ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

এম এ রশীদ

ঐকমত্যের নির্বাচন কমিশন কি অপরিহার্য?

প্রকাশিত: ০৩:২২, ৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

ঐকমত্যের নির্বাচন কমিশন কি অপরিহার্য?

পরবর্তী নির্বাচন কমিশন গঠনের বিষয়টি দেশের বর্তমান রাজনৈতিক অঙ্গনের সর্বাধিক আলোচিত বিষয়। সংবাদপত্রসমূহের পাতা উল্টালে এবং টিভি চ্যালেনগুলোর সংবাদ ও টকশো দেখলে এ কথাই প্রতীয়মান হয়। সংবিধানের সংশ্লিষ্ট আর্টিক্যালে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন করা রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব। তবে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে ভবিষ্যত নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা। কারণ এটা দেশের আপামর জনসাধারণের দাবি। কিন্তু দেশে বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বলা যায় যে রাষ্ট্রপতি স্বউদ্যোগে জাতিকে যে নির্বাচন কমিশনই উপহার দেন না কেন, বিরোধী জোট সঙ্গে সঙ্গে তাকে সরকারের অনুগত ও আজ্ঞাবহ কমিশন বলে কোরাস গাইতে শুরু করবে। উল্লেখ্য, সম্প্রতি বিএনপি নেত্রী সকল রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনাক্রমে সকল দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে একটি সত্যিকারের নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠনের জোরালো দাবি তুলেছেন। ইতোমধ্যেই মহামান্য রাষ্ট্রপতি নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন প্রশ্নে স্বউদ্যোগে সকল রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা সম্পন্ন করেছেন। গত শতাব্দীর ৭৫-৯০ সময়কালের নির্বাচন কমিশনের ওপর তৎকালীন সরকারসমূহের স্বৈরাচারী হস্তক্ষেপের প্রসঙ্গ এ আলোচনায় অন্তর্ভুক্ত হবে না। কারণ ওই সরকারসমূহ ছিল মূলত অসাংবিধানিক, যাকে সামরিক বা প্রায় সামরিক আখ্যায়িত করলে অত্যুক্তি হবে না। ’৯১ সাল থেকে নতুন করে আবার সাংবিধানিকভাবে নির্বাচিত গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার পথে আমাদের অভিযাত্রা শুরু হয়। বক্ষমান নিবন্ধে উল্লিখিত নব অভিযাত্রাকালের নির্বাচন ও নির্বাচন কমিশন সংক্রান্ত আলোচনাই অন্তর্ভুক্ত থাকবে। তবে জাতীয় নির্বাচন ও স্থানীয় সরকার নির্বাচন উভয় ক্ষেত্রেই নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা পর্যালোচনা করা হবে। অনেকের স্মরণ থাকার কথা যে, ’৯১-৯৬ সালে বিএনপি শাসনামলে তৎকালীন নির্বাচন কমিশনের (বিচারপতি রউফের নেতৃত্বে গঠিত) অধীনে মাগুরা ও ঢাকা-১০ আসনে সংসদীয় উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। তৎকালীন সরকার ক্ষমতার যথেচ্ছা অপব্যবহার করে উভয় ক্ষেত্রেই বিজয় ছিনিয়ে নেয় এবং নির্বাচন কমিশন নিরপেক্ষ ও অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠানের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার পরিচয় দেয়। ফলে দেশব্যাপী তুমুল গণআন্দোলনের সৃষ্টি হয়। এ প্রেক্ষাপটে সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার প্রবর্তন করা হয়। ৩ মাস মেয়াদী তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার অধীনে পরবর্তীতে ১৯৯৬ সালে এবং ২০০১ সালে ২টি জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। প্রসঙ্গক্রমে ২০০১ সালের নির্বাচনকে ‘শালসা’ নির্বাচন কেন বলা হয়, তা দেশীয় রাজনীতির অনেক বোদ্ধাই অবহিত। যা হোক, ২০০১-৬ মেয়াদী বিএনপি শাসনামলের শেষ দিকে এক নির্দিষ্ট প্রধান বিচারপতিকে (অব) পরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক প্রধান হিসেবে প্রাপ্তির দুরভিসন্ধি নিয়ে সাংবিধানিক সংশোধনীর মাধ্যমে বিচারপতিদের অবসরের বয়সসীমা বৃদ্ধি করা হয়। এর ফলে দেশে আবার সরকারবিরোধী আন্দোলনে এক নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এরই প্রেক্ষিতে উক্ত প্রধান বিচারপতি (অব) হাসান উক্ত পদ গ্রহণে অস্বীকৃতি জানালে তৎকালীন সরকারদলীয় রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিনের কাঁধেই দলনিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়কের জোয়াল চাপিয়ে দেয়। ফলে দেশব্যাপী গণআন্দোলন আরও তুঙ্গে ওঠে। জনগণের মনোভাব অনুধাবন করে সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপে দেশবাসীর ওপর ফখরুদ্দীন-মইনুদ্দিন এর সরকার চেপে বসে। প্রসঙ্গত, ইয়াজউদ্দিনের তত্ত্বাবধায়ককালে ঘোরদলীয় সমর্থক এম এ আজীজকে (যিনি একই সঙ্গে বিচারপতি পদেও আসীন ছিলেন) প্রধান নির্বাচন কমিশনার পদে নিয়োগ দেয়া হয় । এই পদে স্বল্পকালীন অবস্থানকালে তিনি এক কোটি তেইশ লাখ ভুয়া ভোটার তালিকাভুক্ত করার খ্যাতি অর্জন করেন। অবশ্য ২০০৭-২০০৮ সালের অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকার আমলে প্রণীত ভোটার তালিকা থেকে উল্লিখিত ভুয়া ভোটারদের বাদ দেয়া হয়েছিল। নব গণতান্ত্রিক অভিযাত্রায় ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১, ২০০৮ ও ২০১৪ সালে যে ৫টি জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে, তার মধ্যে ’৯১, ৯৬ ও ২০০৮ সালে সম্পূর্ণ গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এ কয়টি নির্বাচন সরকার বা নির্বাচন কমিশন অবাঞ্ছিত কোন ভূমিকা পালন করেনি। তবে ২০০১ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনকে তেমন গ্রহণযোগ্য গণ্য করা হয় না। ওই নির্বাচনটির গ্রহণযোগ্যতা যতটুকুই ক্ষুণœœ হয়ে থাকুক তার জন্য তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার, নির্বাচন কমিশন, নিয়োজিত সেনা সদস্যরা এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কেউই দায়িত্ব এড়াতে পারে না । মোট কথা ওই ক্ষেত্রে খলনায়কের ভূমিকা পালনের দায়িত্ব এককভাবে নির্বাচন কমিশনের ওপর চাপানো য়ায় না । যাহোক, সে প্রশ্নবোধক নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে বিএনপি ৫ বছর দেশ পরিচালনা করে। অতঃপর সেনা সমর্থিত ২ বছর মেয়াদী অন্তর্বর্তী সরকারের শেষ লগ্নে ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামী সমর্থিত জোট বিজয়ী হয়। এ নির্বাচনে সরকার ও নির্বাচন কমিশন কোন প্রকার প্রভাব বিস্তার করেছে বলে কখনও কোন পক্ষ থেকে অভিযোগ উত্থাপিত হয়নি। ২০০৯-২০১৪ মেয়াদে আওয়ামী লীগ জোট দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পালন করে। ওই মেয়াদকালে সুপ্রীম কোর্টের রায়ের অনুসরণে জাতীয় সংসদ কর্তৃক সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করা হয়। তখন থেকে বিএনপি জোট ওই ব্যবস্থা পুনর্বহালের দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যেতে