ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

একে মোহাম্মাদ আলী শিকদার

নিরপেক্ষতার যত রূপ

প্রকাশিত: ০৩:৫২, ৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

নিরপেক্ষতার যত রূপ

বাংলাদেশে কিছু ভাল কথা ও অভিধা তার মূল অর্থ হারিয়ে এখন ‘ভিলেনে’ রূপান্তরিত হয়েছে। এর মধ্যে রাজাকার ও আলবদর শব্দ দুটি এখন বাংলাদেশে রীতিমতো ভয়ঙ্কর গালি। অথচ এর উৎপত্তি ও মর্মার্থের বিচারে ১৯৭১ সালের আগ পর্যন্ত এ নামে কাউকে ডাকলে তিনি মহাসম্মানিত বোধ করতেন। এ দুটি শব্দ কিভাবে গালিতে পরিণত হলো এবং এর জন্য কারা দায়ী সেটি বাংলাদেশের মানুষ ভাল করে এখন জানেন। ইতোমধ্যে আরও দুটি শব্দ দ্রুত গালিতে পরিণত হচ্ছে। তার একটি জামায়াত আর অন্যটি শিবির। আক্ষরিক অর্থে এ দুটি শব্দও অনেক ভাল। কিন্তু জামায়াত-শিবির বলতে বাংলাদেশের মানুষ এখন বোঝে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী, একাত্তরের ঘাতক, গণহত্যাকারী, বুদ্ধিজীবী হত্যাকারী, ধর্ষক ও যুদ্ধাপরাধী হিসেবে। জামায়াতকে এখন আর কেউ রাজনৈতিক দল মনে করে না। এদের মনে করে সন্ত্রাসী সংগঠন এবং জঙ্গীবাদের মূল শেকড়। আর শিবির তো রগকাটা, হাত-পা কাটা দল, যাদের ২০১৪ সালে ওয়াশিংটনভিত্তিক একটি জরিপকারী প্রতিষ্ঠান বিশ্বের তৃতীয় শীর্ষ সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত করেছে। রাজাকার, আলবদর যেমন এখন ইতিহাসেও গালির তালিকায় স্থান পেয়েছে তেমনি বাংলাদেশে জামায়াত-শিবিরের নামও সে তালিকায় দ্রুত উঠবে। আর বেশিদিন অপেক্ষা করতে হবে না। তৃতীয়ত, আধুনিক ও প্রগতির স্মারক সংস্কার ও সংস্কারবাদী শব্দদ্বয় বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখন অপাঙক্তেয় এবং অনুচ্চারিত। এর কারণও আমরা জানি। বাংলাদেশের মানুষের কাছে এতদিনে এটা স্পষ্ট যে, ২০০৭-২০০৮ মেয়াদের জরুরী আইনের নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার যখন গণতান্ত্রিক রাজনীতিকে বিদায় করে অসাংবিধানিক পন্থায়, সামরিক বাহিনীকে ব্যবহার করে দেশী-বিদেশী একটা চক্র মিলে বাংলাদেশকে তাদের ইচ্ছারাজ্য এবং পদানত রাষ্ট্র বানাতে চেয়েছিল। একদিকে অনির্দিষ্টকালে জন্য জরুরী আইন, মিডিয়ার কপালে ও পিঠে বন্দুক, রাজনৈতিক কার্যকলাপ নিষিদ্ধ, আবার অন্যদিকে ভূঁইফোড় লোকদের দ্বারা কিংস পার্টি গঠন এবং তাদের রাজনৈতিক দৌরাত্ম্যের লম্ফ-ঝম্প। তথাকথিত নিরপেক্ষদের বদৌলতে গল্পে শোনা মগের মুল্লুকের বাস্তব উদাহরণ তখন বাংলাদেশের মানুষ দেখেছে। বাংলাদেশকে চিরদিনের জন্য তাঁবেদার, পদানত রাষ্ট্র বানানোর পাঁয়তারারত শীর্ষ এক বিদেশী শক্তির প্ররোচনায় ও আশীর্বাদে বিশ্ব শান্তির পতাকা মাথায় বেঁধে হঠাৎ করে একজন রাজনীতির মাঠে নেমে ঘোষণা দিলেন, এদেশের মানুষ তাঁকেই ক্ষমতায় দেখতে চায়, বিপুলভাবে তাঁর ডাকে মানুষ সাড়া দিচ্ছে। রেডিও-টেলিভিশনে এবং বিভিন্ন জনের মুখে প্রায়ই শুনতাম এবার তারা সব ঠিক করে ফেলবেন। দেশে আর কোন জঞ্জাল থাকবে না। কিন্তু কিছুদিন যেতেই নিত্যপ্রয়োজনীয় বাজারে আগুন, দেশে চালের মজুদ নেই, ব্যবসাবাণিজ্য বন্ধ। দেশজুড়ে হাহাকার। শুরু হয় মানুষের মাথায় হাত আর দুর্নীতি দমনের নামে লুটতরাজ। হবু রাজা আর গবু মন্ত্রীর রাজ্যের মতোÑ ‘করিতে ধুলা দূর/জগত হলো ধুলায় ভরপুর।’ মানুষ খেপে উঠলে নিরপেক্ষকারীগণের সম্বিত ফিরে আসে। তারপর গা বাঁচিয়ে কোন রকম একটু প্রস্থানের ব্যবস্থা করেন। কিন্তু দুই বছরে রাষ্ট্র ও রাজনীতির যে সর্বনাশ তারা করেছেন, রাষ্ট্রের একমাত্র শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান সেনাবাহিনীর যে ক্ষতি করেছেন, তাতে অন্য কোন দেশ হলে এর জন্য দায়ীদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে প্রায়শ্চিত করা লাগত। এহেন নিরপেক্ষ সরকারের আশীর্বাদ ও ছত্রছায়ায় বড় দুটি রাজনৈতিক দলের কিছু সুপরিচিত নেতা রাজনৈতিক সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে টেলিভিশনের পর্দায় হাজির হলেন এবং ওই সরকারের সঙ্গে হাত মেলালেন। তাঁদের সংস্কার প্রস্তাবের ভালমন্দ মানুষ বিচার করলেন না, দেখতেও চাইলেন না। মানুষ ধরেই নিলেন এহেন নিরপেক্ষ সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় সংস্কারের নামে যত ভাল কথাই থাকুক না কেন, আসলে তাতে শান্তি কমিটির নামে চরম অশান্তি সৃষ্টির মতো কিছু একটা ঘটবে। সংস্কার প্রস্তাব উত্থাপনকারীগণ জনগণ কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হলেন; রাস্তাঘাটে তাদের কপালে যা জুটল তা আর এখানে উল্লেখ করলাম না। নিরপেক্ষ সরকারের ত্রাহি অবস্থা দেখে মানুষের মুখে শোনা গেল হবু রাজার সুরÑ ‘এমনি সব গাধা/ ধুলারে মারি করিয়া দিল কাদা।’ তারপর থেকে সংস্কার ও সংস্কারবাদী শব্দদ্বয় বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে দীপান্তরে। এ কথাগুলো এখন রাজনীতিতে ভয়ের কারণ, এক ধরনের রাজনৈতিক গালি। অথচ বাংলাদেশের রাজনীতিতে ব্যাপক সংস্কারের প্রয়োজনীয়তার কথা কেউ অস্বীকার করতে পারবেন না। নিরপেক্ষ ও নিরপেক্ষতা বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে এখন খুবই আলোচিত বিষয়। বাংলাদেশের সিভিল সমাজের কিছু ব্যক্তির কাছে নিরপেক্ষ শব্দটি মহাআকর্ষণীয় হয়ে ওঠে নির্বাচনের সময় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তনের পর থেকে। প্রতিবার দশজন নিরপেক্ষ ব্যক্তির দরকার। ব্যাপারটা চালু থাকলে একবার না একবার সুযোগ এসে যাবে। যাদের কাছে নিরপেক্ষ হওয়ার প্রবল আকাক্সক্ষা তাদের কিছু বৈশিষ্ট্য আমার চোখে ধরা