ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

সাজ্জাদ কাদির

দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশই আমাদের স্বপ্ন

প্রকাশিত: ০৩:৫৩, ৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

 দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশই আমাদের স্বপ্ন

বিশ্বের সব দেশেই কম-বেশি দুর্নীতি হয়। কোথাও কম আবার কোথাও বেশি। ২০০৮ এবং ২০১৪ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে দুর্নীতি প্রতিরোধের অঙ্গীকার নিয়ে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। সেই ইশতেহারের ধারাবাহিকতায় আওয়ামী লীগ দলীয় দুই একজন এমপি, মন্ত্রীকেও দুদকের বারান্দায় হাঁটতে হয়েছে। কারণ, এর আগে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে ২০০১ সাল থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত বিশ্বে বাংলাদেশ দুর্নীতিতে টিআইবির র‌্যাঙ্কিয়ে টানা ৫ বার চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। শুধু তাই নয়, এই সময়টিতে একটি বিশেষ ভবনের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় সকল দুর্নীতিকে পৃষ্ঠপোষকতা দেয়া হতো। ২০০৬ সালে গিয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের স্থানের পরিবর্তন হয়। এরপর ধীরে ধীরে কিছুটা উন্নতির দিকে এগিয়ে যায়। দুর্নীতি প্রতিরোধে আওয়ামী লীগ সরকারের নানামুখী পদক্ষেপ সত্ত্বেও সর্বশেষ প্রকাশিত ২০১৫ সালের টিআইবির রিপোর্ট অনুযায়ী বিশ্বের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৩তম। যেটি আশা জাগাতে পারে না। বাংলাদেশ যেখানে উন্নয়ন, অগ্রগতিতে দারুণ আশার সঞ্চার করছে সেখানে দুর্নীতিতে কেন এই হতাশা? এই হতাশা যেন আমাদের সব অর্জনকে ম্লান করে না দেয় সেদিকে সবার জোরালো নজর রাখতে হবে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সাবেক জ্যেষ্ঠ সচিব ইকবাল মাহমুদকে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যান নিয়োগ দেয়া হয়েছে গত বছর মার্চ মাসে। তিনি অত্যন্ত সজ্জন ব্যক্তিই শুধু নন, জনপ্রশাসনের একজন অত্যন্ত দক্ষ প্রশাসক সেটিও তার কর্মজীবনে দেখিয়েছেন। তিনি যোগ দেয়ার পর দুদককে খানিকটা নড়ে-চড়ে বসতে দেখা যাচ্ছে। দুর্নীতি প্রতিরোধ কী শুধু রাষ্ট্রের মাধ্যমেই সম্ভব। রাষ্ট্রচালিত একটি দুর্নীতি দমন কমিশনই কী দেশের দুর্নীতি শূন্যের কোঠায় নিয়ে আসতে পারবে? মোটেই তেমনটি নয়। দুর্নীতি প্রতিরোধ করতে হলে রাষ্ট্রের সকল নাগরিককে আন্তরিক হতে হবে, প্রতিরোধে এগিয়ে আসতে হবে, পারিবারিক, সামাজিকভাবে দুর্নীতিবাজদের বয়কট করতে হবে। আজকে সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে দুর্নীতিবাজদের দৌরাত্ম্য। আর এই দৌরাত্ম্যের কারণে সরকারের শীর্ষমহলে শতভাগ আন্তরিকতা থাকলেও দুর্নীতি প্রতিরোধে কাক্সিক্ষত সাফল্য আসছে না। সাফল্য আসবে কিভাবে? কারণ কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া দুর্নীতি করলে কেউ কিছুই বলে না বরং উল্টো সবাই তোয়াজ করে। ঢাকা শহরে হাজার হাজার বিভিন্ন সরকারী দফতরে চাকরি করা অসাধু কর্মচারী-কর্মকর্তা আছেন যাদের দুর্নীতির মাধ্যমে গড়া বাড়ি, গাড়ি, ব্যাংক ব্যালান্সের অভাব নেই। এরাই দুর্নীতিকে উস্কিয়ে দেয়, উদ্বুদ্ধ করে। সচেতন মহল মনে করে ঢাকা শহরের প্রতিটি বাড়ি ধরে ধরে যদি তদন্ত করা হয় বাড়ির মালিকের আয়ের উৎস কী তাহলে বেরিয়ে আসবে দুর্নীতির এক মহাউৎসবের কাহিনী। শুধু ঢাকা শহরেই নয়, ঢাকার বাইরেও এই দুর্নীতিবাজরা দোর্দ- প্রতাপে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। অথচ এরা দশ-পনেরো বছর আগে এই জায়গায় ছিলেন না। আজকে এত সম্পদ কোথায় পেলেন? তাদের জিজ্ঞেস করতে হবে। জবাবদিহিতার মধ্যে আনতে হবে। কোথাও কোন অসঙ্গতি চোখে পড়লেই সেটি তদন্ত করার ব্যবস্থা থাকতে হবে। আর এজন্য আমাদের দুর্নীতি দমন কমিশনকে আরও বেশি শক্তিশালী করতে হবে। প্রতিটি শহরে এমনকি প্রতিটি উপজেলা শহর পর্যন্ত এর বিস্তার ঘটাতে হবে। পর্যাপ্ত জনবল দিয়ে এটিকে ঢেলে সাজাতে হবে। দুর্নীতি প্রতিরোধে কমিশনের যে বিদ্যমান আইন আছে সেটিই যথেষ্ট। প্রয়োজন শুধু এর সঠিক প্রয়োগ। না হলে আমাদের সব অর্জন বিশেষ করে ভিশন ২০২১ এবং ২০৪১ দারুণভাবে বাধাগ্রস্ত হবে। আমাদের সমাজে নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে মেয়ের বিয়ে দিতে গিয়ে প্রথমে খোঁজা হয় সরকারী চাকরিজীবী ছেলে। কোন গ্রেডের চাকরিজীবী সেটি মুখ্য বিষয় নয়। মুখ্য বিষয় হচ্ছে ছেলে কোন দফতরে চাকরি করে সেটি। বিয়ের ক্ষেত্রে যে সমস্ত আলাপ হয় তা হলো- ছেলে বেতন কত পায়? উপরি ইনকাম কত? বেতন নয় এই উপরি ইনকামের ওপরই অনেক ক্ষেত্রে বিবাহ নির্ধারিত হয়। আর এই উপরি ইনকামটিই আমাদের রাষ্ট্র এবং সমাজ ব্যবস্থায় কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। সমাজের প্রত্যেকটি মানুষের এই মনমানসিকতা পরিবর্তন করতে হবে। না হলে রাষ্ট্র যতই আন্তরিক হোক দুর্নীতি কমানো সম্ভব হবে না। আজকে সামরিক বাহিনী এবং পাবলিক সার্ভিস কমিশনের বাইরে সরকারী চাকরিতে যে নিয়োগ হয় সেটি টাকার বিনিময়ে দুর্নীতি ছাড়া কত ভাগ নিয়োগ হয় সে ব্যাপারে প্রশ্ন রয়েছে। সরকারের এমন কোন দফতর নেই যেখানে আপনি টাকা ছাড়া সুস্থ-স্বাভাবিকভাবে কাজটি দ্রুত সম্পন্ন করতে পারবেন। বর্তমান সরকারের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনা দুর্নীতি প্রতিরোধে এতটাই আন্তরিক যে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। দুর্নীতি যাতে প্রতিরোধ হয় তার জন্য তিনি নিজে আগ্রহী হয়ে প্রতিনিয়ত নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে সচেষ্ট আছেন। এর মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপের কথা না বললেই নয়। সেটি হচ্ছে দেশের বিভিন্ন পর্যায়ের প্রায় ২১ লাখ সরকারী চাকরিজীবীর বেতন বৃদ্ধি। গ্রেড ভেদে