থাকে। ওই জোটের আহ্বানে কতিপয় প্রভাবশালী বিদেশী রাষ্ট্র- এমনকি জাতিসংঘ ও উভয় পক্ষের মধ্যে দূতিয়ালির উদ্যোগ নেয়। এসব ডামাডোলের এক পর্যায়ে তৎকালীন সরকারপ্রধান বিএনপি সাংসদদের মন্ত্রিসভায় (স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদসহ) ৫টি আসন দেয়ার প্রস্তাব করেন। এতেও সন্তুষ্ট না হয়ে ওই জোট প্রথমে নির্বাচন বর্জন ও পরবর্তীতে তা প্রতিরোধ করার প্রত্যয় ঘোষণা করে। বিরোধী জোটের ওই আন্দোলনের ফলে দেশব্যাপী সংঘাত ও সংঘর্ষ হয়। অনেক ভোটকেন্দ্র, পোলিং বুথ, ব্যালট বাক্স প্রভৃতি জ্বালিয়ে দেয়া হয়। আতঙ্ক সৃষ্টি করার জন্য ভোট কেন্দ্র জ্বালাতে গিয়ে বেশকিছু সংখ্যক স্কুল ও মাদ্রাসা ভবনও জ্বালিয়ে দেয়া হয়। এমনকি অনেক ভোটার, পোলিং এজেন্ট ও নির্বাচনী কর্মকর্তাও আহত-নিহত হন। বিরোধী জোটের নির্বাচন বর্জনের প্রতিশ্রুতি সফল হলেও তা প্রতিহত করার প্রয়াস সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়। ওই নির্বাচনে বিরোধী প্রার্থী না থাকায় প্রায় অর্ধেকসংখ্যক প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়। সার কথা, শক্তিশালী বিরোধী জোটের বর্জন ও প্রতিরোধের কারণে ১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে আদর্শ নির্বাচন বলে মেনে নেয়া যায় না। তবে দীর্ঘস্থায়ী অশান্ত পরিস্থিতির পরিবর্তে নির্বাচনের মাধ্যমে যে সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়, তাকেই জনগণ মন্দের ভাল হিসেবে গ্রহণ করে নেয়। তবে নির্বাচনে কমিশনের ভূমিকার ব্যাপারে বিরোধী পক্ষ তেমন কোন আপত্তি উত্থাপন না করে প্রতিনিয়ত সরকারকে অনির্বাচিত ও অবৈধ বলে অভিহিত করে আসছে। কমিশনের জন্য একমাত্র বিকল্প ছিল পদত্যাগ করে দেশকে অসাংবিধানিক ও নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দেয়া, যা না করে কমিশন দেশকে অসাংবিধানিক ও নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি থেকে রক্ষা করেছে। স্থানীয় সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠানে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা সন্বন্ধে বালা যায় যে, ২০০৯ সালে নির্বাচিত হয়ে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করার পর শামসুল হুদা কমিশনের তত্ত্বাবধানে চট্টগ্রাম পৌর কর্পোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সেনা মোতায়েন না করা হলে আওয়ামী সরকারের আমলে নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে না বলে বিএনপি অবিরাম প্রচার চালাতে থাকে। কমিশন সেনা মোতায়েনের পক্ষে সিদ্ধান্ত না নেয়ায় আওয়ামী লীগের অনুগত নির্বাচন কমিশনের অধীনে নির্বাচনের ফলাফল জাতি মেনে নেবে না এবং শামসুল হুদা কমিশনকে জাতি প্রত্যাখ্যান করেছে বলে বিএনপি প্রতিনিয়ত বক্তব্য দিতে থাকে। অবশেষে নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থী বিজয়ী হলে নির্বাচন কমিশন ও সরকারের বিরুদ্ধে বিএনপি কর্তৃক উত্থাপিত অবৈধ হস্তক্ষেপের অভিযোগ মিথ্যা, অলীক ও অসার প্রমাণিত হয় । স্মরণ করা যায় যে, বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অধীনে নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, কুমিল্লা ও চট্টগ্রামে পৌর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নারায়ণগঞ্জ পৌর নির্বাচনে সেনা মোতায়েন না করার অযুহাত তুলে বিএনপি নির্বাচনের দিন প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নেয়। অথচ সে নির্বাচনে সরকারদলীয় প্রার্থীকে পরাজিত করে স্বতন্ত্র প্রার্থী আইভী বিজয়ী হন। কমিশন হস্তক্ষেপ করলে সরকারদলীয় প্রার্থীর পক্ষে বিজয় লাভ করা অসম্ভব হতো না। এ নির্বাচনী ফল থেকেই প্রমাণিত হয় যে, ওই নির্বাচনে কমিশন কোন অবৈধ হস্তক্ষেপ করেনি। গাজীপুর পৌর নির্বাচনের সময়ও বিএনপি সেনা মোতায়েনের দাবি তুলে নির্বাচনের মাঠ গরম করে তোলে । নির্বাচন কমিশন সরকারের অনুগত এবং পক্ষপাতমূলক আচরণ করছে বলে অনর্গল অভিযোগ তুলতে থাকে। এমনকি নির্বাচনের দিন ৪ বার সংবাদ সম্মেলন করে দলীয় বিভিন্ন মুখপাত্র একই অভিযোগের রেকর্ড বাজাতে থাকে। ভোট গণনা চলাকালেও তারা গণনায় কারচুপির অভিযোগ তুলে রাজনৈতিক আসর সরগরম করে তোলে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সরকারদলীয় প্রার্থীকে হারিয়ে বিএনপি প্রার্থী বিজয়ী হওয়ার ফলে তাদের কমিশন বিরোধী ও সরকার বিরোধী অভিযোগ অলীক, মিথ্যা ও বানোয়াট বলে প্রমাণিত হয়। কুমিল্লা পৌর নির্বাচনের ক্ষেত্রেও বিএনপি সেনা মোতায়েনের দাবি তোলে এবং সেনা মোতায়েন না হলে সরকারী দলের প্রার্থীর পক্ষে নির্বাচন কমিশন অবৈধ হস্তক্ষেপ করবে বলে প্রচারণা চালায়। কিন্তু নির্বাচন শেষে দেখা যায় যে, সরকারী প্রার্থীকে হারিয়ে বিএনপি প্রার্থী জয়ী হয়। এতেই প্রমাণিত হয় সরকার বা নির্বাচন কমিশন নির্বাচনে কোন অবৈধ প্রভাব বিস্তার করেনি। কমিশনের বিরুদ্ধে এ হীন অপপ্রচার যেন বিরোধী দলের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। অতঃপর ঢাকা দক্ষিণ ও ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। দলমত নির্বিশেষে সকল প্রার্থীই নির্বাচনে যার যার সাধ্য অনুযায়ী প্রচারণা চালায় এবং ভোটারদের সঙ্গে যোগাযোগ করে ভোট দাবি করে। এ ক্ষেত্রে সরকারী দল কিছুটা অসুবিধা জনক অবস্থানে থাকে। কেননা তাদের প্রবীণ ও প্রধান নেতাদের সরকারের সুবিধাজনক পদাধিকারী হওয়ায় নির্বাচনী প্রচারণায় অংশগ্রহণ করা থেকে বিরত থাকতে হয় । ঢাকার ২টি পৌর নির্বাচনে বিরোধীদের সকল পর্যায়ের নেতারাই প্রচারণায় বা ভোটযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন- কিন্তু সরকারী দলের কোন নেতা-নেত্রী সরকারী পদাধিকারী অবস্থায় থেকে নির্বাচনী প্রচারণায় অংশগ্রহণ করে নির্বাচন কমিশনের নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন করেছেন বলে কোন অভিযোগ পাওয়া যায়নি। অপর দিকে বিরোধী দলের প্রার্থীদের প্রচারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বা সরকারী দলের কর্মীরা বাধা দিয়েছে বলেও অভিযোগ পাওয়া যায়নি। তথাপি অনির্বাচিত সরকারের অধীনে এবং আজ্ঞাবহ নির্বাচন কমিশনের তত্ত্বাবধানে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভাবনাময় এই অযুহাত তুলে নির্বাচনের দিনদুপুর বারোটার প্রাক্কালে বিএনপি প্রার্থীরা নিজ নিজ প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নেয়। উল্লেখ্য, উভয় সিটি কর্পোরেশনেই সরকারদলীয় মেয়র প্রার্থী বিজয়ী হন। ২০১৬ সালে দেশব্যাপী ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। একই সময়ে সমগ্র দেশব্যাপী