ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

নওগাঁর ভাষাসৈনিকদের বীরত্বগাথা অবদান

প্রকাশিত: ০৫:৩৫, ৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

নওগাঁর ভাষাসৈনিকদের বীরত্বগাথা অবদান

বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে উত্তরের নওগাঁ জেলার (তৎকালীন মহকুমা) দামাল ছেলেদের বীরত্বগাথা অবদানকে খাটো করে দেখার অবকাশ নেই। তাদের বীরত্বগাথা লড়াই সংগ্রামের ফলেই আজ বাংলা ভাষা ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা’ হিসেবে শুধু বাংলাদেশেই নয়, গোটা বিশ্বে স্বীকৃতি লাভ করেছে। সে সময় রাষ্ট্রভাষা বাংলাকে প্রতিষ্ঠিত করার দাবিতে গোটা দেশে ছাত্রসমাজ রুখে দাঁড়ায়। উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার প্রতিবাদে বাঙালী তরুণ সমাজ প্রতিবাদমুখর হয়ে ওঠে। তারা দাবি জানায়, বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করতে হবে। কিন্তু পশ্চিমা শাসকরা বাঙালীর এই দাবিকে না মেনে আন্দোলনকারী বাঙালী ছাত্রসমাজের মিছিলে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি নির্বিচারে গুলি চালায়। সেখানে সালাম, বরকত, জব্বারসহ বেশ কয়েকজন তরতাজা যুবক শহীদ হন। সেই সময় নওগাঁর অনেক যুবক আন্দোলনে অংশ নিয়ে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার দাবিতে হুলিয়া ও জেল-জুলুম ভোগ করেছেন। তাঁদের অনেকেই ইতোমধ্যে না- ফেরার দেশে চলে গেছেন। যারা বেঁচে আছেন, তাঁদের মধ্যে কথা হলো, দুই ভাষা সৈনিকের সঙ্গে। তাঁরা হলেন, প্রবীণ রাজনীতিবিদ, এমএ রকীব ও প্রবীণ শিক্ষাবিদ মোঃ আলতাফ হোসেন। এই দুই প্রবীণ ভাষাসৈনিক তাঁদের সময়ের স্বচ্ছ রাজনীতি আর গণতন্ত্রের জন্য বাঙালীর আত্মদানের কথা ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে বলে দাবি করেন। মঙ্গলবার ভাষাসৈনিক প্রবীণ রাজনীতিবিদ এমএ রকীব (৮৮) তাঁর শহরের সরিষাহাটির ‘দ্বীন মঞ্জিল’ বাসায় গেলে তিনি ভাষা আন্দোলনে নওগাঁর ছেলেদের বীরত্বগাথা অবদানের কথা বলতে শুরু করেন। তিনি বলেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ লগ্নে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ প্রাঙ্গণে সেনানিবাস ছিল। সেই সেনানিবাসের ছাত্ররাই ছিল তখনকার ভাষা আন্দোলনের সঙ্গী ও প্রত্যক্ষদর্শী। সে সময় ঢাকা মেডিক্যালের ছাত্রাবাসে থাকতেন নওগাঁ শহরের সুলতানপুর মহল্লার ভাষা সৈনিক ডা. মঞ্জুর হোসেন। এছাড়া ডা. আমজাদ হোসেন তরফদার, ডা. আবদুল কাইয়ুম খান, ডা. আবু তায়েব মোফাখ্খার হোসেন এরা সকলেই ভাষাসৈনিক। তাঁরা নওগাঁর সন্তান হলেও সে সময় তাঁরা ঢাকা মেডিক্যালে পড়াশোনা করতেন এবং ছাত্রাবাসে থেকে বাংলা ভাষার জন্য আন্দোলন করেছেন। তিনি বলেন, ১৯৫৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবসের ১ম বার্ষিকী নওগাঁয় ঘটা করে পালন করা হয়। কিন্তু প্রগতিশীল ধারার এই আন্দোলন যাতে সফল হতে না পারে, এই লক্ষ্যে এমএ রকিব, খালেদ তাহের মকু ও এএনএম মোজাহারুল হকের বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি করা হয়। তাঁরা আত্মগোপনে থেকে নওগাঁ, রানীনগর, ছাতিয়ানগ্রাম, তিলকপুর ও নশরৎপুর রেল স্টেশন এলাকায় হেঁটে বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে সাধারণ মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করেন। তিনি বলেন, উর্দু ভাষা পাকিস্তানের কোন প্রদেশের মাতৃভাষা ছিল না। তার পরেও শুধুমাত্র বাঙালীদের সরকারী চাকরি থেকে বঞ্চিতসহ নানাভাবে দমিয়ে রাখার লক্ষ্যে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করা হয়েছিল। ১৯৪৭ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করে তিনি কলকাতায় কলেজে ভর্তি হন। পরবর্তীতে এখানে ’৫২-এর ভাষা আন্দোলনে যুক্ত হন। ভাষাসৈনিক হওয়ায় এবং যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে জয়ী হওয়ায় ১৯৫৫ সালে তাঁকে কারারুদ্ধ করা হয়। এমনকি তার সকল সম্পদ ক্রোক করা হয়। আরেক ভাষাসৈনিক বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ মোঃ আলতাফ হোসেন (৮২) ’৫২-এর ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিচারণের শুরুতেই বলেন, ‘আমি কোন ভাষাসৈনিক ছিলাম না। ভাষাসৈনিক কথাটি ব্যাপক। আমি একজন ভাষা আন্দোলনের শ্রমিক ছিলাম। তিনি বলেন, ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করে ১৯৫১ সালে রাজশাহী কলেজে ভর্তি হই। ’৫২-এর সালের ফেব্রুয়ারি মাসে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে সারাদেশের ছাত্রসমাজ তখন রাজপথ উত্তপ্ত করে তোলে। ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় মিছিলে গুলিবর্ষণের ঘটনায় সারাদেশ তখন উত্তপ্ত। সে সময় রাজশাহী কলেজের ৩য় বর্ষের ছাত্র গোলাম আরিফ টিপু আমাদের নেতা ছিলেন। তার নির্দেশে ২২ ফেব্রুয়ারি রাতে রাজশাহী কলেজ হোস্টেলের সামনে ইট দিয়ে একটি শহীদ মিনার তৈরি করা হয়। সম্ভবত এটিই দেশের প্রথম শহীদ মিনার ছিল। আমরা কাঁধে করে ইট বহন করেছি শহীদ মিনারের। পরে পুলিশ তা ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দেয়। ২৩ ফেব্রুয়ারি সর্বাত্মক হরতার পালিত হয়। সেই হরতালে রাজশাহী সিএ্যাডবি এলাকায় আমিসহ কয়েকজনকে পিকেটিংয়ের দায়িত্ব দেয়া হয়। আমরা সিএ্যান্ডবি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সামনে মাটিতে শুয়ে পড়ে হাত জোড় করে অফিস না করার অনুরোধ জানালে তারা অফিসের কাজ বন্ধ রেখে হরতালে শামিল হন। এ সময় পুলিশ এসে আমাদের টেনে-হিঁচড়ে গাড়িতে তুলে নিয়ে যায়। রাতে পুটিয়া-বানেশ্বর এলাকায় আমাদের ছেড়ে দেয়া হয়। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, তখন আমরা পিকেটিং করেছি হাত জোড় করে। আর এখন পিকেটিং হয় হাতে লাঠি নিয়ে। তখন হয়েছে হরতাল। কেউ না মানলেও বলার কিছুই ছিল না। কিন্তু এখন হয় ‘ভয়তাল’। এই শিক্ষাবিদ ভাষাসৈনিক বলেন, গণতন্ত্রের মূলকথা হলো, আমরা দাবি দাওয়া আদায়ের লক্ষ্যে আন্দোলন করব। কিন্তু অন্যের অধিকার ক্ষুণœ করে নয়। বায়ান্নর ভাষাসৈনিক এই শিক্ষাবিদ বর্তমানে শহরের চকদেবপাড়ার ‘নূরমহল’ বাসভবনে সপরিবারে বসবাস করেন। Ñবিশ্বজিৎ মনি, নওগাঁ থেকে
×