ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

ব্যবসায়ীদের তোয়াক্কা নেই ॥ ঝুঁকিপূর্ণ মার্কেট

প্রকাশিত: ০৫:৩৫, ৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

ব্যবসায়ীদের তোয়াক্কা নেই ॥ ঝুঁকিপূর্ণ মার্কেট

রাজন ভট্টাচার্য ॥ তিনতলা মার্কেটটির ছাদ ও চারপাশের দেয়ালের বিভিন্ন অংশে পলেস্তারা খসে পড়ছে। পিলারে ধরেছে বড় বড় ফাটল। এতে যে কোন সময় ঘটতে পারে বড় ধরনের দুর্ঘটনা। ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ডিএসসিসি) মালিকানাধীন ‘ঢাকা নিউ সুপার মার্কেটের (দক্ষিণ)’ ঝুঁকিপূর্ণ চিত্র এটি। ঢাকা নিউমার্কেটের পশ্চিম-উত্তর দেয়াল ঘেঁষে রয়েছে এই মার্কেট। ডিএসসিসি জানিয়েছে, আট বছর আগে মার্কেটটি সংস্কার করতে সুপারিশ করেছিল বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)। গত বছরের ১৭ অক্টোবর পৃথক আরেকটি প্রতিবেদনে এই মার্কেট তিন সপ্তাহের মধ্যে খালি করতে সুপারিশ করা হয়। কিন্তু মার্কেটের ব্যবসায়ীদের বাধায় তা করা যাচ্ছে না। এই মার্কেটে ১ হাজার ২৪৫ দোকান রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় মার্কেটটি ব্যবহার করা ঠিক নয়। যে কোন মুহূর্তে ঘটতে পারে বড় ধরনের দুর্ঘটনা। ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় সাম্প্রতিক সময়ে নগরীর অন্যতম ব্যস্ততম মৌচাক মার্কেটও বন্ধের নির্দেশ দেয়া হয়েছিল উচ্চ আদালত থেকে। যদিও ব্যবসায়ীদের আবেদনের প্রেক্ষিতে পরে সময় বাড়ানো হয়। শেষ পর্যন্ত এ মার্কেটটিও কবে ভাঙ্গা হচ্ছে তা এখনও অনিশ্চিত। রাজধানীর কাওরানবাজার। দ্বিতল এই মার্কেটের দোতলায় সারি সারি দোকান থাকলেও পুরোই ফাঁকা। নিচের দোকানগুলো সচল। মানুষের হাঁকডাক। নিত্য ব্যস্ততা। সবই আছে। এর অধিকাংশই আসবাবপত্রের দোকান। ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) নথিপত্রে মার্কেটটির পরিচয় কাওরানবাজার-১ নামে। অথচ কয়েক বছর আগেই মার্কেটটি ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করা হয়েছে। মার্কেটের পাশেই সিটি কর্পোরেশনের কার্যালয়। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, যে কোন সময় এটি ধসে পড়ে বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। এমন আরেকটি মার্কেটের নাম গুলশান-২ পাকা মার্কেট (উত্তর)। নক্সা অনুযায়ী এটি দোতলা। কিন্তু বাস্তবে আছে চারতলা। ভবনটি বহু আগেই ঝুঁকিপূর্ণ-পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়েছে। তবে মার্কেটজুড়ে চলছে জমজমাট বাণিজ্য। লোক সমাগমও বেশ। চার বছর আগে গুলশান-১ এলাকার সিটি কর্পোরেশন মার্কেটকে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করা হয়েছিল। কিন্তু কেউ কর্ণপাত করেননি। শেষ পর্যন্ত মার্কেটের একাংশ ধসসহ বড় ধরনের অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটল। এ রকম একটি ঘটনা যেখানে ঝুঁকিপূর্ণ ভবন ছাড়তে আঙ্গুল তুলছে ঠিক তখনও এ ব্যাপারে কারো কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। এমন বাস্তবতায় ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) ১২ মার্কেট ও ১৪১টি ভবন ঝুঁকিপূর্ণ বলে জানিয়েছেন মেয়র মোঃ আনিসুল হক। তবে দুই সিটি কর্পোরেশন মিলিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের সংখ্যা ৩২১টি। সম্প্রতি সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে ঝুঁকিপূর্ণ ভবন ও মার্কেটের তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। গুলশান-১ নম্বরে সিটি কর্পোরেশন মার্কেটে অগ্নিকা- ও ধসে পড়ার ঘটনার পর পরই ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের বিষয়টি ফের আলোচনায় আসে। কর্পোরেশনের কর্তাব্যক্তিরা তখন জানান, অনেক আগে থেকেই এই ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। বিষয়টি ব্যবসায়ীদের অবগতও করা হয়েছিল। কিন্তু তারা দোকান ছাড়তে রাজি না হওয়ায় ভবন ধসের ঘটনাটি ঘটে। সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে মেয়র আনিসুল হক বলেন, সিটি কর্পোরেশনের আওতাধীন ৭টি জায়গায় এ ধরনের মার্কেট রয়েছে। এগুলো অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। এছাড়া ১৪১ ভবনও ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। তিনি বলেন, ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনে রাজউকের ঘোষণা অনুযায়ী ৩২১ ভবন ঝুঁকিপূর্ণ। এর মধ্যে ১৪১ ভবন উত্তর সিটি কর্পোরেশনে রয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ মার্কেটগুলো চিহ্নিত করেন বুয়েটের ইঞ্জিনিয়ার ও ভবনগুলো চিহ্নিত করেন রাজউক ও উত্তর সিটি কর্পোরেশনের কর্মকর্তারা। মেয়র বলেন, সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে- গুলশান-২’র কাঁচা-পাকা মার্কেট, খিলগাঁওয়ের কাঁচা মার্কেট, খিলগাঁও সুপার মার্কেট, কাওরানবাজার কাঁচা ও চিকেন মার্কেট, মোহাম্মদপুর টাউন হল মার্কেটসহ ১২টি। ঝুঁকির বিষয়টি মার্কেট কর্তৃপক্ষকে নোটিস দিয়ে অবগত করা হয়েছে। কিন্তু মার্কেটের ব্যবসায়ীরা এর কোন তোয়াক্কা করছেন না। মার্কেটগুলো থেকে কেন ব্যবসায়ীদের সরানো হচ্ছে না সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে মেয়র বলেন, আমরা এ মুহূর্তে কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারছি না ব্যবসায়ীদের কারণে। আমরা এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেনের সঙ্গে আলোচনা করছি। ডিএনসিসির মেয়র আনিসুল হক জানান, গুলশানে ধসে যাওয়া মার্কেট নিয়ে ২০০৯ সালে বুয়েট প্রতিবেদন দিলে ব্যবসায়ীদের নোটিসে অবগত করানো হয়েছিল। রানা প্লাজা ধসের পর আবারও তাদের নোটিস দেয়া হয়েছিল। মার্কেটের পাশে সাইনবোর্ডে ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ লিখে টাঙানো হলেও ব্যবসায়ীরা তা ভেঙ্গে ফেলেছেন। পরে আমরা থানায় জিডি করেছি। এমন অনেক মার্কেট ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে। তারা কিছুই মানছেন না। মানুষের জীবন নিয়ে খেলছেন। জানতে চাইলে ডিএসসিসির মেয়র সাঈদ খোকন বলেন, আমাদের কয়েকটি মার্কেট ঝুঁকিপূর্ণ রয়েছে। এর মধ্যে নিউ সুপার মার্কেট, বনলতা মার্কেট, চন্দ্রিমা মার্কেট ও কাপ্তানবাজার রোড সাইট মার্কেট। অধিক ঝুঁকিপূর্ণ মার্কেটগুলো বিশেষজ্ঞের সহায়তা নিয়ে মেরামত করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে বলেও জানান তিনি। নিউ সুপারমার্কেট (দক্ষিণ) বণিক সমিতির সাবেক সভাপতি মোঃ শহীদুল্লাহ জানান, তাদের পক্ষে ডিএসসিসির নোটিস অনুযায়ী মার্কেট খালি করা সম্ভব হবে না। তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য টিকিয়ে রাখার জন্য বিকল্প চিন্তা না করলে তা বাস্তবায়ন হবে না। এ ব্যবসায়ীর দাবি, ২০০৭ সালে সিটি কর্পোরেশনে বুয়েট থেকে যে প্রতিবেদন দিয়েছে তা মেনে ইতোমধ্যে মেরামত করা হয়েছে। এখন ঝুঁকি থাকার কথা না। ডিএনসিসির রাজস্ব বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, সিটি কর্পোরেশনের আওতাধীন গুলশান-২ নম্বর মার্কেট, কাওরানবাজারের-১ ও ২ নম্বর বাজার, মহাখালী বাজারের অনেক দোকান পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়েছে। এসব মার্কেট বন্ধ করার জন্য সম্প্রতি নোটিস দেয়ার পাশাপাশি ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছিল। ঢাকা মহানগর দোকান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক এস এম জালাল রিজভি সম্প্রতি সাংবাদিকদের বলেন, আমরা মেয়রের সঙ্গে বসেছিলাম। তাকে আমরা বলেছি, ভবন সংস্কার যেমন জরুরী তেমনই ব্যবসায়ীদের পুনর্বাসন করাও কম জরুরী নয়। আলাপকালে তিনি বলেন, ব্যবসায়ীদের পথে বসিয়ে না দিয়ে, বিকল্প ব্যবস্থা বজায় রাখার ওপর আমরা গুরুত্ব দিয়েছি। গুলশান ১ দক্ষিণ পাকা মার্কেট ব্যবসায়ী সমিতি ও চেয়ারম্যান জালাল রিজভি আরও বলেন, গুলশানে সিটি কর্পোরেশনের মার্কেটে সম্প্রতি অগ্নিকা- ও ধসে পড়ার ঘটনায় আমরা সতর্ক। একটি বিষয় পরিষ্কার যে, আমরা সিটি কর্পোরেশন কর্তৃপক্ষকে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করতে চাই। কর্তৃপক্ষেরও উচিত হবে ব্যবসাবান্ধব সিদ্ধান্ত নেয়া এবং তাদের পেটে লাথি না মারা। ৯৯ শতাংশ বাণিজ্যিক মার্কেটই আগুনের ঝুঁকিতে ॥ গুলশানে ডিএনসিসি মার্কেটের মতো অগ্নিঝুঁকিতে রাজধানীর ৯৯ শতাংশ মার্কেট রয়েছে। ডিএনসিসি মার্কেটে ভয়াবহ অগ্নিকা-ের পর ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনে অগ্নিঝুঁকিপূর্ণ মার্কেটের তালিকা শুরু করেছে ফায়ার সার্ভিস এ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের স্থানীয় স্টেশন অফিসগুলো। সদরঘাট ফায়ার স্টেশনের আওতাধীন সদরঘাট, ইসলামপুরসহ আশপাশের এলাকায় ১৪৭টি ঝুঁকিপূর্ণ মার্কেটের তালিকা তৈরি করেছে অগ্নিনির্বাপণে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠানটি। এছাড়া চকবাজার ও আশপাশের এলাকায় ৩০টিরও বেশি প্লাস্টিক কারখানা ঝুঁকিতে রয়েছে। ঢাকা দক্ষিণ ও উত্তর সিটি কর্পোরেশনে রয়েছে শতাধিক মার্কেট। এর মধ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মালিকানাধীন রয়েছে ৭৮ মার্কেট। এছাড়া ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মালিকানাধীন রয়েছে ৪৩ মার্কেট। ঝুঁকিপূর্ণ নিউ সুপার মার্কেট ॥ ডিএসসিসি জানিয়েছে, আট বছর আগে ‘ঢাকা নিউ সুপার মার্কেটের (দক্ষিণ)’ মার্কেটটি সংস্কার করতে সুপারিশ করেছিল বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)। গত বছরের ১৭ অক্টোবর পৃথক আরেকটি প্রতিবেদনে এই মার্কেট তিন সপ্তাহের মধ্যে খালি করতে সুপারিশ করা হয়। কিন্তু মার্কেটের ব্যবসায়ীদের বাধায় তা করা যাচ্ছে না। এমন বাস্তবতায় অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় ঢাকা নিউ সুপারমার্কেট ভবনটি ভেঙ্গে ফেলার উদ্যোগ নিয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন (ডিএসসিসি) কর্তৃপক্ষ। ১৯৫৪ সালে প্রতিষ্ঠার পর তখনকার ঢাকার সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিপণি বিতান ছিল নিউমার্কেট। তবে আশির দশকে সামরিক শাসনামলে এ এলাকায় আরও ৩টি ভবন গড়ে তোলা হয়। এতে নিউমার্কেট এলাকায় যত্রতত্র পার্কিং আর হকারদের অবৈধ শত শত দোকান তৈরি হওয়ায় নেই আগের মতো খোলামেলা ও কেনাকাটার পরিকল্পিত পরিবেশ। ২০০৭ সালে বুয়েটের একটি কমিটি ঢাকা নিউ সুপার মার্কেটের ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করে ভেঙ্গে ফেলার সুপারিশ করলেও ৯ বছরে তা কার্যকর হয়নি। সাঈদ খোকন বলেন, ওই মার্কেটটি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে আমাদের বলেছে খুব দ্রুত ব্যবস্থা নেয়ার জন্য। আমাদের খুব সমস্যা হচ্ছে তাদের বের করতে। একেবারেই যদি তাদের আমরা বোঝাতে না পারি প্রয়োজনে হয়ত বল প্রয়োগ করতে হবে। সিটি কর্পোরেশন সূত্রে জানা গেছে, মার্কেটিতে বার বার ‘ঝুঁকিপূর্ণ‘ সাইনবোর্ড লাগানো হলেও ব্যবসায়ীরা তা খুলে নিচ্ছেন।
×