তৃণমূল পর্যায়ে এ বিপুলসংখ্যক ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন এর আগে কখনও হয়নি। তদুপরি এবারই সর্বপ্রথম দলীয় প্রতীকে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ওই নির্বাচনকে কোনমতেই অবাধ, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন বলা যায় না। অনেক ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে সংঘাত ও সহিংসতা সুষ্ঠু নির্বাচনী পরিবেশ বিনষ্ট করে দেয়। উল্লেখ্য, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে রাজনীতি অপেক্ষা স্থানীয়ভাবে বংশীয়, গোত্রীয় ও এলাকাভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গি ব্যাপক ভূমিকা রাখে। নির্বাচন কমিশন যত নিরপেক্ষ ভূমিকাই রাখুক না কেন, রাজধানীতে অবস্থান করে সীমিত সংখ্যক কমিশনারের পক্ষে স্থানীয়ভাবে সৃষ্ট নির্বাচনী দাঙ্গা, হাঙ্গামা কঠোরহস্তে দমন করা সম্ভব নয়। পৌর নির্বাচনগুলোর বিশ্লেষণ থেকে দেখা যায় যে, বর্তমান আওয়ামী শাসনামলে যত পৌর নির্বাচন হয়েছে তার মধ্যে চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, কুমিল্লা, রাজশাহী এবং আরও কতিপয় স্থানে বিরোধী বিএনপি প্রার্থী বিজয়ী হয়। চট্টগ্রামের সাম্প্রতিক নির্বাচন ঢাকার ২টি পৌর নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থিতা প্রত্যাহার করায় সরকারদলীয় প্রার্থী নির্বিঘেœ জয়ী হয়। সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জ পৌর নির্বাচনকে সব দৃষ্টিকোণ থেকেই একটি আদর্শ নির্বাচন বলে জাতি মেনে নিয়েছে। তা হলে নির্বাচনে জয়ী না হওয়া পর্যন্ত বিএনপি যে নির্বাচন কমিশনকে বলির পাঁঠা বানানোর অপপ্রয়সে লিপ্ত হয়, তা কি নিজেদের অনুকুলে কাজ করবে এমন কমিশনপ্রাপ্তির প্রত্যাশা নিয়ে? আলোচনার প্রথম দিকে মাগুরা ও ঢাকা-১০ আসনের সংসদীয় উপনির্বাচনে বিএনপি সরকারে থেকে যে ভেলকিবাজি দেখিয়েছিল, তেমন একটি উদাহরণও কি আওয়ামী শাসনামলের কোন নির্বাচনে পাওয়া যাবে? সবাই বলবেন- না পাওয়া যাবে না। দেখা গেল যে, সাম্প্রতিক ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ হয়নি। তবে এর দায়-দায়িত্ব এককভাবে নির্বাচন কমিশনের ওপর চাপানো যায় না। বরং এর জন্য দায়ী আর্থ-সামাজিক ও এলাকাভিত্তিক প্রভাব বিস্তারের অপপ্রয়াস এবং সাধারণভাবে দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির অসুস্থ প্রবণতা। যে কয়টি পৌর নির্বাচনের ব্যাপারে আলোচনা করা হলো, তার কোনটিতেই নির্বাচন কমিশনের অবৈধ হস্তক্ষেপের প্রমাণ পাওয়া যায়নি। কতিপয় নির্বাচনের ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশন কর্তৃক সম আচরণ প্রদর্শনে ব্যর্থতার অভিযোগ তুলে বিএনপি প্রার্থী প্রত্যাহার করে নেয়ার ফলে বিকল্প সরকারদলীয় প্রার্থী অনায়াসে জয়লাভ করে। কিন্তু অনেকগুলো পৌর নির্বাচনের ক্ষেত্রে বিএনপি কর্তৃক সরকার ও নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে প্রতিনিয়ত অবৈধ হস্তক্ষেপের অভিযোগ তোলা ও পরিণামে ওই দলীয় প্রার্থীর বিজয়ী হওয়াতে সে সকল অভিযোগ বানোয়াট ও ভিত্তিহীন বলে প্রমাণিত হয়। এ বিশ্লেষণ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, ’৯১-৯৬ সময়কালীন বিএনপি শাসনামলে অনুষ্ঠিত মাগুরা ও ঢাকা-১০ আসনের সংসদীয় উপনির্বাচনে তৎকালীন