ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

মোস্তাফা জব্বার

একুশ শতক ॥ শিল্প বিপ্লবের ডিজিটাল স্তর

প্রকাশিত: ০৩:৫০, ৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

একুশ শতক ॥ শিল্প বিপ্লবের ডিজিটাল স্তর

॥ এক ॥ অনেকেই পড়ে থাকবেন খবরটা, দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকার গত ২৩ জানুয়ারি ১৬ খুব গুরুত্ব দিয়ে এটি প্রকাশ করেছে। দেশের অন্য মিডিয়াতেও এর প্রভাব পড়েছে। এই খবরের ওপর ভিত্তি করে একটি মিডিয়া থেকে সাক্ষাৎকার নিতে এসে নানা প্রশ্ন তুলে ধরেছিল আমার সামনে। আমি ধারণা করি, যারা সচেতন তাদের অনেকেই এই খবরটি পড়ে নিজের মাঝেই নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছেন। কেউ কেউ হয়তো বন্ধু-বান্ধবকে প্রশ্ন করেছেন বা কেউ কেউ হয়তো গুগলে খুঁজেছেন এই খবরের পেছনের খবর পেতে। সমাজবিজ্ঞানী, রাষ্ট্রপতি, ব্যবসায়ী, শিক্ষাবিদ, অর্থনীতিবিদ, শিল্পপতি ও রাষ্ট্রনায়ক কারও কাছেই খবরটি কম গুরুত্ব বহন করে না। আসুন আগে খবরটির ভূমিকাটি পাঠ করি, ‘মানবসভ্যতার ইতিহাসে এখন পর্যন্ত তিনটি শিল্প বিপ্লব পাল্টে দিয়েছে সারাবিশ্বের গতিপথ। প্রথম শিল্প বিপ্লবটি হয়েছিল ১৭৮৪ সালে বাষ্পীয় ইঞ্জিন আবিষ্কারের মাধ্যমে। এরপর ১৮৭০ সালে বিদ্যুত ও ১৯৬৯ সালে ইন্টারনেটের আবিষ্কার শিল্প বিপ্লবের গতিকে বাড়িয়ে দেয় কয়েকগুণ। তবে আগের তিনটি বিপ্লবকে ছাড়িয়ে যেতে পারে ডিজিটাল বিপ্লব। এ নিয়েই এখন সারা দুনিয়ায় তোলপাড় চলছে। এটিকে এখন বলা হচ্ছে চতুর্থ শিল্প বিপ্লব।’ ডিজিটাল বিপ্লবকে কেন চতুর্থ শিল্প বিপ্লব বলা হচ্ছে, সেটি নিয়ে আলোচনার জন্য সারাবিশ্বের রাজনৈতিক নেতা, বহুজাতিক কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী, উদ্যোক্তা, প্রযুক্তিবিদ ও বিশ্লেষকরা জড়ো হয়েছিলেন সুইজারল্যান্ডের শহর দাভোসে। সেখানে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের (ডব্লিউইএফ) বার্ষিক সম্মেলনে আলোচনার অন্যতম বিষয় ছিল চতুর্থ শিল্প বিপ্লব। ডিজিটাল শিল্প বিপ্লবকে নিয়ে সেখানে হয়েছে আলোচনা-সমালোচনা ও বিশ্লেষণ। ইতিমধ্যেই ২০-২৩ জানুয়ারি ১৬ সম্মেলনটি অনুষ্ঠিত হয়েছে। মূলত এই সম্মেলনের প্রতিপাদ্য বিষয়ই ছিল চতুর্থ শিল্প বিপ্লব। স্মরণ করা ভাল ২০১৭ সালেও একই স্থানে ১৭-২০ জানুয়ারি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এবারের সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দলও অংশগ্রহণ করে। এবার নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে এবং দুনিয়ার রূপান্তরটি নিয়ে অনেক বেশি চর্চা হয়েছে। তবে ১৬ সালের সম্মেলনটি ডিজিটাল শিল্প বিপ্লবের জন্য অনেক বেশি আলোচিত। ২০১৬ সালের সম্মেলনে ব্যাপকভাবে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের বিষয়টি আলোচিত হয় এবং সম্মেলনে চমৎকার সব উপাত্ত প্রকাশিত হয়। http://www.weforum.org/events/world-economic-forum-annual-meeting-২০১৬। খবরটি আমাকে