ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

অজয় দাশগুপ্ত

বইমেলা, বন্ধু ও দুশমনের ব্যাপারে সজাগ থাকতে হবে

প্রকাশিত: ০৫:৩৩, ৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

বইমেলা, বন্ধু ও দুশমনের ব্যাপারে সজাগ থাকতে হবে

বইমেলা শুরু হয়েছে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী বই পড়েন। শুধু পড়েন না লিখেনও তিনি। এবার তাঁর প্রবন্ধের একটি প্রকাশনার খবর দেখলাম মিডিয়ায়। এই প্রধানমন্ত্রীর হাত দিয়ে এমন কাউকে আমরা পুরস্কার নিতে দেখতে পারি না যার অতীতে আছে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধাচরণ। তাও কিনা তাঁকে একনায়ক বলার মতো লেখার মতো ধৃষ্টতা। এ যেন নব্য মোশতাকদের আনাগোনা। মোশতাকও বঙ্গবন্ধুকে একনায়ক বলতেন। তাকে আমরা ঘৃণা করলে এদের আপন করব কোন্ দুঃখে? এভাবে কি শত্রু ঢুকে সব তছনছ করে দেবে আবার? বলছিলাম বইমেলার কথা। পুলিশের নজরদারি আর নিরাপত্তার বলয়ে শুরু হলো বটে। আশা করব শান্তিতেই শেষ হবে। বইমেলা নিয়ে আমাদের গর্বের শেষ নেই। ঢাকার বইমেলা আকারে বিশালতায় বেশ বড় একটা জায়গা দখল করে নিয়েছে। স্বাধীনতার পর চিত্তরঞ্জন সাহার উদ্যোগে হাঁটি হাঁটি পা পা করে বড় হওয়া আজকের বইমেলা চারিত্রে একেবারেই ভিন্ন। এর গায়ে একদিকে যেমন আধুনিকতার ছোঁয়া আরেক দিকে তার মাটিতে আছে রক্তের দাগ। বাংলা একাডেমির এই বইমেলা একাডেমি আর সকল কাজের মতো কোথাও না কোথাও কিছু ভুল আর ভ্রান্তির পরিচয় রেখেই এগুচ্ছে। যে দেশে যে সমাজে সবকিছু হয় গোঁজামিল অথবা আপোসের গ-িতে বিকৃত সেখানে আমরা নিশ্চয় কোন একটি মেলাকে আদর্শ ও ভালবাসার শীর্ষে দেখব না। তারপরও এই বইমেলা এখন পদ্মাপাড়ের লেখক-লেখিকা ও পুস্তকপ্রিয়দের তীর্থভূমি। আজ বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ পেরিয়ে সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানে বিস্তৃত পরিণত বইমেলা শুধু ছাড়ের দৃষ্টি বা তোষামোদ দাবি করে না। এর সঙ্গে আছে আমাদের প্রত্যাশার কিছু অনিবার্য বিষয়। একটা জরুরী বিষয় মনে রাখা উচিত। মেলাকে কেন্দ্র করে বই, না বইকে কেন্দ্র করে মেলা? এটা মানতে হবে যত প্রকাশনা বাড়বে ততই মঙ্গল। দেশের আনাচে-কানাচে লেখক-লেখিকারা সারা বছর এজন্য প্রস্তুত হয়ে থাকেন। কত নবীন তরুণ-তরুণীর জন্ম হয় এই মেলাকে ঘিরে। তার মূল্য কি সামান্য? কালের বিচারে কে টিকবে কে টিকবে না তার কথা মনে রাখলে লেখার জগত এগুতো না। এমনিতেই আমাদের দেশে সমস্যার অন্ত নেই। মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন ও বাস্তবতা আজ অনেক দূরের দুই প্রতিবেশী। আমাদের তরুণরা আছে মহাবিভ্রান্তিতে। সরকার ও দেশ মুখে যত চেতনার কথাই বলুক তার মাথায় এখন ধর্মের পোকা। এ দেশে এমন দ্বৈত ভাবনা আগে দেখিনি। যারা কবি তারা আজ ধার্মিক হওয়ার বাসনায় উগ্র। যারা লেখক, যারা সুশীল তাদের অন্তর স্বয়ং খোদাও পড়তে পারেন না। সমাজের কোথাও অগ্রসরতার একটা চিহ্ন দেখা গেলে তাকে গিলে খেতে চায় দশটা দানব। তরুণরা কি করে জানবে কোন্টা আসলে ঠিক বা আসল চেহারা? তরুণীদের তো আরও বিপদ। কবিতা লিখলে তারা সমাজ-সংসারে কতটা অপমানিত হতে পারে সেটা ভাবাও কঠিন। আজকাল মা-বাবারাও চান না মেয়েরা তাদের জীবনে অশান্তি টেনে আনুক। তারপরও আমাদের নারীরা বইমেলার এক বিশাল অংশ জুড়ে আছেন। বিষয় হচ্ছে তাদের নিরাপত্তা আর তাদের সামনে যাবার পথ সুগম রাখা। মনে হয় না সেদিকটা নিয়ে বাংলা একাডেমির তেমন কোন ভাবনা আছে। আর থাকলেও কোন পরিকল্পনা আছে কিনা জানা যায় না। আমি যে দেশে থাকি সেখানে বুক ফেয়ার বলে একটা বিষয় চালু আছে। পার্থক্য এই এরা বছরে একবার করে না। নানা কারণে নানা উৎসবে নানা আমেজে তা ঘটতেই থাকে। বইমেলাকে কেন্দ্র করে দেশ জাগিয়ে তোলার যেমন হঠাৎ কোন আয়োজন নেই, তেমনি বই বাদ দিয়ে সারা বছর চলাও জানে না এরা। আমাদের ধারণা বই মানে গল্প, কবিতা কিংবা প্রবন্ধের কিছু একটা। খুব জোর দু-একটা অনুবাদ গ্রন্থ। এ দেশে তো তা না। কে কোথায় বেড়াতে যাবেন, কেন যাবেন তার জন্য আছে ঢাউস যত বই। এসব ট্রাভেল গাইডের কাহিনী ও ধরন উপন্যাসের মতো। আগে ভাবতাম কি দরকার? এখন আমিও এর প্রেমে পড়ে গেছি। ভিয়েতনাম যাব আর কি খাব কোথায় যাব তা জানব না? যাবেন বলিভিয়া, কে আপনাকে জানাবে চে’র কাহিনী? কি করে জানবেন কিউবার ইন্টারনেটের স্পিড কত? কোন্ দেশে কোন্ মুদ্রার চলন, কম্বোডিয়ায় যে এটিএম থেকে হুড়মুড় করে আমেরিকান ডলার বেরোয় সেটা জানতাম কি করে? এ দেশে লাইফ স্টাইলের অধীনে যেসব বই চলে সেগুলোও বেশ মজার। চুল খাড়া রাখা বা চুল কাটার ফ্যাশন থেকে শুরু করে আপনার আগামী বছরের রাশিফলের বইও প্রায় সাহিত্য ছুঁই ছুঁই টাইপের। আমরা এগুলোকে জাতে তুলিনি। অথচ এর প্রয়োজনীয়তা ও বৈচিত্র্য মনকাড়া। দেশে সবচেয়ে অবহেলিত বিজ্ঞান । বিজ্ঞানবিষয়ক কল্পকাহিনীর স্রষ্টাকে আমরা কলাম লেখক বানিয়ে ছেড়েছি। জয় বাংলা থেকে রাজাকার সব বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে এখন আর কেউ এসব নিয়ে মাথা ঘামায় না। আমাদের যৌবনেও আমরা রহস্যকাহিনী আর বিজ্ঞানের কল্পনায় বুঁদ ছিলাম। চিকিৎসা শাস্ত্রের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ক’টা বই বাজারে আসে? মনে পড়ছে চেক দেশীয় এক অধ্যাপকের কথা। যিনি বলেছিলেন, আপনারা একুশের ভাষার সংগ্রামে উদ্দীপ্ত জাতি। এ নিয়ে গর্ব করেন ঠিকই; কিন্তু সব বিষয়ে এখনও মাতৃভাষায় পুস্তক নেই আপনাদের। তাদের ওইটুকু একটি দেশ। অল্প মানুষ। তারপরও আপনি আকাশবিজ্ঞান থেকে সমুদ্রবিদ্যা যাই বলেন না কেন তারা চেক ভাষায় লিখিত বই এনে দিতে পারবে। এর নাম সর্বজনীনতা। বিচিত্র পথের মুখ বন্ধ করে আপনি যদি মাইক হাতে দাঁড়িয়ে থাকেন আর যাকে পাবেন তাকেই বলেন, কেমন লাগছে বইমেলা? কোন ফায়দা আছে কি আসলে? মিডিয়ার এক ধরনের বালকসুলভ চপলতা দেখি আমরা। যেন একুশের সব চেতনা আর ভালবাসার দায় নিয়েছে বাংলা একাডেমির বইমেলা। জীবনের যেসব এলাকায় এখনও অন্ধকার আর অজ্ঞানতার ভিড় তার বিহিত না করে এসব আনন্দের মানে কোথায়? এই সেদিনও আমরা দেখলাম স্টল বরাদ্দ নিয়ে কত ঘটনা। কোন্ প্রকাশক কখন কোথায় কি বিষয়ে মত প্রকাশ করেছিলেন তার শাস্তি হিসেবে তার প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানকে এক হাত নেয়ার আদিমতম জিঘাংসা মনে করিয়ে দেয় সভ্য হওয়ার চর্চা এখনও কতটা জরুরী। রাজনীতি দেশে এমন এক বিষয় চাইলেও আপনি এর বাইরে থাকতে পারবেন না। সে রাজনীতি বইমেলাকে রক্তাক্ত করে ছেড়েছে। আমরা এখানেই হারিয়েছি এ দেশের শক্তিমান লেখক হুমায়ুন আজাদকে। আমাদের চোখের সামনে খুন হয়েছেন মুক্তচিন্তার লেখক অভিজিত রায়। সে বেদনা, সে কষ্ট ভোলার নয়। লেখকের মগজ পড়ে থাকা ফুটপাথের ওপর দিয়ে হেঁটে যাওয়া এ দেশের তরুণ-তরুণীদের মনে কি এই প্রশ্ন জাগবে না তারা আসলে কতটা নিরাপদ? বিচারহীনতার সংস্কৃতি যদি এভাবে চলতে থাকে, যদি এভাবে ঢাকা পড়ে যায় অপরাধ তাহলে কোন বইমেলাই আমাদের জাতিকে উত্তরণের পথ দেখাতে পারবে না। মাঝে মাঝে দূর থেকে মনে হয় আর দশটা নিয়ম ও উৎসবের মতো হয়ে উঠছে এই মেলা। ভাল-মন্দ, শক্তি-অপশক্তি মিলিয়ে এক ধারাবাহিক পরিক্রমা। তারপরও যখন দেখি নতুন বই হাতে একটি কিশোর বা কিশোরীর উজ্জ্বল মুখ, যখন দেখি মা জননী গলদঘর্ম হয়ে খুঁজছেন সন্তানের প্রিয় বইটি, বয়স্ক রিটায়ার্ড মানুষটি ফিরে যাচ্ছেন প্রিয় লেখকের অটোগ্রাফ সংবলিত বই নিয়ে আমরা আশায় বুক বাঁধি। আমরা বুঝি ঢাকা তথা বাংলাদেশ মাথা নত করতে জানে না। তাই আমাদের এই প্রিয় বইমেলাকে ঘিরে স্বপ্ন ও সম্ভাবনা বাড়তেই থাকে। হয়ত একদিন এর হাত ধরেই জেগে উঠবে নতুনভাবে বাঁচার প্রেরণা। জয়তু ঢাকার বইমেলা।
×