ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

কাঠামোর অভাবে সালিশী আদালত যথাযথ কাজ করতে পারছে না

প্রকাশিত: ০৫:৪৫, ৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

কাঠামোর অভাবে সালিশী আদালত যথাযথ কাজ করতে পারছে না

স্টাফ রিপোর্টার ॥ বিরোধ নিষ্পত্তিতে প্রচলিত সালিশ ব্যবস্থার ইতিবাচক দিকের পাশাপাশি সুনির্দিষ্ট ফ্রেমওয়ার্ক না থাকায় অনেক সীমাবদ্ধতাও রয়েছে। সেজন্য টেকসই সামাজিক সালিশ ব্যবস্থার আইনী স্বীকৃতির মাধ্যমে ন্যায়বিচারে সকল মানুষের অভিগম্যতা ত্বরান্বিতকরণ এখন সময়ের চাহিদা। শনিবার রাজধানীর হোটেল সোনারগাঁওয়ে ‘ন্যায়বিচারে অভিগম্যতা’ শীর্ষক জাতীয় সম্মেলনে বিশিষ্টজনরা এসব কথা বলেন। বক্তারা আরও বলেন, সভ্যতার শুরু থেকেই বিরোধ নিষ্পত্তিতে সালিশ ব্যবস্থা কার্যকর রয়েছে। কিন্তু সময়ের প্রয়োজনে এই সালিশ ব্যবস্থাকে একটি যথাপোযুক্ত আইনী কাঠামোর আওতায় আরও শক্তিশালী করা প্রয়োজন। পাশাপাশি আদালতের বাইরে বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য সামাজিক সচেতনতাও বাড়াতে হবে। এতে আদালতগুলো মামলাজট কমার পাশাপাশি বিচারপ্রার্থীদের ভোগান্তি অনেকাংশে কমে আসবে। বেসরকারী সংস্থা ওয়েভ ফাউন্ডেশন, মাদারীপুর লিগাল এইড এ্যাসোসিয়েশন (এমএলএএ) ও নাগরিক উদ্যোগ যৌথভাবে এই সম্মেলনের আয়োজন করে। তিনপর্বে অনুষ্ঠিত দিনব্যাপী সম্মেলনে বক্তারা আরও বলেন, বর্তমানে দেশের সব ধরনের আদালতে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ছিল ৩১ লাখ ৫৬ হাজার ৮৭৮। গবেষণায় এসেছে, জেলা আদালতগুলোতে ফৌজদারি মামলার ৪২ ভাগ নিষ্পত্তি হতে যেখানে সময় লাগে ১ বছর বা তারও কম, সেখানে অবশিষ্ট ৫৮ ভাগ মামলা নিষ্পত্তি হতে গড়ে ৪ বছরেরও বেশি সময় লাগছে। এভাবে চলতে থাকলে ২০২০ সালে মামলাজট ৫০ লাখে পৌঁছতে পারে। এ জন্য টেকসই সামাজিক সালিশ ব্যবস্থার আইনী স্বীকৃতির মাধ্যমে ন্যায়বিচারে সকল মানুষের অভিগম্যতা ত্বরান্বিতকরণ এখন সময়ের চাহিদা। তিন পর্বে অনুষ্ঠিত সম্মেলনের উদ্বোধনী অধিবেশনে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন সুপ্রীমকোর্ট লিগ্যাল এইড কমিটির চেয়ারম্যান বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম। তিনি তার বক্তব্যে বলেন, দেশের আদালতগুলো মামলার ভারে ন্যূব্জ হয়ে আছে। নানা ভোগান্তি ও দীর্ঘসূত্রতার কারণে জনগণও প্রাতিষ্ঠানিক বিচারব্যবস্থার ব্যাপারে আগ্রহ হারাচ্ছে। বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির প্রক্রিয়াগুলো নিয়ে এনজিওদের কার্যক্রমকে সমর্থন জানিয়ে তিনি বলেন, এক্ষেত্রে জনগণকে উদ্বুদ্ধকরণে এনজিওগুলোকে আরও উদ্যোগ নিতে হবে। সালিশের প্রস্তাবিত ফ্রেমওয়ার্ক সরকার বিবেচনায় নিবেন আশা করে তিনি সাধারণ মানুষকে আইনী সহায়তা প্রদানে সরকারী-বেসরকারী সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। সম্মেলনে তিন পর্বে পৃথক তিনটি প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ওয়েভ ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক মহসিন আলী, এমএলএএ’র প্রধান সমন্বয়কারী খান মোহাম্মদ শহীদ এবং নাগরিক উদ্যোগের প্রধান নির্বাহী জাকির হোসেন। সম্মেলন সঞ্চালনায় ছিলেন সিএলএস-এর টিম লিডার জেরম সায়ের। দিনব্যাপী সম্মেলনে আরও বক্তব্য রাখেন আইন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মুস্তাফিজুর রহমান, ডিএফআইডি’র গবর্নেন্স এ্যাডভাইজার জোয়েল হার্ডিং, ইউএনডিপি’র কর্মকর্তা সরদার এম আসাদুজ্জামান, বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি এ্যাডভোকেট ফাওজিয়া করিম ফিরোজ, ব্লাস্টের নির্বাহী পরিচালক ব্যারিস্টার সারা হোসেন, বরিশাল জেলা আইনজীবী সমিতির জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মানবেন্দ্র বটব্যাল, ব্রতীর প্রধান নির্বাহী শারমিন মুর্শিদ, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন, জাতীয় আইন সহায়তা কেন্দ্রের উপ-পরিচালক আবেদা সুলতানা প্রমুখ। অতিরিক্ত সচিব মোঃ মুস্তাফিজুর রহমান তার বক্তব্যে বলেন, দেশে সামাজিক বিরোধের শতকরা ৮০ ভাগই স্থানীয় পর্যায়ে নিষ্পত্তি হয়। এরপরও আদালতের মামলাজট প্রকট হয়ে দাঁড়িয়েছে। সালিশ ব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী করে মামলাজট কমিয়ে আনা সম্ভব। জোয়েল হার্ডিং বলেন, বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থায় চাহিদার তুলনায় স্থানীয় জনগণের অভিগম্যতা যথেষ্ট কম। সরকারের পাশাপাশি নাগরিক সমাজের সংগঠনগুলো নানা প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে এক্ষেত্রে ভূমিকা রাখছে। স্থানীয় সালিশের একটি ফ্রেমওয়ার্ক সুনির্দিষ্ট করা এবং এর সরকারী স্বীকৃতির প্রয়োজনীয়তার ওপরও তিনি গুরুত্বারোপ করেন। এ্যাডভোকেট ফাওজিয়া করিম ফিরোজ বলেন, সামাজিক সালিশ ব্যবস্থাকে টেকসই করতে হলে শিক্ষাব্যবস্থার সিলেবাসে এ বিষয়টিকে অন্তুর্ভুক্ত করতে হবে। এ ছাড়া পুলিশকে কোনভাবেই সালিশ ব্যবস্থায় যুক্ত করা যাবে না। এতে ন্যায়বিচার ব্যহত হওয়ার সুযোগ হতে পারে। পাঁচ সুপারিশ ॥ সম্মেলন থেকে পাঁচটি সুনির্দিষ্ট সুপারিশ করা হয়েছে। সুপারিশগুলো হচ্ছে- নাগরিক সমাজের পক্ষে টেকসই সামাজিক সালিশ ব্যবস্থার সুনির্দিষ্ট ফ্রেমওয়ার্ক-এর প্রস্তাবনা চূড়ান্ত করা, আপোসযোগ্য বিরোধ মীমাংসায় সরকারী উদ্যোগে ফ্রেমওয়ার্কসহ টেকসই সামাজিক সালিশ ব্যবস্থার পৃথক আইনী বিধান করা, এনজিওদের সহায়তায় পরিচালিত আইনী সচেতনতা, সামাজিক ও অফিসকেন্দ্রিক সালিশ ও মামলা পরিচালনায় সহায়তা এবং ডিলাকসহ সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রসমূহে কেস রেফারেল কার্যক্রম বৃদ্ধি করা, সরকারী উদ্যোগ এবং ইউএনডিপি-এর আর্থিক ও কারিগরি সহায়তায় পরিচালিত গ্রাম্য আদালত সক্রিয়করণ কার্যক্রম দেশব্যাপী বৃদ্ধি করার পাশাপাশি সালিশী পরিষদ সক্রিয়করণে উদ্যোগ গ্রহণ করা, ন্যায়বিচারে জনগণের অভিগম্যতা নিশ্চিতকরণে সরকার ও সংশ্লিষ্ট পক্ষসমূহের উদ্যোগে প্রাতিষ্ঠানিক বিচার ব্যবস্থা শক্তিশালীকরণে আশু পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
×