ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

রায়হান আহমেদ তপাদার

নতুন মাত্রায় ট্রাম্প-তেরেসা সম্পর্ক

প্রকাশিত: ০৫:৩৩, ৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

নতুন মাত্রায় ট্রাম্প-তেরেসা সম্পর্ক

প্রথম বিদেশী নেতা হিসেবে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী তেরেসা মের হোয়াইট হাউস সফর ও ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠক অনেকেরই আগ্রহের বিষয় ছিল। ট্রাম্প এই সাক্ষাতকে ‘নতুন বিশেষ সম্পর্কের’ সূচনা হিসেবে মূল্যায়ন করেছেন। বৈঠক থেকে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে আসার সময় তেরেসা মের হাত ধরেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। এই ছবি যুক্তরাজ্যের অধিকাংশ গণমাধ্যমের প্রথম পাতায় স্থান পেয়েছে। ট্রাম্প-তেরেসার হাতে হাত রাখা ছবিকে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের মধ্যকার ‘সত্যিকার নতুন সম্পর্কের’ সূচনার প্রতীক হিসেবে মূল্যায়ন করেছে যুক্তরাজ্যের কোন কোন সংবাদমাধ্যম। তাদের কারও কাছে ট্রাম্প-তেরেসাকে মনে হয়েছে এক ‘অদ্ভুত জুটি’। কেউ আবার বলেছে সুখী জুটি। প্রভাবশালী পত্রিকা গার্ডিয়ান শিরোনাম করেছে ‘দ্য নিউ স্পেশাল রিলেশনশিপ’ (নতুন বিশেষ সম্পর্ক)। তবে তারা হোয়াইট হাউসে ‘তাড়াহুড়ার’ সংবাদ সম্মেলনকে ‘লজ্জাজনক’ আখ্যা দিয়েছে। পত্রিকাটি বলেছে, সংবাদ সম্মেলন ছিল সংক্ষিপ্ত এবং শঙ্কায় ঘেরা। সার্বক্ষণিক আশঙ্কা ছিল এই বুঝি ট্রাম্প উদ্বেগজনক কোন মন্তব্য করে ফেলেন; যদিও শেষ পর্যন্ত তা হয়নি। তবে তেরেসা মের জন্য একটা বড় রাজনৈতিক প্রাপ্তি হচ্ছে ‘সামরিক জোট ন্যাটোর প্রতি শতভাগ সমর্থন রয়েছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের’ তেরেসার এমন মন্তব্যের পরও ট্রাম্প ‘হ্যাঁ’ কিংবা ‘না’ কিছুই বলেননি। বিশ্বের অন্যতম সামরিক জোট ন্যাটো নিয়ে নিজেদের ঐকমত্য গড়ার প্রতিজ্ঞা ব্যক্ত করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী তেরেসা মে। সম্প্রতি হোয়াইট হাউসে দুই বিশ্ব নেতার সাক্ষাত শেষে আয়োজিত এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে এ মনোভাবের কথা জানান তারা। যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী তেরেসা মে বলেন, ‘ডোনাল্ড ট্রাম্প শতভাগ ন্যাটোর পক্ষে থাকার কথা জানিয়েছেন। যদিও ট্রাম্প সম্প্রতি ট্রান্সল্যান্টিক এ সামরিক জোটকে সেকেলে বলে মন্তব্য করেছিলেন। বৈঠকে এ দুই নেতাই উভয় দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক আরও শক্তিশালী করতে কাজ করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। তেরেসা মে আরও বলেন, চলতি বছরের শেষের দিকে ডোনাল্ড ট্রাম্প রানীর আমন্ত্রণে যুক্তরাজ্য সফরে যাওয়ার প্রস্তাবে সম্মতি জানিয়েছেন। যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বাণিজ্যিক চুক্তি সই উভয় দেশের সাধারণ মানুষের দাবি। তবে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ত্যাগ না করা পর্যন্ত যুক্তরাজ্য কোন দেশের সঙ্গে বাণিজ্যিক সমঝোতায় যেতে চাইছে না বলেও জানান তেরেসা মে। ট্রাম্প বলেন, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ছাড়ার পর আমরা যুক্তরাজ্যের সঙ্গে বাণিজ্যিক চুক্তি সই করতে চাই। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনের ফোন করার বিষয়ে জানতে চাইলে ট্রাম্প বলেন, এত তাড়াতাড়ি এ বিষয়ে আমি কিছু বলতে চাই না। তবে সবকিছু ঠিক থাকলে ক্রেমলিনের ওপর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা আমি প্রত্যাহার করতে পারি। তিনি বলেন, রাশিয়া ও চীনের মতো দেশের সঙ্গে ‘ভাল সম্পর্ক’ রাখা নেতিবাচক কোন বিষয় না, বরং তা ইতিবাচক। তবে ইতোমধ্যে রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা অব্যাহত রাখার পক্ষে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী তেরেসা মে তাঁর অবস্থান স্পষ্ট করেছেন। তিনি বলেন, এটা খুবই স্পষ্ট যে, আমরা মিনস্ক চুক্তির সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন দেখতে চাই। তাই চুক্তিটি সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা অব্যাহত থাকবে। বুশ-ব্লেয়ারের মধ্যপ্রাচ্য নীতিকে ব্যর্থ উল্লেখ করেছেন তেরেসা মে। তাদের দু’জনের ক্ষমতায় আসার প্রেক্ষাপটও প্রায় একই রকম আর তা হচ্ছে অনেকটা আচমকাই জনমতের বিপরীতে তারা ক্ষমতায় আসীন হন। একই সঙ্গে তারা তাদের নিজ নিজ দেশে আমূল পরিবর্তনের অঙ্গীকার করেছেন এবং তাদের উভয়ের নেতৃত্বের কারণে বর্তমান পশ্চিমা জোটের মিত্ররা গত কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে গুরুতর পরিচয় সঙ্কটের সম্মুখীন হয়েছেন। এই দুই নেতার মাঝে অনেক মিল-অমিল থাকা সত্ত্বেও তারা সুনির্দিষ্ট কিছু পরিকল্পনা নিয়ে এগুচ্ছেন। ব্রিটিশ-মার্কিন ‘বিশেষ সম্পর্কের’ কথা উল্লেখ করে মে বলেন, আশা করি বিশ্বে নতুন করে নিজেদের ভাবমূর্তি গড়ে তোলার ক্ষেত্রে ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্র আর কখনও কোন সার্বভৌম দেশে আগ্রাসন চালাবে না। তিনি মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন-ব্রিটিশ আগ্রাসনকে ‘ব্যর্থ পররাষ্ট্রনীতি’ উল্লেখ করে তাতে আর প্রত্যাবর্তন না করার আহ্বান জানান। দায়িত্ব নেয়ার পর ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী তেরেসা মের সঙ্গে আসন্ন বৈঠকে নবনির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যিক সম্পর্ক উন্নয়নের প্রচেষ্টা নিতে পারেন বলে আভাস দিয়েছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম টেলিগ্রাফ। ব্যাংকিং খাতের প্রতিবন্ধকতা কমিয়ে আনতে দুই দেশের মধ্যে চুক্তি হতে পারে বলে ধারণা করছে তারা। এদিকে অন্যান্য ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যমও ট্রাম্প-তেরেসা বৈঠককে ‘রাজনৈতিকভাবে তাৎপর্যপূর্ণ’ বলে মনে করছে। ৮ নবেম্বরের নির্বাচনে ট্রাম্প জয় পাওয়ার পর থেকেই তার অন্তর্বর্তী দলের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলতে তেরেসা মে-কে খানিক বেগ পেতে হয়েছিল। দায়িত্ব গ্রহণের পর ট্রাম্প যেন প্রথম তেরেসা মের সঙ্গেই বৈঠক করেন সে প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছিল। ডিসেম্বরে তেরেসা মের জয়েন্ট চীফস অব স্টাফ নিক টিমোথি এবং ফিওনা হিল যুক্তরাষ্ট্র সফর করেন এবং ট্রাম্পের অন্তর্বতী দলের সঙ্গে দেখা করেন। এ বৈঠক তেরেসা মের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যমগুলো। নিজস্ব প্রতিবেদককে উদ্ধৃত করে বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, ট্রাম্পের সঙ্গে তেরেসা মের বৈঠক ‘রাজনৈতিকভাবে তাৎপর্যপূর্ণ’। মেক্সিকোর সঙ্গে উত্তপ্ত সম্পর্ক নিয়ে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন ট্রাম্প। তিনি বলেন, সীমান্তে দেয়াল তোলা নিয়ে মেক্সিকান প্রেসিডেন্ট যুক্তরাষ্ট্র সফর বাতিল করার ঘোষণা দিয়েছেন। কিন্তু আমি দেশটির সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে বিশ্বাস করি। তবে ওই দেশটির সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন আমি নিজের দেশের যুবকদের চাকরি হারানোর বিনিময়ে করতে পারি না। তেরেসাকে এ প্রসঙ্গ তুললে তিনি বলেন, এটা একান্তই যুক্তরাষ্ট্র ও মেক্সিকোর দ্বিপক্ষীয় বিষয়। তথ্য আদায়ে নির্যাতন কাজ দেয় বলে ট্রাম্প যে মন্তব্য করেছেন সাংবাদিকরা সেই প্রসঙ্গ তুললে ট্রাম্প আবারও নিজের কথা সমর্থন দেন। তিনি বলেন, নতুন প্রতিরক্ষামন্ত্রী জেনারেল ম্যাটিস বলেছেন, নির্যাতনে তেমন তথ্য আদায় করা যায় না। কিন্তু আমি তার কথার সঙ্গে একমত নই। ট্রাম্প বলেন, তিনি পুতিনকে ব্যক্তিগতভাবে চেনেন না। তবে তার সঙ্গে ভাল সম্পর্ক রক্ষায় তিনি আশাবাদী। রাশিয়ার সঙ্গে মিলে ইসলামিক স্টেটের (আইএস) জঙ্গীদের নির্মূল অভিযান চালানোর ব্যাপারে আশাবাদী বলে জানান ট্রাম্প। