ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

অনন্যসাধারণ রাজনীতিকের বিদায়

প্রকাশিত: ০৩:২১, ৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

অনন্যসাধারণ রাজনীতিকের বিদায়

বর্ষীয়ান অভিজ্ঞ রাজনীতিক, দক্ষ পার্লামেন্টারিয়ান, স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের প্রতি অবিচল আস্থাবান, মুক্তিযুদ্ধের প্রতি নিবেদিতপ্রাণ, দেশপ্রেমিক সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত আর নেই। রাজধানীর একটি হাসপাতালে রবিবার ভোরে মাত্র ৭১ বছর বয়সে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। বেশ কিছুদিন থেকেই ভুগছিলেন অসুস্থতায়। উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশেও গিয়েছিলেন। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত এমনই এক বিরল ব্যক্তিত্বের অধিকারী প্রাজ্ঞ পার্লামেন্টারিয়ান যে, অসুস্থতার কাছে তিনি কখনই পরাজয় মেনে নেননি। বিশেষ করে দেশের স্বাধীনতা ও সংবিধান সমুন্নত এবং অক্ষুণœ রাখার অনিবার্য প্রয়োজনে সর্বদাই সরব ও সোচ্চার হয়ে উঠেছেনÑ কী জাতীয় সংসদে, কী গণমাধ্যমে। দেশে গণতান্ত্রিক রাজনীতির ধারাবাহিকতা রক্ষাসহ সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় তিনি সর্বদাই ছিলেন অকুতোভয় ও নির্ভীক। জেল-জুলুমের ভয় ও নির্যাতনকে আমলে নেননি কোন সরকারের আমলেই। কেননা, তার রাজনীতির ভিত্তি প্রোথিত ছিল একেবারে তৃণমূলে, জনগণের দোরগোড়ায়। রাজনীতিক হিসেবে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত গণমানুষের কতটা প্রিয় ছিলেন তার প্রমাণ প্রত্যক্ষ ভোটেই পাওয়া গেছে বার বার। ১৯৭৯, ১৯৮৬, ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১, ২০০৮ আর ২০১৪ সালের নির্বাচনগুলোতে তাঁকে বিমুখ করেনি জনতা। ১৯৭৩ সালে তাঁকে ভোটে হারানোর চেষ্টা হয়েছিল। তবে নির্বাচনের ফলাফলের বিরুদ্ধে মামলা করে তিনি জিতে যান এবং সংসদে বসেন। আর তাই তাকে অবিসংবাদিত জনতার নেতা বলা যেতেই পারে। এর বাইরেও সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত অসাধারণ ছিলেন জাতীয় সংসদে। তার অনন্যসাধারণ বাগ্মিতা, তীক্ষè যুক্তি উপস্থাপনা, সর্বোপরি রঙ্গ-ব্যঙ্গসহকারে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার কোন জুড়ি কি আসলেই ছিল কিংবা আছে? দীর্ঘ ৫৯ বছরের বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনে বিভিন্ন সময় ন্যাপ, একতা পার্টি, গণতন্ত্রী পার্টি, বাকশালের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকলেও আজীবন বামপন্থী রাজনীতির প্রতি ছিলেন আস্থাশীল। শেষ জীবনে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে জড়িত থেকে রেলমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করলেও দেশ ও জনগণের কল্যাণার্থে সব সময় ছিলেন উচ্চকণ্ঠ ও নিবেদিত। তার আমলে বাংলাদেশ রেলওয়ে যথার্থ অর্থে গতিশীল ও গণমুখী হতে সক্ষম হয়েছে। অবশ্য পরে রেলের অনিয়ম, দুর্নীতি নিয়ে কিছু অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে পদত্যাগ করেন তিনি। পরে তদন্তে অবশ্য এর সত্যতা পাওয়া যায়নি। অনতিপরে প্রধানমন্ত্রী তাকে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক স্থায়ী কমিটির সভাপতি নিযুক্ত করেছিলেন। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত এই গুরুদায়িত্ব অত্যন্ত দক্ষতা ও সততার সঙ্গে পালন করে গিয়েছেন, যার তুলনা কেবল তিনি। স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের প্রথম সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ছিলেন নবম সংসদে পঞ্চদশ সংবিধান সংশোধন কমিটির কো-চেয়ারম্যান। বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নের ক্ষেত্রে তার ছিল অসামান্য ভূমিকা। জাতীয় চার মূলনীতিÑ জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্রের প্রতি তার আস্থা ও বিশ্বাস ছিল আজীবন এবং এই প্রশ্নে কখনই আপোস করেননি। সর্বতোভাবে তিনি ছিলেন অসাম্প্রদায়িক চিন্তা-চেতনার প্রতীক দেশপ্রেমিক জাতীয়তাবাদী নেতা। তার মৃত্যুতে অপূরণীয় ক্ষতি হলো দেশ ও জাতির। সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার প্রত্যন্ত এক অজপাড়াগাঁ থেকে উঠে এসে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন একজন জাতীয় রাজনীতিক হিসেবে, যা এক কথায় সফল ও সুবর্ণম-িত। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক যথার্থই বলেছেন যে, রাজনৈতিক ইতিহাসে তিনি এক বর্ণাঢ্য ব্যক্তিত্ব। পার্লামেন্টারিয়ান হিসেবে নাম্বার ওয়ান, অদ্বিতীয়। সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের মৃত্যুতে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতাসহ অনেকেই শোক জ্ঞাপন করেছেন। সঙ্গতকারণেই জনকণ্ঠ পরিবারও তার মৃত্যুতে শোকাহত। তার মৃত্যুতে পরিবারের সদস্যদের প্রতি জানাই গভীর সমবেদনা। প্রকৃতপক্ষে সুরঞ্জিত চিরঞ্জীব।
×