পড়েছে। তারা আওয়ামী লীগ সম্পর্কে দুটি ভাল কথা বললে বিএনপি সম্পর্কেও দুটি ভাল কথা না বলে কথা শেষ করবেন না। আবার বিএনপি সম্পর্কে দুটি মন্দ কথা বললে আওয়ামী লীগ সম্পর্কেও দুটি মন্দ কথা অবশ্যই বলতে হবে। তাদের কাছে দুই নেত্রীই সমান। অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ২৩ বছরের সংগ্রামের গৌরবোজ্জ্বল ঘটনাবলীকে তারা এড়িয়ে চলেন। নিজের থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে কখনও এসব সম্পর্কে কোন কথা তোলেন না। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে ছয় দফা, সত্তরের নির্বাচনের ফলাফলের ভূমিকা, একাত্তরের মার্চ মাসের ডিসাইসিভ অসহযোগ আন্দোলনের কথা নিজ থেকে কখনও আলোচনায় আনেন না। হঠাৎ প্রসঙ্গক্রমে আলোচনার মধ্যে পড়ে গেলে এসব ঘটনার সঙ্গে জড়িত নায়ক-মহানায়কদের কৃতিত্বের কথা অনুচ্চারিত রাখেন। মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে হ্যাঁ-হু ছাড়া বড় কোন আলোচনায় তারা জড়িত হতে চান না। মুক্তিযুদ্ধে বিজয় লাভের জন্য সমস্ত অস্ত্র গোলা-বারুদের চাইতে অনেক বেশি শক্তিশালী জয়বাংলা সেøাগান তারা ভুলক্রমেও মুখে আনবেন না, সব সময় সতর্ক থাকেন। যার জন্ম না হলে একাত্তরে বাংলাদেশ স্বাধীন হতো না, সেই মহান নেতার নামের আগে জাতির পিতা, বঙ্গবন্ধু তারা এক সময় বলতে চাইতেন না। অবশ্য ইদানীং তাদের কেউ কেউ বঙ্গবন্ধু বলা শুরু করেছেন। বিএনপির কিছু কিছু নেতাও এখন বঙ্গবন্ধু বলেন। সুতরাং এতে নিরপেক্ষতা হারানোর ভয় কমে গেছে। তারা জামায়াত-শিবির সম্পর্কেও নীরব ভূমিকা পালন করেন। জামায়াত-শিবিরের ধ্বংসযজ্ঞসহ জাতীয় পতাকা পোড়ানোর দৃশ্য টেলিভিশনে দেখার পরেও জামায়াতের নাম উচ্চারণ করে তাদের বিরুদ্ধে একটি কথাও বলেন না। অন্যান্য বিষয়ে উচ্চকণ্ঠ হলেও জামায়াতের বিষয়ে কথা উঠলে বলেন ওটা সরকারের কাজ, আমাদের কিছু বলার নেই। বাংলাদেশের প্রথম সামরিক শাসক জেনারেল জিয়াউর রহমান সামরিক আদেশবলে বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সংবিধানকে কাটাছেঁড়া করলেন, মুক্তিযুদ্ধের সফল দর্শন ও আদর্শকে বাতিল করে দিলেন, জামায়াত-শিবিরসহ ধর্মান্ধ রাজনীতি চালু করলেন, রাজনীতিতে রাষ্ট্রীয় দর্শনের জায়গায় বিভাজন সৃষ্টি করলেন এগুলো সম্পর্কে কথিত নিরপেক্ষ ব্যক্তিরা কখনও কিছু বলেন না। কিন্তু নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন উপলক্ষে রাজনীতি সরগরম হওয়ায় উপরোক্ত গুণাবলীর অধিকারী নিরপেক্ষ ব্যক্তিগণ বেশ উৎফুল্ল চিত্তে আছেন। নতুন নির্বাচন কমিশনের জন্য নিরপেক্ষ ব্যক্তির সন্ধানে মহামান্য রাষ্ট্রপতি অনুসন্ধান কমিটি করেছেন। বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছেÑ অনুসন্ধান কমিটির কেউ নিরপেক্ষ নন, প্রত্যাখ্যান করা হলো। প্রত্যাখ্যাত কমিটি কর্তৃক নির্বাচন কমিশনের জন্য যাদের সুপারিশ করা হবে সেটা কি তাহলে বিএনপি মেনে নেবে? শিশু ও পাগল ছাড়া কেউ নিরপেক্ষ নয়, এমন ধারণা যারা পোষণ করেন তাদের জন্য এলিয়েন জগত থেকে লোক আনলেও নিরপেক্ষ মনে হবে না। অনুসন্ধান কমিটি ৩১টি দলের প্রতিটির কাছ থেকে পাঁচজনের নাম চাইলেও ২৫টি দলের থেকে ১২৫ জনের নাম তারা পেয়েছেন বলে মিডিয়া সূত্রে জানা গেছে। এই ১২৫ জনের ভেতর থেকে ১০ জন, নাকি ভেতরের ও তার বাইরের মিলে ১০ জন, নাকি সম্পূর্ণ বাইরের থেকে ১০ জনের নাম সুপারিশ করবেন সে সিদ্ধান্তের ক্ষমতা নিশ্চয়ই অনুসন্ধান কমিটির রয়েছে। এ পর্যায়ে শুধু বলতে চাই, সব পক্ষকে সন্তুষ্ট করার প্রবণতা অনুসন্ধান কমিটির মাথায় যেন না ঢোকে। ইতোমধ্যে অতি পরিচিত একজন নিরপেক্ষ ব্যক্তি নির্বাচন কমিশনের জন্য নিরপেক্ষ ব্যক্তি বাছাইয়ে গণশুনানির কথা বলে নিরপেক্ষতার দৌড়ে আরেকটু এগিয়ে গেলেন। একই কারণে অন্য কেউ পাঁচজন বাছাইয়ের জন্য রেফারেন্ডাম বা সারাদেশের মানুষের ভোটাভুটির ব্যবস্থা করার প্রস্তাব দিলে আশ্চর্য হতাম না। ১২৫ জন অথবা যে সংখ্যক নাম পাওয়া গেছে তার মধ্য থেকে অনুসন্ধান কমিটি নিরপেক্ষতা দেখানোর জন্য সবার, বিশেষ করে দুই বড় পক্ষের সন্তুষ্টির ব্যবস্থা করবেন, নাকি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা রক্ষায় ন্যায্যতা নিশ্চিত করবেন, সেটাই এখন দেখার বিষয়। এ পর্যায়ে ছোটবেলায় দেখা একটি গ্রাম্য সালিশির স্মৃতিচারণ করে লেখাটি শেষ করতে চাই। গত শতকের ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ের কথা। আমাদের গ্রামের এক গৃহস্থ বাশার মোল্লার বাড়ির শেষ প্রান্তে নিজ সীমানার মধ্যে তিন পুরুষ ধরে পরপর দুটি বড় বরই (কুল) গাছে খুবই মিষ্টি বরই এবং প্রতিবছর প্রচুর ফলন হতো। আমরা উঠতি বয়সের ছেলেরা কখনও চেয়ে, আবার কখনও গোপনে ঢিল মেরে সে গাছের বরই পেড়ে খেয়েছি বহুবার। হঠাৎ একদিন শুনি, প্রতিবেশী রঙ্গু মোল্লার সঙ্গে বরই গাছের মালিকানা নিয়ে ঝগড়াঝাটি, লাঠালাঠি। যথারীতি গ্রামের সালিশ বসল। বড় মাদবর হিসেবে সব সালিশির রায় দিতেন আমার দূর সম্পর্কের এক মামা, কালাই ফকির। সব শুনে মামা বললেন, দু’জনই আমার কাছে সমান। গ্রামের সবাইকে মিলেমিশে থাকতে হবে। তাই সমান সমান বিচারের স্বার্থে আজ থেকে দু’জনেই একটি করে বরই গাছের মালিক হবে। তিন পুরুষের বরই গাছ হারালেন বাশার মোল্লা আমার মামা কালাই ফকিরের নিরপেক্ষ বিচারে। এরপর থেকে আমার সমবয়সী ছেলেপেলে দূর থেকে মামাকে নিরপেক্ষ মামা এবং সমান সমান মামা বলে ডাকতেন, আর মামা চিৎকার করে ধেয়ে আসতেন লাঠি হাতে পেটাবার জন্য। লেখক : ভূ-রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক নিউ অরলিনস, ইউএসএ
×