ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মোঃ ফজলুল হক মাস্টার

অভিমত ॥ সঠিক ভোটাধিকার প্রয়োগে...

প্রকাশিত: ০৩:৫১, ৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

অভিমত ॥ সঠিক ভোটাধিকার প্রয়োগে...

নির্বাচন রাজনীতিকদের জনপ্রিয়তা যাচাইয়ের অন্যতম উপলক্ষ এবং ক্ষমতা পাবারও সোপান। একটি রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক চর্চার ধরন কেমন এবং নাগরিকদের চরিত্র কেমন, এমনকি রাষ্ট্রচরিত্রের মাপকাঠিও নির্বাচন। নির্বাচন মানেই গণতন্ত্র নয়। আর সুষ্ঠু নির্বাচনে জয়ী সবাই যে গণতন্ত্র চর্চায় ব্রতী হয়ে উঠেন তাও নয়। গণতন্ত্র শাসকদল ও বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর আচার-আচরণ এবং নীতি-আদর্শের ওপর নির্ভর করে। ভোটের অধিকার রক্ষায় নাগরিকদের সংগ্রামের দীর্ঘ ঐতিহ্যে ভরপুর আবার শাসকদল কর্তৃক গণতন্ত্র ধ্বংস হবার ইতিহাস কদর্যে ভরা। সুষ্ঠু ভোট সম্ভব হয় না ক্ষমতা দখলের তীব্র নেশার কারণে। শাসকদল চায় ক্ষমতায় টিকে থাকতে আর বিরোধীদল চায় ক্ষমতায় যেতে। ছবিসহ ভোটার আইডি কার্ড থাকা সত্ত্বেও নাগরিকদের ভোটাধিকার রক্ষা হবে না- এটা এক ধরনের নির্লজ্জতা। এই যে নির্লজ্জতা এটাই হলো একটি রাষ্ট্রের নাগরিকদের চারিত্রিক ত্রুটি, যা গণতন্ত্রের জন্য অন্তরায় এবং সভ্যতারও। আর যখন দেখি আইনের লোকেরা, নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা কারোর পক্ষে ভোট করতে মরিয়া হয়ে লেগে যায় এটা হলো প্রশাসনিক চরিত্রের নগ্নতা। ৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারিতে ভোট কেন্দ্রে ভোট হয়নি। ভোটবাক্স ছিল জনগণের হাতে; কিন্তু ফলাফল ঘোষিত হয়েছে রাষ্ট্র পরিচালকদের নির্দেশে। এটা হলো আদর্শ বিচ্যুত বিএনপির রাজনৈতিক দেউলিয়াত্ব। ২০০১ সালে অক্টোবরের নির্বাচনের প্রাক্কালে তত্ত্বাবধায়ক প্রধান বিচারপতি লতিফুর রহমান প্রশাসনকে ব্যবহার করে সংখ্যালঘুদের ওপর প্রকাশ্যে নির্যাতন করেছে। মূলত এটা করেছে আওয়ামী ঘরানার ভোটারদের ভয়ভীতি দেখানোর হীনমানসে। এ নিয়ে তিনি দেশে-বিদেশে প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছিলেন। এম এ আজিজ ভুয়া ভোটার তালিকা তৈরি করে মূলত জোট শাসকদের ক্ষমতায় বসাতে পাঁয়তারা করেছিলেন। এটা হলো প্রশাসনিক নগ্নতা, যা রাষ্ট্রের জন্য কাম্য নয়। প্রশাসনিক নগ্নতা যতটা দৃশ্যমান হয়েছে তার সিংহভাগই বিএনপির সৃষ্টি। এমনকি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ধ্বংসের দায়ও বিএনপির। সাবেক রাষ্ট্রপতি ড. ইয়াজউদ্দিনকে তত্ত্বাবধায়ক প্রধান করা বিএনপির একটি নির্লজ্জ পদক্ষেপ ছিল। ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনও নানা কারণে প্রশ্নবিদ্ধ। তবে সর্বশেষ নারায়ণগঞ্জের সিটি নির্বাচনে আমরা প্রত্যক্ষ করলাম নির্বাচন কমিশন, সরকার এবং জনগণ, এমনকি সব রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা সুষ্ঠু ভোট অনুষ্ঠানে আন্তরিকভাবে কাজ করেছে। এভাবে আমরা সকলে মিলেমিশে ভোট সুরক্ষায় আন্তরিক হলে জনগণের ভোটের রায় কেউ পাল্টাতে পারবে না। আমরা ভোটারবিহীন কেন্দ্র দেখেছি। বাক্সবিহীন ভোটের ফলাফল ঘোষণা করতে দেখেছি; কিন্তু আমরা প্রতিবাদ গড়ে তুলিনি। পরাজিত রাজবংশধরদের জবাই করে গায়ের চামড়ার ওপরে বসে ভোজ উৎসব করার ইতিহাস