ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

অনুপ্রবেশ বন্ধ ও জঙ্গী কানেকশন ছিন্ন করাই লক্ষ্য

প্রকাশিত: ০৫:৪২, ৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

অনুপ্রবেশ বন্ধ ও জঙ্গী কানেকশন ছিন্ন করাই লক্ষ্য

তৌহিদুর রহমান ॥ রোহিঙ্গা শরণার্থীদের কক্সবাজার থেকে নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলার ঠেঙ্গারচরে সরিয়ে নেয়ার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। তবে শুধু রোহিঙ্গা ক্যাম্পে শরণার্থী বেড়ে যাওয়ার কারণেই এই ক্যাম্প সরিয়ে নেয়া হচ্ছে না। তাদের সরিয়ে নেয়ার পেছনে আরও বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে বলে জানা গেছে। কক্সবাজারে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ ঠেকানো, পর্যটন এলাকা রক্ষা, মাদক পাচার ঠেকানো, জঙ্গী যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ইত্যাদি বিষয় বিবেচনায় নিয়ে ঠেঙ্গারচরে ক্যাম্প সরিয়ে নেয়ার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সরকারের উচ্চ পর্যায়ে একটি সূত্র এসব তথ্য নিশ্চিত করেছে। কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ৩০ হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গা নাগরিক এখন অবস্থান করছেন। তবে গত বছর অক্টোবরের পর থেকে বাংলাদেশে নতুন করে প্রায় ৬৭ হাজার রোহিঙ্গা নাগরিক প্রবেশ করেছেন। এসব নাগরিকও ক্যাম্পে অবস্থান করছেন। সে কারণে সেখানে এখন আর কোনভাবেই স্থান সংকুলান হচ্ছে না। তাই রোহিঙ্গা ক্যাম্প হাতিয়ার ঠেঙ্গারচরে সরিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। তবে স্থান সংকুলানের পাশাপাশি আরও বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে বলেও জানা গেছে। সূত্র জানায়, গত দুই যুগ ধরে বাংলাদেশে প্রবেশ অব্যাহত রেখেছেন রোহিঙ্গারা। মিয়ানমারের অনেক রোহিঙ্গা নাগরিকের মধ্যেই বদ্ধমূল ধারণা রয়েছে, সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে আসলেই অনেক সুযোগ-সুবিধা মিলবে। ওপার থেকে এপারে এসে কোনভাবেই ক্যাম্পে আশ্রয় নিতে পারলেই আন্তর্জাতিক সহযোগিতা পাওয়া যাবে। তাই কোন কিছু না ভেবেই টেকনাফ সীমান্ত দিয়ে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এসে হাজির হয়ে থাকেন। সরকার রোহিঙ্গাদের এই বদ্ধমূল ধারণা ভেঙ্গে দিতে চায়। রোহিঙ্গা ক্যাম্প দূরে সরিয়ে নেয়া হলে, ওপারের রোহিঙ্গারা এখানে আসতে দ্বিধায় পড়বে। খুব সহজেই বাংলাদেশে পাড়ি দিতে চাইবে না বলে মনে করে সরকার। কক্সবাজার বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রসিদ্ধ পর্যটন এলাকা। এই এলাকায় সমুদ্র সৈকত ও সেন্টমার্টিন দ্বীপে প্রতিদিন হাজার হাজার দেশী-বিদেশী পর্যটক যান। তাই কক্সবাজার এলাকাকে নিরিবিলি রাখতে চায় সরকার। তবে রোহিঙ্গাদের কারণে সেটা সম্ভব হচ্ছে না। এছাড়া রোহিঙ্গারা ওই এলাকায় থেকে বনের কাঠ পাচার, মাদকদ্রব্য পাচার, মানব পাচারসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়ছেন। এপারের রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের রোহিঙ্গা নাগরিকদের আসতেও উৎসাহিত করছেন। এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে রোহিঙ্গাদের ক্যাম্প সরিয়ে নেয়ার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এদিকে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সঙ্গে মিয়ানমারের বিভিন্ন জঙ্গী সংগঠনের যোগাযোগ রয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। বিভিন্ন সময় সীমান্ত পেরিয়ে জঙ্গীরা রোহিঙ্গাদের ক্যাম্পে আশ্রয়ও নিয়েছেন। মিয়ানমারের পক্ষ থেকেও এ বিষয়ে অভিযোগ করা হয়েছে। তবে জঙ্গী