কিছুটা অবাক করেছে। কারণ, দুনিয়ার এতো বুদ্ধিমান ও জ্ঞানী মানুষেরা এতদিন পরে ডিজিটাল বিপ্লবের বিষয়টি টের পেলেন আর এটাকে আরও একটি শিল্প বিপ্লব হিসেবে চিহ্নিত করলেন কেন? মানবসভ্যতার ইতিহাস ব্যাখ্যা করতে এদের তো ভুল হবার কথা নয়। এর আগে এ্যালভিন টফলারের মতো মানুষেরা মানবসভ্যতার বিকাশে কৃষি যুগের পর একটি শিল্প বিপ্লবের কথাই বলেছেন। তিনি ডিজিটাল বিপ্লবকে মানবসভ্যতার তৃতীয় বিপ্লব বলেছিলেন। তার হিসাবটি ছিল যে, মানুষ কৃষি বিপ্লব করেছে, এরপর শিল্প বিপ্লব করেছে এবং তৃতীয় বিপ্লবটিই হচ্ছে ডিজিটাল বিপ্লব। ১৯২৮ সালে আমেরিকার নিউইয়র্কে জন্ম নেয়া এ্যালভিন টফলার তার ধারণা প্রকাশ করেছেন এভাবে: First Wave is the society after and replaced the first cultures. Second Wave is the society during the (ca. late 17th century through the mid-20th century). The main components of the Second Wave society are , factory-type education system, and the corporation. Toffler writes: “The Second Wave Society is industrial and based on , , , , mass media, mass , mass entertainment, and . You combine those things with , , concentration, and synchronization, and you wind up with a style of organization we call .” টফলারের এই বিবরণের কোন তুলনা নেই। তিনি অতি সামান্য কথায় এতো সুন্দরভাবে শিল্প বিপ্লব ও তার পরের সমাজ এবং তার সামগ্রিক চিত্র তুলে ধরেছেন যে, মুগ্ধ না হয়ে পারা যায় না। তিনি পরের বিপ্লবটাকেই তৃতীয় বিপ্লব বলেছেন। তার নিজের কাছে এই তৃতীয় বিপ্লবটি হচ্ছে তথ্য যুগ, মহাকাশ যুগ, ইলেকট্রনিক যুগ, গ্লোবাল ভিলেজ বা প্রযুক্তি যুগ। Third Wave is the . According to Toffler, since the late 1950s, most nations have been moving away from a Second Wave Society into what he would call a Third Wave Society, one based on actionable knowledge as a primary resource. His description of this () dovetails into other writers’ concepts (like the , , Era, , age, scientific-technological revolution), which to various degrees predicted demassification, diversity, knowledge-based production, and the acceleration of change (one of Toffler’s key maxims is “change is non-linear and can go backwards, forwards and sideways”). টফলার ডিজিটাল যুগটির পুরো চরিত্র ব্যাখ্যা করতে সক্ষম না হলেও অন্তত এটি বোঝাতে পেরেছেন যে, উৎপাদন ব্যবস্থা জ্ঞানভিত্তিক হবে। তবে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের নেতাদের ভাষ্য আমাকে হতাশ করেছে। তাদের মতামত অনুসারে কেবল বিদ্যুত একটি শিল্প বিপ্লব সংঘটিত করেছে বলে মনে করি না। বরং বাষ্পীয় ইঞ্জিন থেকে আজ পর্যন্ত মেকানিক্যাল, ইলেকট্রিক্যাল ও ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করেই শিল্প বিপ্লব গড়ে উঠেছে। এসব প্রযুক্তিকে শিল্প বিপ্লবের