ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

দখল দূষণের শিকার কেরানীগঞ্জের খাল

প্রকাশিত: ০৫:৩৬, ৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

দখল দূষণের শিকার কেরানীগঞ্জের খাল

নিজস্ব সংবাদদাতা, কেরানীগঞ্জ ॥ দূষণ ও দখলের শিকার কেরানীগঞ্জের শাখা খালগুলো। শাখা খালগুলো ভরাট করে গড়ে তোলা হয়েছে অবৈধ স্থাপনা। ফলে অনেক খালের পানিপ্রবাহ বন্ধ হয়ে গেছে। ভূমিদস্যুরা কিছু খাল সম্পূর্ণ ভরাট করে ফেলেছে। আবার কিছু সরকারী ডোবা ও খাল অর্ধেক ভরাট করে ইতোমধ্যে বসতভিটা নির্মাণ করেছে। আবার কিছু খাল অর্ধেক ভরাট করে রাস্তা তৈরি করা হয়েছে অপরিকল্পিতভাবে। বাকি খালগুলো ধীরে ধীরে দখলের প্রক্রিয়া চলছে। এসব শাখা খালগুলোর অধিকাংশই বয়ে গেছে কেরানীগঞ্জের ভেতর দিয়ে। সর্বত্র ভরাটের ফলে ঐতিহ্যবাহী কেরানীগঞ্জ মারাত্মক পরিবেশ দূষণের কবলে পড়েছে। খালগুলো এমনভাবে ভরাট করা হয়েছে যে বর্ষায় এসব খালের পানি উপচে পড়ে। আবার সামান্য বৃষ্টি হলেই দেখা দিচ্ছে জলাবদ্ধতা। সুষ্ঠু ড্রেনেজ ব্যবস্থা না থাকায় সৃষ্ট জলাবদ্ধতা থেকে পরিবেশ দূষণের শিকার হচ্ছে এলাকাবাসী। নদ-নদীর নাব্য রক্ষা ও গতিপ্রবাহ স্বাভাবিক রাখতে গঠিত টাস্কফোর্সের এক সভায় নদী ও খাল শাখাগুলো দখলমুক্ত করার জন্য অতি অল্প সময়ে অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বিআইডব্লিউটিএ, পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) ও উপজেলা প্রশাসন। তবে কিছু ভূমিদস্যু জাল জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে আদালতে মিথ্য মামলা করে অভিযান চালানোর কালক্ষেপণ করছে। ইতোমধ্যে নদী ও খাল কি কি পন্থা অবলম্বন করলে অতিদ্রুত দখলমুক্ত করে সীমানা নির্ধারণ করা যায় সে বিষয়েও তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ইতোপূর্বে বিআইডব্লিউটিএ সীমানা নির্ধারণ করেছে। কিন্তু ভূমিদস্যুদের দাপটে সেটা ঠিকমতো কার্যকরী হয়নি। তাই প্রাথমিক তালিকা অনুযায়ী উচ্ছেদ অভিযান পুনরায় চালানো হবে। এরপর সীমানা চিহ্নিত করার পর চালানো হবে চূড়ান্ত উচ্ছেদ অভিযান। প্রাথমিক অভিযান আরও দুই মাস আগে চালানোর কথা থাকলেও বিবিধ কারণে তা সম্ভব হয়ে উঠেনি। তবে সূত্রমতে জানা যায়, আগামী ফেব্রুয়ারি ও মার্চ মাস নাগাদ পুনরায় উচ্ছেদ অভিযান চালানো হবে। ইতোমধ্যে পানগাঁও থেকে তুরাগ পর্যন্ত তালিকা সম্পন্ন হয়েছে। কেরানীগঞ্জে ১৬৭ বর্গকিলোমিটার এলাকায় খাল ও শাখা খাল ছিল ৫শ’র অধিক। স্বাধীনতার পর থেকে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ক্ষমতার দাপটে নদীর তীর, খাল ও শাখা খালগুলো বিনা বাধায় দখল করে নিয়েছে। আর এর সঙ্গে জড়িত রয়েছে কেরানীগঞ্জ উপজেলা ভূমি রাজস্বের কিছু অসাধু কর্মকর্তা ও কর্মচারীবৃন্দ। ইতোমধ্যে কেরানীগঞ্জের অনেক শাখা খাল দখল হয়ে গেছে। সেগুলো হলোÑ পানগাঁও, চ-ীতলা, গোলাম বাজার, পার গেন্ডারিয়া, নজরগঞ্জ, মনু বেপারীর ঢাল, নেকরোজবাগ, রোহিতপুর, হযরতপুর, হাজারীবাগ, মৌলভীর