ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

শেফালির হাওয়াই মিঠাই, সপ্তাহে একদিন

প্রকাশিত: ০৫:২১, ৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

শেফালির হাওয়াই মিঠাই, সপ্তাহে একদিন

জান্নাতুল মাওয়া সুইটি ॥ শেফালি একজন গার্মেন্টসকর্মী। সপ্তাহের ছয় দিন তিনি গার্মেন্টসে চাকরি করেন আর প্রতি শুক্রবার ছুটির দিন হাওয়াই-মিঠাই বানিয়ে বিক্রি করেন। তার স্বামী রিক্সা চালায়। তাদের দুজনের উপার্জনে দুই ছেলের পড়ালেখার খরচ কোনমতে চলে। তাই ছুটির দিনটিতে ঘরে বসে থাকতে নারাজ শেফালি। বাড়তি রোজগারের আশায় দুই ছেলে ও হাওয়াই-মিঠাই বানানো লোহা আর টিনের তৈরি মেশিনটি সঙ্গে নিয়ে প্রতি শুক্রবার দুপুরনাগাদ মধুবাগ থেকে বেরিয়ে পড়েন শেফালি। গন্তব্য হাতিরঝিল। রাজধানীর সৌন্দর্যম-িত এই স্থানটিতে অন্যদিনগুলোর তুলনায় শুক্রবার ছুটির দিনে বেড়াতে আসেন অনেকেই। শীতের শেষ বিকেলের সৌন্দর্য উপভোগ করতে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার পর্যটকেরা ভিড় করেন হাতিরঝিলে। তাদের পুঁজি করেই চলে শেফালির একদিনের হাওয়াই-মিঠাই ব্যবসা। শুক্রবার দুপুর তিনটায় হাতিরঝিলে দেখা মিলল শেফালির। সঙ্গে আছে দুই ছেলে হাসান, ইমাম ও হাওয়াই-মিঠাই বানানোর মেশিনটি। ঘাসের ওপর একটি চটের বস্তা পেতে তাতে আসন নিলেন শেফালি। তারপর শুরু করলেন বিশেষ প্রক্রিয়ায় চিনিকে তাপ দিয়ে বিশেষ মেশিনে হাত দিয়ে ঘুরিয়ে হাওয়াই মিঠাই তৈরি। সাদা এবং গোলাপি দু’ধরনের হাওয়াই মিঠাই বানান শেফালি। তবে সাদাটা আগে বানান তিনি। কারণ সাদাটা প্রতি পিস তৈরি করতে তার ২৫ গ্রাম চিনি খরচ হয়। শেফালি বললেন, ‘সাদা হাওয়াই-মিঠাইয়ে চিনিসহ অন্য খরচ মিলিয়ে ৫ টাকার মতো খরচ হয়। আর প্রতি পিস বিক্রি করি ১০ টাকায়। ১ কেজি দিয়ে ৫০ পিস তৈরি করতে পারি। গোলাপিটার খরচ একটু বেশি পড়ে। কারণ ওটার সঙ্গে গোলাপি রং মেশাতে হয়। গোলাপি প্রতি পিস তৈরি করতে ৬ থেকে ৭ টাকা খরচ হয়, কিন্তু ১০ টাকা করেই বিক্রি করি। গোলাপি হাওয়াই মিঠাইতে লাভ একটু কম হয়।’ কথা বলতে বলতে শেফালির প্রথম কাস্টমার এগিয়ে এলো। মুহূর্তেই শেফালি বানিয়ে ফেলল সাদা রঙের একটি হাওয়াই-মিঠাই। তারপর যথারীতি একটি লম্বা কাঠির মাথায় মেশিনে তৈরি হওয়া মিঠাই জড়িয়ে নিয়ে সাদা পলিব্যাগে মুড়িয়ে ক্রেতার হাতে ধরিয়ে দিয়ে ১০ টাকা নিলেন। তারপর আরও একটি হাওয়াই-মিঠাই বানানো শুরু করলেন তিনি। বললেন, ‘আমি রামপুরার একটি গার্মেন্টসে কাজ করি। প্রতি মাসে ৪ হাজার টাকা পাই। ওদের বাবা রিক্সা চালায়। ডেইলি ৫০০ টাকা ইনকাম করে। মধুবাগে যে বস্তিতে থাকি, সেখানে ভাড়া দিতে হয় ২০০০ টাকা। আরও আছে খাওয়া-দাওয়ার খরচ। দুই ছেলেকে পড়তে দিছি একটি কিন্ডার গার্টেন স্কুলে। হাসান পড়ে ক্লাস ফোরে, আর ইমাম পড়ে ক্লাস টুতে। ওদের খাতা কেনা, স্কুলের বেতন, প্রাইভেটের খরচ ইত্যাদি দিয়ে হাতে আর টাকা থাকে না। তাই বাধ্য হয়ে ছুটির দিনে হাওয়াই-মিঠাই বিক্রি করি। সন্তানদের পড়ালেখা শিখিয়ে মানুষ বানাতে সব কষ্টই আমি করতে রাজি।’ এরই মাঝে শেফালির পাঁচটি হাওয়াই-মিঠাই বানানো হয়ে গেল। তারপর সেগুলো পলিব্যাগে ঢুকিয়ে বিক্রির জন্য প্রস্তুত করতে ব্যস্ত শেফালির বড় ছেলে হাসান। সে এখনই রওনা হবে এগুলো বিক্রি করার উদ্দেশে। পাশে বসে হাওয়াই-মিঠাই বানানো দেখছে শেফালির ছোট ছেলে ইমাম। তাকে জিজ্ঞাসা করা হলো- বড় হয়ে তুমি কি হতে চাও? সে বলল, ‘আমি ইঞ্জিনিয়ার হব।’ একটা কবিতা শোনাতে বললে, সে নির্দ্বিধায় বলতে শুরু করল ‘আয় ছেলেরা, আয় মেয়েরা, ফুল তুলিতে যাই। ফুলের মালা গলায় দিয়ে মামার বাড়ি যাই।’ শেফালির ছোট ছেলেটি হয়তোবা জানে না ইঞ্জিনিয়ারের কাজ কি। না বুঝেই ইমাম এখন থেকেই ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার স্বপ্ন বুনছে। আর সেই স্বপ্ন দেখতে শেখাচ্ছে তার মা শেফালি। নিজে শত কষ্ট করেও ছেলেদের মানুষের মতো মানুষ করার স্বপ্ন দেখে এই পরিশ্রমী মা। কালের বিবর্তনে হাওয়াই-মিঠাইয়ের চল কমেছে। কিন্তু কিছু কিছু ব্যবসায়ী আজও এই হাওয়াই মিঠাইকে হাওয়ায় মিলিয়ে যেতে দেয়নি। বংশ পরম্পরায় ব্যবসা চালিয়ে আসছেন তারা। শেফালিও তাদের মতোই একজন। তিনি জানালেন, ‘বাবার কাছ থেকেই শেখা হাওয়াই-মিঠাই বানানোর প্রক্রিয়া। আর এই মেশিনটাও বাবার। আমার বাবা আগে হাওয়াই-মিঠাইয়ের ব্যবসা করেই সংসার চালাতেন।’ শেফালির গ্রামের বাড়ি সাতক্ষীরা। তার বাবা মারা যাওয়ার পর এই মেশিনটি তার কাছেই সংরক্ষিত আছে। আর এখন তো এই মেশিনটি তার বাড়তি রোজগারের একটি অংশ। শেফালী আক্ষেপ করে বললেন, ‘আমাদের জীবনও ঠিক হাওয়াই-মিঠাইয়ের মতোই। কখনও হাওয়া কখনও মিঠা। মেশিনে যতক্ষণ হাত ঘুরাই ততক্ষণ বাবার কথা মনে পড়ে। আমিও ছোটবেলায় বাবার পাশে বসে তার হাওয়াই-মিঠাই বানানো দেখতাম। বানানোর ফাঁকে ফাঁকে আমাকে একটি করে খেতে দিতেন। খুব আনন্দ পেতাম। সেসব এখন শুধুই স্মৃতি।’ হাওয়ার মিঠাই বিক্রি করে লাভ কেমন হয় জিজ্ঞাসা করলে শেফালী বলেন, ‘যদি ৫০-৬০ পিস হাওয়াই-মিঠাই বিক্রি করতে পারি তাহলে প্রায় ৩ হাজার টাকা হয়। এর মধ্যে ১ হাজার টাকা চিনি কেনা ও মেশিনের আনুষঙ্গিক খরচ হয়। সারাদিন বিক্রি করলে হয়তো আরও বেশি বেচা যায়। কিন্তু আমি তো দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বিক্রি করি। তাই বেশিরভাগ দিনই ৪০-৫০ পিস বিক্রি হয়।’ রাজধানীর অন্যান্য জায়গা রেখে শেফালি কেন হাতিরঝিলে আসেন? উত্তরে তিনি বললেন, ‘ হাতিরঝিলের পরিবেশ ভাল। এছাড়া লোকজনের ভিড়ও থাকে। আর আমার ছেলেরাও এই জায়গাটা খুব পছন্দ করে, খোলা হাওয়ায় ঘুরতে পারে। তাই এখানে বসে হাওয়াই-মিঠাই বানিয়ে বিক্রি করি। সন্ধ্যার সময় মা ছেলে মিলে আবার ঘরে ফিরি। ছেলেদের পড়াতে বসাই। আমি পড়ালেখা জানি না। কিন্তু ওরা দুই ভাই যখন জোরে জোরে বই পড়ে তখন আমার বুক ভরে যায়।’
×