ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

দেশে বছরে ৬ লাখ নারীর গর্ভপাত, চিকিৎসাসেবা পাচ্ছেন মাত্র ৪০ শতাংশ

প্রকাশিত: ০৫:৫১, ৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

দেশে বছরে ৬ লাখ নারীর গর্ভপাত, চিকিৎসাসেবা পাচ্ছেন মাত্র ৪০ শতাংশ

জান্নাতুল মাওয়া সুইটি ॥ অপরিকল্পিত ও অনিরাপদ গর্ভপাতের পরিমাণ বাড়ছে দিন দিন। বেসরকারী এক সমীক্ষা অনুযায়ী দেশে প্রতি বছর প্রায় ৬ লাখ নারীর গর্ভপাত হচ্ছে, যার ৪০ শতাংশ গর্ভপাতের পর চিকিৎসাসেবা পায়। চিকিৎসকরা বলছেন, বেশিরভাগ নারীই জানেন না গর্ভপাতের সঠিক চিকিৎসা। ফলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই শারীরিক নানা জটিলতায় ভুগছেন তারা। অনিরাপদ গর্ভপাতের ফলে জরায়ুতে ইনফেকশন অথবা ক্ষতের সৃষ্টি, অতিরিক্ত রক্তক্ষরণসহ মাতৃমৃত্যু ঘটে থাকে। আফরিন আক্তারের বয়স ২০ বছর। রাজধানীর মিরপুরে একটি ভাড়া বাসায় থাকেন তার স্বামীকে নিয়ে। স্বামীর উপার্জনে সংসারের চাকা ঘোরে না বলে আফরিন সেলাই মেশিনের চাকা ঘুরিয়ে সংসারে গতি আনার চেষ্টা করছেন। এ দম্পতি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন সংসারে গতি না আসা পর্যন্ত নতুন অতিথিকে পৃথিবীর আলো দেখাবেন না। কিন্তু অনাকাক্সিক্ষতভাবে আফরিনার গর্ভে বেড়ে উঠেছিল ১২ সপ্তাহের বাচ্চা। অর্থনৈতিক দৈন্যদশার কারণে শেষ পর্যন্ত আফরিন তার নিজের ইচ্ছায় রাজধানীর একটি বেসরকারী ক্লিনিকে গিয়ে গর্ভপাত করান। কিন্তু গর্ভপাতের পর আফরিন শারীরিক ও মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েন। তিনি বলেন, ‘গর্ভপাতের পর টানা ১২ দিন রক্তস্রাব হয়েছে। প্রচ- পেটেব্যথা করত। গর্ভপাতের এক মাস কেটে গেলেও আমি এখনও পুরোপুরি সুস্থ হইনি। ভারি কাজ করতে পারি না, শরীর দুর্বল লাগে।’ দেশে গর্ভপাত সরাসরি আইনসিদ্ধ না হলেও ১৯৭৪ সালে মেনস্ট্রুয়াল রেগুলেশন নামে একটি নিয়ম চালু করা হয়। গর্ভপাতজনিত অনিরাপদ মাতৃমৃত্যু এড়াতে এবং নারীর স্বাস্থ্য সুরক্ষায় এ নিয়ম চালু করা হয়। অসচেতনতার কারণে অনেকেই এখন বিজ্ঞাপন দেখে চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়াই গর্ভপাতের ওষুধ গ্রহণ করছেন। অনেকেই আবার অদক্ষ ও অপ্রশিক্ষিত কারও কাছ থেকে এমআরের মতো ব্যবস্থা নিচ্ছেন। এ বিষয়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের শিশু বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডাঃ এল ই ফাতমী জনকণ্ঠকে বলেন, ‘অনেক সময় বলা হচ্ছে যে, সাইটোমিক্স খেলে বাচ্চা নষ্ট হয়ে যাবে। কিন্তু ১২ সপ্তাহের পর যদি কোন মা সাইটোমিক্স অথবা এমএম কিট খায় সেক্ষেত্রে তার মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি থেকে যায়। এছাড়া এমআর করার ফলে এমনও হয়, গর্ভপাতের ফলে জরায়ু ফেটে যায়। ভেতরে বাচ্চাটাও মরে যায়। মায়ের সেপ্টিসেমিয়া হয়ে মাও মারা যায়। এখন তিন-চার মাস হয়ে যাওয়ার পর অনেক মা হাসপাতালে আসেন এমআর করাতে অথবা অনেকেই গর্ভবতী না হওয়া সত্ত্বেও শুধুমাত্র মাসিক অনিয়মিত হওয়ার কারণে গর্ভধারণ করেছেন ভেবে ফার্মেসিতে গিয়ে ওষুধ কিনে খাচ্ছেন। ফলে প্রচুর রক্তস্রাবের ফলে মায়ের মৃত্য হওয়ার আশঙ্কা বাড়ছে। সেই সঙ্গে প্রথম বাচ্চার ক্ষেত্রে কেউ যদি গর্ভপাত করায় সেক্ষেত্রে মায়ের পরবর্তী গর্ভধারণে ঝুঁকি থেকেই যায়।’ অনিরাপদ গর্ভপাতের কারণে দীর্ঘকালীন স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ছেন নারীরা। দেশের প্রায় ১৪ শতাংশ মাতৃমৃত্যুর অন্যতম কারণ অনিরাপদ গর্ভপাত। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী দেশের ৩৩ শতাংশ গর্ভধারণ অপরিকল্পিত। ফলে বাড়ছে গর্ভপাতের ঘটনাও। সরকারী ও বেসরকারী সুযোগ থাকা সত্ত্বেও অজ্ঞানতার কারণে অনেকেই গর্ভপাতে অনিরাপদ পদ্ধতি ব্যবহার করে স্বাস্থ্যঝুঁকির সম্মুখীন হচ্ছেন। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী গর্ভপাত ও এর পরবর্তী চিকিৎসা গ্রহণের ফলে নারীর স্বাস্থ্যঝুঁকি কমানো সম্ভব বলে ধারণা চিকিৎসকদের। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত বছর এ হাসপাতালে এমআর করতে এসেছেন ২ হাজার ৬৪৪ জন নারী। এর মধ্যে এমআরপরবর্তী চিকিৎসা গ্রহণ করেছেন মাত্র ১৬৩ জন। তবে এ বিষয়ে সরকারী ও বেসরকারীভাবে কোন হিসাব পাওয়া যায়নি। চিকিৎসকরা বলছেন, সামাজিক প্রতিবন্ধকতার কারণে এ বিষয়ে এখনও সহজ হতে পারছেন না নারীরা। ফলে অনিরাপদ গর্ভপাত ও স্বাস্থ্যঝুঁকিও বাড়ছে। অনিরাপদ গর্ভপাত প্রসঙ্গে রাজধানীর মনোয়ারা হাসপাতালের গাইনি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডাঃ মোসাম্মৎ নুরুন নাহার জনকণ্ঠকে বলেন, অনেকেই এখন চিকিৎসকের পরামর্শ না নিয়ে গর্ভপাতের ওষুধ খেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ফলে হাসপাতালে আসছেন। প্রচুর রক্তস্রাব হওয়ার কারণে বাধ্য হয়ে আমরা হাসপাতালে ভর্তি করছি। বিনা চিকিৎসায় গর্ভপাত একটি মারাত্মক বিষয়। গর্ভপাতের পর রোগীকে পরবর্তী চিকিৎসা অবশ্যই মেনে চলতে হবে। তাতে শারীরিক জটিলতা কমবে বলে জানান তিনি। সংশ্লিষ্টরা বলেন, বিশ্বের অনেক দেশের মতো বাংলাদেশেও গর্ভপাত অবৈধ। ফলে চিকিৎসকরা সহজেই গর্ভপাত করাতে রাজি হন না। এর কারণে সরকারী বিভিন্ন হাসপাতালে পরিবার পরিকল্পনা সেবার নামে গর্ভপাত ঘটাচ্ছেন রোগীরা। অন্যদিকে বিভিন্ন বেসরকারী ক্লিনিক তো রয়েছেই। তবে এর বাইরে একটি বড় অংশ ওষুধের মাধ্যমে বাড়িতেই গর্ভপাত ঘটাচ্ছেন। কিভাবে গর্ভপাতের হার কমানো যায় সে বিষয়ে প্রসূতি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘স্কুল-কলেজে যৌন শিক্ষা, পারিবারিক বন্ধন সুদৃঢ় করা, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ বজায় রাখা ও সঠিকভাবে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতিই এসব ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে।
×