পুকুর পার, বেয়ারা ও ঢাকা জুট মিল ইউনিয়নের শাখা খালগুলোই অধিকাংশই দখল আর দূষণের শিকার। স্বাধীনতার পর থেকে ভূমিদস্যুরা ডোবানালা ও খালগুলো ভরাট করে গড়ে তুলেছে অবৈধ স্থাপনা। প্রশাসনের নীরবতার সুযোগ নিচ্ছে এসব ভূমিদস্যুরা। আবার অনেক ভূমিদস্যু ভূমি রাজস্বের সঙ্গে সখ্য গড়ে ড্রেজার চালিয়ে রাতারাতি ভরাট করেছে শাখা খালগুলো। কালেক্টরের অনুমতি ছাড়া ভূমির কাঠামোর পরিবর্তন করা বেআইনী হলেও ভূমিদস্যুরা সেদিকে তোয়াক্কা না করে দিনরাত মাটি ভরাটের কাজ করে যাচ্ছে। অবৈধ দখল আর দূষণের কারণে এমনকি সিংহ নদী পর্যন্ত তারা দখল করে নিয়েছে। আর কিছু মাটি চোর রাতের আঁধারে বিক্রি করছে নদীর বালি ও মাটি। এরা অবশ্য থানা পুলিশের অসাধু কর্মকর্তাদের সঙ্গে আতাত করে এসব কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। সিংহ নদী হারিয়ে ফেলেছে তার পুরনো ঐতিহ্য। ইতোমধ্যে নদীটির প্রায় ২০ কিলোমিটার এলাকা দখল করে গড়ে তুলেছে মার্কেট, শপিং মলসহ বহুতল ভবন। ভুয়া জাল কাগজপত্র তৈরি করে আবার কেউ রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় থেকে দখল করে নিচ্ছে নদী ও খালের এসব জায়গা। অথচ এ শাখা খালগুলো দিয়ে কোন এক সময়ে লোকজন নৌকাযোগে বুড়িগঙ্গা ধলেশ্বরীতে নিয়মিত যাতায়াত করত। ব্যবসায়ীরা এ নদী দিয়ে রাজেন্দ্রপুর, বিক্রমপুর, শরীয়তপুর, মাদারীপুর, ফরিদপুর, দিনাজপুর, রাজশাহী, যশোর, কুষ্টিয়া, বরিশাল, খুলনা এমনকি ভারতের সঙ্গে যোগাযোগের ক্ষেত্রে ব্যবহার করত। নদী দখল ও দূষণ রোধে রয়েছে সুনির্দিষ্ট আইন। ১৯৯৫ সালের পরিবেশ সংরক্ষণ আইন এবং ২০০০ সালের জলাধার সংরক্ষণ আইনে নদীর স্বাভাবিক গতি বাধাগ্রস্ত করা বেআইনী। পরিবেশ সংরক্ষণ আইনে বলা হয়েছে, পরিবেশ দূষিত হয় বা নষ্ট হয় এমন কর্মকা- সম্পূর্ণ নিষেধ এবং বেআইনী। জলাধার সংরক্ষণ আইনে বলা হয়েছে, নদী খাল বিল ও লেকের অবস্থার পরিবর্তন করা যাবে না। কিন্তু আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগের অভাবেই ভূমিদস্যুরা প্রশাসনের নাকের ডগায় এ কাজ করে যাচ্ছে। এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে পরিবেশবিদ আবু নাসের খান জনকণ্ঠকে বলেন, ঔপনিবেশিক শাসনামাল থেকেই কেরানীগঞ্জ একটি ঐতিহ্যবাহী এলাকা ছিল। খাল, শাখা খাল ও ডোবানালায় ভরপুর ছিল এলাকাটি। দিনের পর দিন ভূমিদস্যুরা অপরিকল্পিতভাবে বালু ভরাট করে পানির প্রবাহ বন্ধ করে দিয়েছে। ফলে ঢাকা শহরে পানির তীব্র সঙ্কট দেখা দিয়েছে। কেরানীগঞ্জ উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) পারভেজুর রহমান বলেন, অপরিকল্পিতভাবে মাটি ভরাট করার কারণে এই এলাকার জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে এবং খাল ও শাখা খালগুলো মৃত প্রায়। ফলে পরিবেশ দূষণ মারাত্মক আকার ধারণ করছে। তিনি বলেন, জেলা প্রশাসকের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে এ বিষয়ে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হবে।
×