তিনটি স্তর অবশ্যই বলা যায়। তবে ইন্টারনেট একটি শিল্প বিপ্লব সংঘটিত করেছে, নাকি একটি সভ্যতার জন্ম দিয়েছে সেটিও আমাদের স্থির করতে হবে। অন্যদিকে একটি শিল্প বিপ্লবকেই আবিষ্কারসমূহ আরও গতিশীল করেছে কিনা সেটি উপলব্ধি করার বিষয়। আমার নিজের কাছে বিস্ময়ের বিষয় যে, তারা কি টফলারের বইটিও পড়েননি? প্রথম আলোর খবরে উল্লেখ ছিল যে, ‘ডব্লিউইএফের প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী প্রধান ক্লাউস শোয়াব চতুর্থ শিল্প বিপ্লব নিয়ে নিজের লেখা একটি প্রবন্ধে বলেছেন, ‘আমরা চাই বা না চাই, এতদিন পর্যন্ত আমাদের জীবনধারা, কাজকর্ম, চিন্তাচেতনা যেভাবে চলেছে সেটা বদলে যেতে শুরু করেছে। এখন আমরা এক প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। দ্বিতীয় ও তৃতীয় শিল্প বিপ্লবের ভিত্তির ওপর শুরু হওয়া ডিজিটাল এ বিপ্লবের ফলে সবকিছুর পরিবর্তন হচ্ছে গাণিতিক হারে, যা আগে কখনও হয়নি। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, বিশ্বের প্রতিটি দেশের প্রতিটি খাতে এ পরিবর্তন প্রভাব ফেলছে, যার ফলে পাল্টে যাচ্ছে উৎপাদন প্রক্রিয়া, ব্যবস্থাপনা, এমনকি রাষ্ট্র চালানোর প্রক্রিয়া। ডিজিটাল বিপ্লব কী সে বিষয়টিরও বিশদ একটি ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করেছেন ক্লাউস শোয়াব। স্মার্টফোনের মাধ্যমে সারাবিশ্বের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের পরিবর্তন, ইন্টারনেট অব থিংস, যন্ত্রপাতি পরিচালনায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগ, রোবোটিকস, জৈবপ্রযুক্তি, কোয়ান্টাম কম্পিউটিংয়ের মতো বিষয়গুলো চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সূচনা করেছে বলে তিনি মনে করেন। ডিজিটাল বিপ্লবের এই শক্তির চিত্রটি বিশ্বব্যাংকের সম্প্রতি প্রকাশিত ‘ডিজিটাল ডিভিডেন্ডস’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনেও উঠে এসেছে। এতে বলা হয়েছে, ইন্টারনেটের মাধ্যমে এখন একদিনে বিশ্বে ২০ হাজার ৭০০ কোটি ই-মেইল পাঠানো হয়, গুগলে ৪২০ কোটি বিভিন্ন বিষয় খোঁজা হয়। এক যুগ আগেও তথ্য-প্রযুক্তির ক্ষেত্রে এ পরিবর্তনগুলো ছিল অকল্পনীয়। ডিজিটাল বিপ্লব সম্পর্কে বহুজাতিক মোবাইল অপারেটর ডিজিসেলের চেয়ারম্যান ডেনিস ও ব্রায়েন বলেন, ‘চতুর্থ শিল্প বিপ্লব হিসেবে ডিজিটালাইজেশন আমাদের কাজের সব ক্ষেত্রে ইতোমধ্যে বিশাল পরিবর্তন নিয়ে এসেছে, তবে এই পরিবর্তনকে আমি দেখি সূচনা হিসেবে। আগামী ১০ বছরে ডিজিটাল বিপ্লবের ফলে আমরা এমন সব পরিবর্তনের মুখোমুখি হতে যাচ্ছি, যা এর আগে ৫০ বছরে সম্ভব হয়নি। ‘চতুর্থ এই শিল্প বিপ্লব সারাবিশ্বের মানুষের জীবনমান উন্নয়নে কী প্রভাব ফেলবে, সেটি নিয়ে দুই ধরনের মত পাওয়া যাচ্ছে। একদল বিশেষজ্ঞ বলছেন, এর ফলে সব মানুষেরই আয়ের পরিমাণ ও জীবনমান বাডবে। বিশ্বের পণ্য সরবরাহ প্রক্রিয়াতেও ডিজিটাল প্রযুক্তি আনবে ব্যাপক পরিবর্তন। এক দেশ থেকে আরেক দেশে পণ্য পাঠানোর খরচ অনেক কমে আসবে, ইতিবাচক প্রভাব পড়বে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে। তবে আরেক দল অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞ মনে করেন, ডিজিটাল বিপ্লব বিশ্বের অসাম্য ও দারিদ্র্য পরিস্থিতিকে আরও দুর্বিষহ পর্যায়ে নিয়ে যাবে। ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধির ফলে মানুষের দ্বারা সম্পন্ন অনেক কাজ রোবট ও যন্ত্রপাতি দিয়ে সম্পন্ন করা হবে। এর ফলে নতুন কর্মসংস্থান তৈরিতে তা সমস্যা তৈরি করবে। এ ছাড়া শ্রমবাজারে অল্প কর্মদক্ষ শ্রমিকদের চাহিদা ও বাজার কমে যাবে, যা উন্নয়নশীল দেশগুলোকে বেশি করে সমস্যায় ফেলবে। ডিজিটাল বিপ্লবের আরও একটি সমস্যা নিয়ে বেশ আলোচনা-সমালোচনা চলছে। এর ফলে সারাবিশ্বে সম্পদ বৈষম্য আগের যে কোন সময়ের চেয়ে বাড়বে বলে অনেকের আশঙ্কা। ডিজিটাল প্রযুক্তির আবিষ্কারক, বিনিয়োগকারী দেশগুলো এর থেকে যতটা লাভবান হবে, অন্য দেশগুলো সেটা থেকে বঞ্চিত হবে। বিষয়টিকে জয়ী পক্ষের সব ছিনিয়ে নেয়ার সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও ডিজিটাল বিপ্লবের প্রভাব হবে ব্যাপক। ব্যতিক্রমী পণ্যসেবার পাশাপাশি নিয়ত পরিবর্তনশীল গ্রাহক চাহিদা পূরণে কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোকে টিকে থাকতে হলে প্রযুক্তি ব্যবহারে সর্বোচ্চ দক্ষতা অর্জন করতে হবে। সরকার পরিচালনা ও নীতিনির্ধারণেও ডিজিটাল বিপ্লব আনবে বড় পরিবর্তন। প্রযুক্তি বিপ্লব সরকারী সেবাকে একদিকে সাধারণ মানুষের হাতের নাগালে নিয়ে আসবে, অন্যদিকে বিধ্বংসী মারণাস্ত্রের সহজলভ্যতা রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের ঝুঁকিও বাড়াবে। নিরাপত্তা ঝুঁকির এ বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবই যে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা করবে, সেই আশঙ্কাও করছেন বিশ্লেষকরা।’ অর্থনীতি ফোরামের নেতারা নিজেদের অনেক প-িত বিবেচনা করে এসব নিয়ে এতদিনে আলোচনা করলেও দুনিয়ার বহু মানুষ এই সময়টিকে ডিজিটাল সভ্যতার সময় হিসেবে অনেক আগেই চিহ্নিত করেছেন। খোদ জাতিসংঘ একটি জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠনের কথাও বলেছে। সম্মেলন-কর্মসূচী প্রতিদিন ডিজিটাল বিপ্লবকে ঘিরেই প্রণীত হচ্ছে। আমি অবাক হই যে, তারা এতদিন ঘুমিয়ে ছিলেন কেন? তারা কি গুগলের প্রধান নির্বাহী এরিক স্মিথ এবং পরিচালক র্জাড কোহেনের দি নিউ ডিজিটাল এজ বইটিও পড়েননি? তারা কি এটিও জানেন না যে, বাংলাদেশের মতো একটি দেশ ২০০৮ সালে ডিজিটাল রূপান্তরের কর্মসূচী গ্রহণ করেছে? আমাদের অবশ্যই জানতে হবে- তারা শেষাবধি ডিজিটাল বিপ্লবকে কেমনভাবে আলিঙ্গন করার কথা ভাবছেন। (আগামী সপ্তাহে সমাপ্ত) ঢাকা, ২ ফেব্রুয়ারি, ১৭ ॥ লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাস-এর চেয়ারম্যান- সাংবাদিক, বিজয় কীবোর্ড ও সফটওয়্যার এবং ডিজিটাল বাংলাদেশ ধারণা ও কর্মসূচীর প্রণেতা ॥ ই-মেইল : [email protected], ওয়েবপেজ :ww w.bijoyekushe.net
×