রয়েছে। পিতাকে বন্দী করে, ভাইদের হত্যা করে রাজ্য দখলের ইতিহাসও রয়েছে। ক্ষমতা লাভের জন্য নিষ্ঠুর-নির্মম ইতিহাস কি লিখে শেষ করা যাবে? যাবে না। মানুষ অসহায়ের মতো এসব নিষ্ঠুরতা মেনে নিলেও তাদের তীব্রভাবে ঘৃণা করে। বাংলাদেশের স্বাধীনতায় যারা বিরোধিতা করেছিল, যারা যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত তাদের বিচারের রায়ে সাধারণ মানুষ কতটা খুশি তা কে না জানে? এই যে জামায়াত সন্ত্রাসী দল হিসেবে পরিচিত হয়ে গেল, তারা যে বোমারু তৈরি করে গড়ে তুলেছে ক্যাডার বাহিনী, এতে করে তারা যতটা ইমেজ সঙ্কটে ভুগছে তার চেয়েও বেশি জনমন থেকে দূরে চলে গেছে। আর জঙ্গীরা হত্যা, গুম এবং ত্রাস সৃষ্টি করে, ভয়ভীতি সৃষ্টি করে দল ভারি করার যে প্রকল্প নিয়ে জনগণকে দলে টানতে চেয়েছিল তার পুরোটাই ভেস্তে গেছে। কারণ, সচেতন জনগণ। আসলে গণতন্ত্র একটি প্রক্রিয়া, যাতে মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাদের পবিত্র ক্ষমতা ব্যবহারের দায়িত্ব অন্যদের হাতে তুলে দেয়। কিন্তু ক্ষমতা পেয়ে যারা এটা ভুলে যায় তারা নিমকহারাম বৈকি! জনগণের দেয়া পবিত্র ক্ষমতার অপব্যবহার করতে গিয়ে তারা নিজেদেরও সর্বনাশ ডেকে আনে। জনগণের পকেট ফুটো করে ক্ষমতাসীনরা রাতারাতি ফুলে-ফেঁপে উঠে। তারেক জিয়া অর্থবিত্তে ফুলে উঠলেও এখন নির্বাসনে করুণ পরিণতি ভোগ করছে। দুর্নীতিবাজ লুটেরাই তার খ্যাতি। বিএনপি এমনকি বিএনপির দলীয় প্রধান তার মা খালেদা জিয়া নিজেও দুর্নীতিবাজ সন্তানের হয়ে কথা বলতে লজ্জাবোধ করছেন না। আপোসহীন খ্যাত নেত্রীও ভাবছেন দুর্নীতিবাজ সন্তান তারেককে নিয়ে কথা উঠালে তারও ইমেজ সঙ্কট ঘটতে পারে, ক্ষতি হতে পারে দলের। পরিণতির ভয়াবহতা কতটা ক্ষত সৃষ্টি করে এর চেয়ে বড় নজির কিছু কি থাকতে পারে? জনগণের রায় উপেক্ষা করার হীনমানসিকতা থেকে জোটশাসন আমলে জঙ্গীদের রাষ্ট্রীয় মদদে এগিয়ে যাবার সুযোগ দেয়া হয়েছিল। সুযোগ দিয়েছিল বিএনপি-জামায়াত জোট। রাজশাহীর বাগমারাতে জঙ্গীরা মাইকে লোক জড়ো করে পুলিশের উপস্থিতিতে টার্গেটধারী প্রগতিশীল লোকদের প্রকাশ্যে হাতুড়ি, রড দিয়ে পিটিয়ে পঙ্গু করে দিয়েছিল। তাদের মূল লক্ষ্য ছিল জঙ্গীদের দিয়ে ক্ষমতায় যাওয়া বা তাদের পছন্দের সরকারকে টিকিয়ে রাখা। বিএনপি কেন জঙ্গীদের জামাই আদর করেছে তা নিয়ে গবেষণার প্রয়োজন নেই। এখন দেশে-বিদেশে কথা উঠেছে বিএনপি জামায়াত ছাড়ুক। বিএনপি তা শুনছে না। আদতে জামায়াত-বিএনপি একই উদরের দুই সোহদর- এটা প্রমাণিত সত্য। এটাও সত্য যে, দুটি দলই গণতন্ত্রবিরোধী। কিন্তু ক্ষমতাপ্রাপ্তির মোহ তাদের প্রচ-। ক্ষমতার জন্য আগুন সন্ত্রাসই বলুন আর জঙ্গী লালনই বলুন কোনটা দল দুটির জন্য অস্বাভাবিক নয়। সুষ্ঠু ভোটের মাধ্যমে খাঁটি দেশপ্রেমিকদের উঠিয়ে আনার দায়িত্ব আমাদের। অসাম্প্রদায়িক এবং গণতান্ত্রিক শক্তিকে বিজয়ী করার দায়িত্বও আমাদের। এখন রাষ্ট্র সচল। রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক চাকা গতিশীল। আমরা যদি ভুল করি তার খেসারত আমাদেরই দিতে হবে। ৭৫-এর ১৫ আগস্টের পর রাষ্ট্র দীর্ঘদিন পিছিয়ে ছিলো। ক্ষতি হয়েছে আমাদের। ক্ষতি হয়েছে রাষ্ট্রের, যা কল্পনাতীত। আমরা যেমন ভোটাধিকার চাই, তেমনি ভোটের সঠিক ব্যবহারে প্রত্যয়ী হওয়ার দায়িত্বও প্রত্যাশা করি। লেখক : শিক্ষাবিদ
×