ও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সে রয়েছে সরকার। সে কারণে সরকার রোহিঙ্গাদের সঙ্গে যে কোন জঙ্গী গোষ্ঠীর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করতে চায়। আর রোহিঙ্গা ক্যাম্প সরিয়ে নিয়ে আসা হলে সেটা অনেকটাই সম্ভব হবে বলে ধারণা করছে সরকার। নোয়াখালী জেলায় বিভিন্ন চর রয়েছে। সে কারণে নোয়খালীর কোন চরে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় ক্যাম্প করা সম্ভব কি-না জানতে চেয়ে ভূমি মন্ত্রণালয় থেকে নোয়াখালী জেলা প্রশাসককে অনেক আগেই চিঠি দেয়া হয়েছিল। সে প্রেক্ষিতে নোয়াখালী জেলা প্রশাসক দফতর জানিয়েছে, রোহিঙ্গাদের আশ্রয় ক্যাম্প করার লক্ষ্যে নোয়াখালীর হাতিয়ার চরাঞ্চলে জমি পাওয়া গেছে। হাতিয়ার যেখানে জমি পাওয়া গেছে, সেই জায়গাটির নাম ঠেঙ্গারচর। সেখানে বন বিভাগের ১২ হাজার একর জমি রয়েছে। এর মধ্যে ৫০০ একর জমিতে ক্যাম্প করা যেতে পারে বলে মতামত পাঠিয়েছে নোয়াখালী জেলা প্রশাসক অফিস। সূত্র জানায়, হাতিয়ার পূর্ব দিকে অবস্থিত ঠেঙ্গারচরে কোন জনবসতি নেই। তাই সেখানে খুব সহজেই রোহিঙ্গা ক্যাম্প সরিয়ে নেয়া সম্ভব। তবে এই জমিটি বন বিভাগের। বন বিভাগের কাছ থেকেই জমিটি অধিগ্রহণের প্রস্তাব পাঠিয়েছে জেলা প্রশাসক অফিস। নোয়াখালী জেলা প্রশাসক অফিস জানিয়েছে, যেখানে রোহিঙ্গা ক্যাম্প করা হবে, সেখানে কোন জনবসতি নেই। কক্সবাজারে রোহিঙ্গা ক্যাম্প থাকার কারণে বিভিন্ন সমস্যা মোকাবেলা করতে হচ্ছে। সে কারণে এখন থেকে পাঁচ বছর আগে সেখান থেকে রোহিঙ্গা ক্যাম্প সরিয়ে ফেলার প্রাথমিক উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। সে সময় যমুনার নদীর চরাঞ্চলে রোহিঙ্গা ক্যাম্প সরিয়ে নেয়ার উদ্যোগ নেয়া হয়। তবে বর্ষাকালে যমুনা নদীর পানিতে সেখানে প্রায় সব চরই ডুবে যায় বলে যমুনার চরে রোহিঙ্গা ক্যাম্প করার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে সরকার। তবে অক্টোবরের পর থেকে প্রায় ৬৭ হাজার রোহিঙ্গা নাগরিক নতুন করে প্রবেশ করার পরে কক্সবাজার থেকে রোহিঙ্গা ক্যাম্প সরিয়ে নিয়ে আসার বিষয়টি এখন চূড়ান্ত হয়েছে। সরকারের উচ্চ পর্যায়ের একাধিক সূত্র জানায়, রোহিঙ্গাদের হাতিয়ার ঠেঙ্গারচরে প্রত্যাবাসন করার আগে তাদের সুবিধা-অসুবিধা বিবেচনা করেছে সরকার। অমানবিকভাবে সেখানে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন করা হবে না। এছাড়া সেখানে রোহিঙ্গারা যেন কৃষি কাজ ও মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতে পারে সে বিষয়টিও সরকারের বিবেচনায় রয়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম জানান, কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এখন আর কোনভাবেই স্থান সংকুলান হচ্ছে না। ছোট জায়গার মধ্যে অনেক বেশি শরণার্থী অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের মধ্যে বসবাস করছেন। তাই মানবিক বিষয় বিবেচনা করেই তাদের হাতিয়ার ঠেঙ্গারচরে ক্যাম্প সরিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। তিনি আরও জানান, কক্সবাজার থেকে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের হাতিয়ার চরে সরিয়ে নেয়ার ফলে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর বিষয়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না। ফেরত পাঠানোর বিষয়ে যে আলোচনা চলছে, সেটা অব্যাহত থাকবে বলেও তিনি জানান। উল্লেখ্য, বাংলাদেশে তিন লাখ রোহিঙ্গা নাগরিক রয়েছেন। আর কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে রয়েছেন প্রায় ৩০ হাজার। আর গত বছর ৯ অক্টোবর সীমান্তে সহিংস ঘটনার পরে প্রায় ৬৭ হাজার রোহিঙ্গা নাগরিক বাংলাদেশে প্রবেশ করেছেন।
×