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ইলেকটোরাল ভোটে অনানুষ্ঠানিকভাবে বিজয় লাভের পর সংবাদমাধ্যমকে দেয়া সাক্ষাতকারে ডোনাল্ড ট্রাম্প ইঙ্গিত দিয়েছেন, দায়িত্ব পেলে সিরিয়ায় বিদ্রোহীদেরকে সমর্থন দেয়া বন্ধ করে দেবেন। এ সময় রুশ প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনকে ধন্যবাদ জানাতেও দেখা গেছে তাকে। আর তা যুক্তরাজ্যের ভাবনার কারণ হয়ে পড়েছে। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য টেলিগ্রাফের এক প্রতিবেদনে এ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের কূটনৈতিক সম্পর্কে টানাপোড়েন শুরু হওয়ার আশঙ্কা জানানো হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনের সঙ্গে বন্ধুত্ব এবং সিরিয়ার সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক জোরালো করার ব্যাপারে ডোনাল্ড ট্রাম্পের পরিকল্পনা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্য কূটনৈতিক সম্পর্ক টানাপোড়েনের মুখে পড়েছে। এতে ব্রিটিশ-মার্কিন সম্পর্কের টানাপোড়েন বাড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল। টেলিগ্রাফের প্রতিবেদনে বলা হয়, জয় লাভের পর ট্রাম্প যে দৃষ্টিভঙ্গি দেখিয়েছেন, তা ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী তেরেসা মের দৃষ্টিভঙ্গির বিপরীত। কেননা, ব্রিটিশ সরকার সিরিয়া সরকারকে সমর্থন করে না। তেরেসা মের অভিযোগ, সিরিয়ার সরকার ‘নৃশংস সহিংসতা’ চালাচ্ছে এবং ‘আসাদকে ছাড়াই’ সিরিয়ার দীর্ঘমেয়াদী ভবিষ্যত নিশ্চিত হতে পারে। অবশ্য ওয়াল স্ট্রিটকে দেয়া প্রথম সাক্ষাতকারে ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, আসাদকে উৎখাত করার চেয়ে সিরিয়ায় আইএসকে পরাজিত করার ওপর বেশি গুরুত্ব দেবে তার প্রশাসন। ওয়াল স্ট্রিটকে ট্রাম্প বলেছিলেন, সিরিয়া ইস্যুতে অনেক মানুষের চেয়ে আমার ভিন্নমত রয়েছে। আমার দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে, আপনারা সিরিয়ার সঙ্গে লড়াই করছেন, সিরিয়া আইএসের সঙ্গে লড়াই করছে, আপনাদের আইএস থেকে মুক্তি পেতে হবে। রাশিয়া সিরিয়ার সঙ্গে পুরোপুরি যুক্ত হয়ে গেছে। এখন ইরান ক্ষমতাশালী হচ্ছে। এ দেশটিও সিরিয়ার সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়েছে। এখন আমরা সিরিয়ার বিদ্রোহীদের সমর্থন দিচ্ছি এবং আমাদের কোন ধারণা নেই যে, এ লোকগুলো কারা। তিনি আশঙ্কা জানিয়েছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র যদি আসাদ সরকারের ওপর আক্রমণ করে তবে যুক্তরাষ্ট্রকে শেষ পর্যন্ত রাশিয়ার সঙ্গে লড়াই করতে হবে। কেবল রাশিয়া বা সিরিয়া ইস্যুতে নয়, ন্যাটোর ভবিষ্যত নিয়েও ব্রিটিশ সরকারের মাঝে প্রচণ্ড উদ্বেগ। ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার কূটনৈতিক সম্পর্ক নতুন উচ্চতা পেয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী তেরেসা মে। তারা বলেছেন, বিশ্বায়নের এই যুগে একা চলার কোন সুযোগ নেই। এক দেশের উন্নয়ন ও কূটনীতির সঙ্গে অন্য দেশ জড়িত। দ্বিপক্ষীয় কূটনীতিতে যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন একে অন্যের পরিপূরক। এই বিষয়টি উভয়কেই মনে রাখতে হবে। লেখক : শিক্ষাবিদ ও যুক্তরাজ্য প্রবাসী
×