ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মাদারীপুরে তিন ভাষা সংগ্রামী

প্রকাশিত: ০৫:৩৫, ৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

মাদারীপুরে তিন ভাষা সংগ্রামী

বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে মাদারীপুরে যারা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এবং এ আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন তাদের অনেকে আজ জীবিত নেই। সে সময় যে ১২ জন নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে বেঁচে আছেন ৩ জন। এরা হলেন ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক এটিএম নূরুল হক খান, ভাষা সংগ্রামী গোলাম মোস্তফা আখন্দ রতন (শিবচর) ও ভাষা সংগ্রামী আবদুল হাই তালুকদার। মহান ভাষা আন্দোলনের জীবন্ত এই ৩ কিংবদন্তী বর্তমানে জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। এটিএম নূরুল হক খান ॥ ভাষা সংগ্রামী এটিএম নূরুল হক খান ছিলেন ’৫২-এর ভাষা আন্দোলনে মাদারীপুর জেলার ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক। পরবর্তীতে সমাজসেবক, রাজনীতিবিদ ও নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি ছিলেন। ভাষা আন্দোলনের নেতৃস্থানীয়দের একজন ছিলেন তিনি। জীবনের প্রতিটি স্তরে অত্যন্ত ধৈর্যের সাথে সকল প্রতিকূলতা অতিক্রম করে সমাজের সাফল্যের শীর্ষে অবতরণ করেছেন। অর্জন করেছেন মানুষের শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা। সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিম-লে তিনি ছিলেন নীতি-আদর্শের পথিকৃৎ। ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ ছিল তাঁর জীবনের বড় অর্জন। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি ও সংগ্রামে নিজেকে সম্পৃক্ত করে তিনি যুব ও ছাত্র সমাজকে এক ছাদের নিচে এনেছিলেন। ছাত্র থাকা অবস্থায় তাঁর মতো নীতিবান, সাহসী, ত্যাগী ও সংগ্রামী নেতা মাদারীপুরে বিরল। ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার কারণে ৩ বার ১১ মাস কারা ভোগ করেছেন। তাঁকে নিয়ে কোন লেখালেখি হয়নি। বড় বড় মানুষের ভিড়ে ইতিহাসের পাতায় তাঁর নামও নেই। অথচ ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার কারণে তৎকালীন সরকার তাঁকে রাষ্টিকেট করেছিল। এতে চিরকালের জন্য বন্ধ হয়েছিল তাঁর লেখাপড়া। পরবর্তীতে দীর্ঘদিন বহু সংগ্রাম করে ১৯৬৫ সালে পরীক্ষা দেওয়ার অনুমতি পেয়েছিলেন তিনি। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে তিনি ছিলেন অনড়। রাজনৈতিক জীবনে রাজনীতি করার সুবাদে তিনি সোভিয়েত ইউনিয়ন সফর করার সুযোগ পেয়েছিলেন। ভাষা আন্দোলনের তিনি এক জীবন্ত কিংবদন্তী, বয়সের ভাড়ে ন্যূয়ে পড়েছেন। তিনি বর্তমানে ঢাকার মিরপুরে বাসা ভাড়া নিয়ে বসবাস করছেন। তিনি ১৯৬৫ সালে এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে পাস করে নাজিমউদ্দিন কলেজে ভর্তি হন। এ কলেজ থেকে তিনি এইচএসসি ও ডিগ্রি পাস করেন। ছাত্র জীবনে তিনি ভাষানী ন্যাপ ও পরে ন্যাশলান আওয়ামী পার্টি (মোজাফফর) রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। তিনি ছিলেন মাদারীপুর মহকুমার আহ্বায়ক এবং পরে সভাপতি নির্বাচিত হন। রাজনীতির সমাজতান্ত্রিক ধ্যান ধারণা আয়ত্ত করা ও সমাজতন্ত্র কায়েম করার উদ্দেশ্যে ১৯৭৪ সালে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির পক্ষ থেকে রাশিয়া সরকারের আমন্ত্রণে সোভিয়েত ইউনিয়নে গমন করেন। ১৯৭৫ সালে তিনি দেশে ফিরে আসেন। ১৯৭৭ সালে তিনি খোয়াজপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। তিনি ছিলেন থানা উন্নয়ন কমিটির সভাপতি। এ সময় তিনি এলাকার উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রাখেন। তিনি স্বনির্ভর প্রকল্পের মাদারীপুর অঞ্চলের উদ্যোক্তা ছিলেন ১৯৯৩ সালে এটিএম নুরুল হক পুনরায় খোয়াজপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। মূলত তখন থেকেই তিনি সর্বহারাদের টার্গেট হন। যে কারণে বাড়ি-ঘর ছেড়ে ঢাকায় চলে যেতে বাধ্য হন। গোলাম মোস্তফা আখন্দ রতন ॥ ভাষাসৈনিক গোলাম মোস্তফা আখন্দ রতন বাংলা ভাষা আন্দোলনের এক অন্যতম সৈনিক। ১৯৪৮ সালে মায়ের ভাষা বাংলাকে গ্রাস করার অপচেষ্টার শুরু থেকেই প্রতিবাদমুখর হয়ে ওঠে মাদারীপুরের শিবচরের ছাত্র সমাজ। আন্দোলন গড়ে তোলার সঙ্গে সঙ্গে ঢেউ ছড়িয়ে পড়ে ফরিদপুর, শরীয়তপুর ও বরিশালে। ১৯৫২-র রক্তঝরা ঢাকার রাজপথের সেই মিছিলেও অংশ নেন শিবচরের শিক্ষার্থীরা। ভাষা আন্দোলনের অন্যদের নেতৃত্বে ছিলেন ভাষাসৈনিক গোলাম মোস্তফা আখন্দ রতন। ভাষা আন্দোলনে ঢাকায় অংশ নেওয়ার জন্য মাদারীপুর, শরীয়তপুর ও বরিশালের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে কয়েক শ’ ছাত্রের তালিকা করা হয়। তৎকালীন বরিশাল বিএম কলেজের ছাত্র গোলাম মোস্তফা আখন্দ রতন এর আহ্বায়ক নির্বাচিত হন। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি তিনি তার নেতৃত্বে মাদারীপুর, শরীয়তপুর, বরিশাল ও শিবচরের ২০০ শতাধিক ছাত্র নিয়ে আন্দোলনে অংশ নিতে ঢাকায় যান। মিছিল নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ঢুকতেই কার্জন হলের সামনে পুুলিশের মুহুর্মুহু গুলি শুরু হয়। এ সময় মিছিলে অংশ নেওয়া ছাত্ররা মাটিতে শুয়ে জীবন রক্ষা করেন। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম নেতা রমনী চক্রবর্ত্তীর সহকর্মী হওয়ায় পূর্ব থেকেই গোলাম মোস্তফা রতন ছিলেন প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর। তাই ভাষার ওপর আঘাত আসতেই মাদারীপুর, ফরিদপুর, বরিশালে নেতৃত্ব দিয়ে গড়ে তুলেন দুর্বার আন্দোলন। আন্দোলন শেষে গোলাম মোস্তফা ফিরে আসেন নিজ গ্রাম মাদারীপুর জেলার শিবচর উপজেলার উমেদপুর ইউনিয়নের চররামরায়ের কান্দি গ্রামে। স্থানীয় উমেদপুর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করেন। বর্তমানে তিনি মাদারীপুর জেলার শিবচর উপজেলার উমেদপুর ইউনিয়নের চররামরায়ের কান্দি গ্রামের নিজ বাড়িতে ১২ বছর ধরে অসুস্থ অবস্থায় মৃত্যুর প্রহর গুনছেন। ’৫২ সালে শিবচর নন্দকুমার হাই স্কুলের ছাত্ররা ও যুবসমাজ আন্দোলনকে বেগবান করে তোলে। এখানে নেতৃত্ব দেন ভাষা সংগ্রামী গোলাম মোস্তফা আখন্দ, মতিয়ার রহমান মোল্লা, আমির হোসেন, মানিক মুন্সী, মোশারফ হোসেন। শিবচর নন্দকুমার হাইস্কুল ছিল আন্দোলনের ঘাঁটি। এখান থেকেই কর্মসূচী নেওয়া হতো। তারা ছিল ঢাকামুখী, তাই গোলাম মোস্তফা আখন্দ ও মতিয়ার রহমান মোল্লার নেতৃত্বে ঢাকার আন্দোলনে যোগ দেওয়ার জন্য ১৯৫২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি মাদারীপুর, ফরিদপুর, শরীয়তপুর, বরিশাল, চরমুগরিয়া ও শিবচর থেকে ২০০ শতাধিক যুবক ও ছাত্র লঞ্চযোগে ঢাকার উদ্দেশে যাত্রা করেন। তারা ২১ সকালে ঢাকার সদর ঘাটের বাদামতলী নেমে হেঁটে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে রওনা দেয়। তাদের মিছিলটি কার্জন হলের কাছে পৌঁছালে পুলিশী বাধার সম্মুখীন হয়। তখন গোলাম মোস্তফা আখন্দ রতন ছিলেন বরিশাল বিএম কলেজের ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহবায়ক। শিক্ষকতা থেকে অবসর গ্রহণ তিনি নিজ বাড়িতেই অবস্থান করছেন। ১২ বছর ধরে তিনি বার্ধক্যজনিত কারণে ও একাধিকবার হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে অসুস্থ অবস্থায় নিজ বাড়িতে শয্যাসায়ী। তাঁর মুখ বেঁকে গেছে এবং কথা অস্পষ্ট হয়ে গেছে। আবদুল হাই তালুকদার ॥ ভাষা সংগ্রামী আবদুল হাই তালুকদার ছিলেন ৫২’র ভাষা আন্দোলনে মাদারীপুর জেলার ভাষা আন্দোলনের নেতৃস্থানীয়দের একজন। ছাত্র জীবনে ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ ছিল তাঁর জীবনের বড় অর্জন। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি ও সংগ্রামে নিজেকে সম্পৃক্ত করেছিলেন তিনি। ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া এই ছাত্রনেতার সম্পর্কে কোন লেখালেখি হয়নি। বড় বড় মানুষের ভিড়ে ইতিহাসের পাতায় তাঁর নামও নেই। অথচ জেলা পর্যায়ে ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে এরাই বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। ১৯৫২ সালের উত্তাল দিনে আবদুল হাই তালুকদার ছিলেন চরমুগরিয়া মার্চেন্টস উচ্চ বিদ্যালয়ের এসএসসি পরীক্ষার্থী। ভাষা আন্দোলনের তিনি এক জীবন্ত কিংবদন্তী। বয়সের ভাড়ে ন্যূয়ে পড়েছেন। তিনি বর্তমানে খুব অসুস্থ অবস্থায় চরমুগরিয়ার নিজ বাড়িতে অবস্থান করছেন। Ñসুবল বিশ্বাস, মাদারীপুর থেকে
×