সরকার ও নির্বাচন কমিশন অবৈধ হস্তক্ষেপের দায়ে দোষী। ২০০১ এর নির্বাচনে তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার, নির্বাচন কমিশন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। পৌর নির্বাচনসমূহে কমিশনের বিরুদ্ধে সরকারের আজ্ঞাবহ ও অনুগত ভূমিকা পালনের যত অভিযোগ বিএনপি তুলেছে, তা অনেকটা ওই দলের নেতাদের অভ্যাসগত, যা তাদের দলীয় পার্থীর বিজয়ী হওয়াতেই প্রমাণিত। যে সব নির্বাচনের কথা আলোচিত হলো তার প্রেক্ষিতে বিশেষ করে সাম্প্রতিককালে অনুষ্ঠিত নারায়ণগঞ্জ পৌর নির্বাচন দৃষ্টে এ কথা বলা যায় যে, অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য স্বাধীন ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন একমাত্র গ্যারান্টি নয়। তজ্জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক দলসমূহ, তাদের প্রার্থী ও কর্মী বাহিনী, গণমাধ্যম, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং সর্বোপরি দেশের জনগণের মধ্যে অবাধ, শান্তিপূর্ণ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের পক্ষে বজ্র কঠিন দৃঢ় প্রত্যয়। আমরা জানি, সেই পাকিস্তানী ঔপনিবেসিক শাসনামলে ১৯৫৪ সালে অনুষ্ঠিত প্রাদেশিক নির্বাচন ও ১৯৭০ সালে অনুষ্ঠিত পাকিস্তানের উভয় অংশের নির্বাচন ছিল সুষ্ঠু, অবাধ ও গ্রহণযোগ্য। ওই দুটি নির্বাচনে সরকার বা নির্বাচন কমিশন-কারও বিরুদ্ধে নির্বাচনে অবৈধ হস্তক্ষেপের অভিযোগ ওঠেনি। উল্লেখ্য, ওই সময় ও পরিবেশে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য রাজনীতিকদের আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ার প্রয়োজন হয়নি। ১৯৯১, ১৯৯৬ ও ২০০৮ সালে নির্বাচন মোটামুটিভাবে অবাধ ও গ্রহণযোগ্য ছিল। তবে ২০০১ সালের নির্বাচন খানিকটা প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছিল। আর ২০১৪ সালের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এক বিতর্কিত পরিস্থিতিতে প্রধান বিরোধী দল কর্তৃক নির্বাচন বর্জনের প্রেক্ষপটে। তবে সেক্ষেত্রেও নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা নিয়ে তেমন জোরালো আপত্তি উত্থাপিত হতে দেখা যায়নি। কমিশনের আনুপূর্বিক ভূমিকা পর্যালোচনা করলে বর্তমানে দেশব্যাপী স্বাধীন ও নিরপেক্ষ কমিশনের দাবিতে যে রাজনৈতিক উত্তাপ সৃষ্টি হয়েছে, তাকি সঙ্গত ও যৌক্তিক মনে হয়? দেশে সক্রিয় ও স্থবির যতগুলো রাজনৈতিক দল আছে, তাদের প্রতিটির ডজন ডজন নেতাকে আহ্বান করে মহামান্য রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নির্বাচন কমিশন গঠনের পদ্ধতি ও প্রক্রিয়া সম্পর্কে তাদের প্রস্তাব বা পরামর্শ গ্রহণ করা কি সামান্য ঘূর্ণিবার্তাকে প্রলয়ঙ্করী ও বিধ্বংসী ঘূর্ণিঝড়ের রূপ দান করার মতো মনে হয় না? আর প্রধান বিরোধী দল কর্তৃক সকল দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে আসন্ন নির্বাচন কমিশন গঠনের জোড়ালো দাবি উত্থাপন এবং এর ব্যত্যয়ে দেশব্যাপী গণআন্দোলন গড়ে তোলার হুঙ্কার দেশের রাজনীতিতে অনাবশ্যক উত্তাপ সৃষ্টি ও স্থিতিশীলতা বিনষ্টের অপপ্রয়াস বলেই মনে হয়। সেই সুদূর ১৯৪৭ থেকে আজ পর্যন্ত কি কখনও সকল দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশন গঠিত হওয়ার নজির খুঁজে পাওয়া যায় ? লেখক : সাবেক যুগ্ম সচিব
×