নতুন বই এসেছে ২৭টি। মোড়ক উন্মোচন ॥ এদিন সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যান অংশে স্থাপিত মঞ্চে ৭টি নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করা হয়। মেলা মঞ্চের আয়োজন ॥ এদিন ছিল ‘আহসান হাবীব জন্মশতবর্ষ’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন কবি তুষার দাশ। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন ড. অনু হোসেন ও ড. তারেক রেজা। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন অধ্যাপক জুলফিকার মতিন। ‘শতবর্ষী এক ফলদ বৃক্ষের জন্মবার্ষিকীতে তাঁর সৃজনশীলতার বয়ান’ শিরোনামের প্রবন্ধ উপস্থাপন করে প্রাবন্ধিক বলেন, আহসান হাবীব কবি, শতবর্ষী এক ফলদ বৃক্ষই যেন। তাঁর শতবর্ষ হয়ে গেল, তাঁর রচিত কাব্যগ্রন্থগুলো যেন ধীরে ধীরে আরও বেশি আলোপ্রদায়ী একেকটি পরশ পাথরে পরিণত হতে চলেছে। তরুণ ও তারুণ্যের এক উজ্জ্বল প্রতীক হিসেবে তাঁর জীবন ও জীবনযাপনের অনুপম সব কাহিনী এখনও আমাদের স্মৃতির মুঠোয়। তিনি বলেন, কাব্যবিচারের ক্ষেত্রে আহসান হাবীবকে আমরা চিনে নিয়েছি চল্লিশের দশকের একজন প্রধান কবি হিসেবে। তাঁর অজস্র সহযাত্রী ছিলেন, তাঁদের প্রত্যেকেরই নিজস্ব চরিত্রবৈশিষ্ট্য ছিলÑ যেমন আহসান হাবীবের ছিল প্রখর তারুণ্য। তাঁর জীবনযাপন ও কবিতায় সেই তারুণ্যের অসামান্য বলিষ্ঠ প্রকাশ আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। আলোচকরা বলেন, আহসান হাবীব যেমন তাঁর সময়ের সন্তান এবং তেমনি তিনি সময় থেকে এগিয়েও ছিলেন। দেশভাগ, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, স্বাধীনতার সংগ্রাম, ক্ষুধা ও আশা ইত্যাদি সব সমসাময়িক অনুষঙ্গ আহসান হাবীব তাঁর কবিতায় বাক্সময় করেছেন সুনিপুণ শিল্প দক্ষতায়। প্রেমের কবিতাতেও আহসান হাবীব অসামান্য। ব্যক্তিগত নিবেদনের বৃত্ত ভেদ করে প্রেমের কবিতাকে তিনি নতুন মাত্রা দান করেছেন। সভাপতির বক্তব্যে অধ্যাপক জুলফিকার মতিন বলেন, আহসান হাবীব কবি হিসেবে অনন্যসাধারণ। পাশাপাশি কথাসাহিত্য ও শিশুতোষ রচনাতেও তাঁর স্বাতন্ত্র্যের স্বাক্ষর মুদ্রিত রয়েছে। জন্মশতবর্ষে আহসান হাবীব নতুন মূল্যায়ন দাবি করেন। সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সঙ্গীত পরিবেশন করেন সালমা আকবর, ফাহিম হোসেন চৌধুরী, লাইসা আহমেদ লিসা, অণিমা রায়।
×