মূল বেতন ৯১ থেকে ১০১ শতাংশ বেড়েছে। যেটি ২০১৫ সালের ১ জুলাই থেকে কার্যকর হয়েছে। এই বৃদ্ধির প্রধানতম উদ্দেশ্য হচ্ছে দুর্নীতি দমন। জীবন চালাতে গিয়ে যেন সরকারী কর্মচারী-কর্মকর্তাদের দুর্নীতির আশ্রয় নিতে না হয়। আগামীতে তাদের জন্য আবাসনসহ আরও নানা সুবিধা সামনে আসছে। এতকিছুর পরেও কী দুর্নীতি কমেছে? মোটেই নয়। অনেক ক্ষেত্রে বেতন বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে দুর্নীতি করা অর্থের হারও বৃদ্ধি পেয়েছে। অর্থাৎ সরকারী দফতরে কাজের ক্ষেত্রে আগে যে অর্থ নিতেন তার থেকে এখন আরও বেশি অর্থ দাবি করে থাকেন। দুর্নীতি নিয়ে শুধু হতাশার কথা বললাম। অনেক আশা জাগানিয়া কথাও আছে। প্রধানমন্ত্রীর তথ্যপ্রযুক্তি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ের মহতী উদ্যোগের সুফল হিসেবে আজকে সরকারী সেবাসমূহ ডিজিটালাইজেশনের কারণে আমরা অনেক ক্ষেত্রে দুর্নীতি থেকে মুক্ত হবার দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। সব ধরনের সরকারী সেবা এখন অনলাইনে পাওয়া যায়। অনলাইন হবার কারণে সরকারী বিভিন্ন দফতরে যে দালাল চক্রের দৌরাত্ম্য ছিল সেটি এক প্রকার কমে এসেছে। এভাবে সবক্ষেত্রে ডিজিটাল এবং ওয়ানস্টপ সার্ভিস ব্যবস্থা সচল থাকলে দুর্নীতি কমতে বাধ্য। শুধু সার্টিফিকেটধারী শিক্ষা নয়, সুশিক্ষায় শিক্ষিত মানুষের কাছে সাধারণ মানুষ তার কাক্সিক্ষত সেবাটি অবশ্যই পাবেন। সাম্প্রতিক সময়ে আমি নিজে এর সুবিধাভোগী। গত কিছুদিন আগে আমার একটি ব্যক্তিগত কাজে রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশের সহযোগিতা প্রয়োজন ছিল। একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে রাজশাহী মেট্রেপলিটন পুলিশ কর্তৃপক্ষ আমাকে যে সহযোগিতা করেছেন তা ভুলবার নয়। এর প্রধানতম কারণ আমার কাছে মনে হয়েছে এখানকার পুলিশ কমিশনার এবং ডিসি (পশ্চিম) সুশিক্ষায় শিক্ষিত মানুষ। আবার ক’দিন আগে ঢাকা জেলার এক উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি)-এর কাছে একটি কাজে এক আত্মীয়কে পাঠিয়েছিলাম। জনপ্রশাসনের তরুণ অফিসারটির সঙ্গে আমি টেলিফোনে কথা বলে এক কথায় মুগ্ধ। তাঁর সুশিক্ষা দিয়ে তিনি যে আশা জাগানিয়া কথা আমাকে শুনিয়েছেন সেটি সত্যিই আমাকে দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখায়। আর এজন্যই আমাদের প্রশাসনে সুশিক্ষায় শিক্ষিত মানুষের বড়ই প্রয়োজন। সবমিলিয়ে বাংলাদেশ আজ দুর্বার গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে এটি চরম বিরোধিতাকারী মানুষটিও স্বীকার করবেন। আর এই দুর্বার গতিকে যাতে দুর্নীতি কোনভাবে আটকিয়ে দিতে না পারে সেটি সরকারপ্রধান যেভাবে ভাবছেন ঠিক তেমনিভাবে দেশের প্রতিটি মানুষ ভাববেন তাহলেই আমরা দুর্নীতিকে বিদায় জানাতে পারব এবং আমাদের স্বপ্নের দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে পারব। লেখক : সংস্কৃতিকর্মী [email protected]
×