ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

আজ শেষ হচ্ছে

একটি কিনলে তিনটি ফ্রি- শেষ মুহূর্তে বাণিজ্য মেলায় মানুষের ঢল

প্রকাশিত: ০৫:২১, ৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

একটি কিনলে তিনটি ফ্রি- শেষ মুহূর্তে বাণিজ্য মেলায় মানুষের ঢল

ওয়াজেদ হীরা ॥ আরও আগেই শেষ হওয়ার কথা ছিল ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা ২০১৭। রাজনৈতিক পরিবেশসহ সব কিছু ঠিক থাকলেও ‘ব্যবসায়ীদের চাপ’ উল্লেখ করে চার দিন বাড়নো হয় মেলার সময়। অবশেষে ভাঙতে যাচ্ছে সেই বর্ধিত বাণিজ্য মেলা। বাণিজ্য মেলায় প্রতিদিনই হাজারো মানুষের পদচারণায় জমজমাট থাকে মেলা প্রাঙ্গণ আর পরিণত হয় মানুষের মিলন মেলায়। আজ শনিবার ভাঙছে একমাসের বেশি সময় ধরে চলা সেই মিলন মেলা। অর্থাৎ আজই মেলার শেষ দিন। ফলে শেষ হচ্ছে বাণিজ্যমেলা আর ভাঙছে মিলনমেলাও। যারা মেলার শেষ সময়ে প্রয়োজনীয় কেনাকাটা করে নিয়েছিলেন তারা এখন শুধুই মেলা দেখতে আসেন। আর যাদের টুকিটাকি বাকি ছিল তারা আসেন সেই বাকি কাজগুলো সেরে নিতে। অতিরিক্ত চারদিন সময় বাড়ানো হলেও জমজমাট ছিল শুক্রবার। সেই একই জমজমাট আজ শনিবারও হতে পারে বলে আশা প্রকাশ করেছেন মেলার একাধিক ব্যবসায়ী। শুক্রবার ছিল ছুটির দিন। মানুষের ভিড়ও ছিল বেশ। বিনোদনহীন নগরীতে ইতোমধ্যেই শুরু হয়েছে বইপ্রেমী মানুষের মেলা ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’। তাই ইচ্ছা থাকলেও বাণিজ্য মেলায় আসেনি বইপ্রেমী এক শ্রেণীর দর্শনার্থী। তাতে মেলায় দর্শনার্থী কম বিষয়টা তাও নয়। সকাল থেকেই মানুষের আগমন শুরু হয়। তবে অন্যান্য সকালের মতো টিকেট কাউন্টারে ভিড় লেগে যায়নি। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষ বেড়েছে। আর কাউন্টারে ভিড় দেখা গেছে দুপুরের পর থেকেই। শেষ সময়ে মেলায় এই কয়েকদিন শুধু কেনাকাটাই নয় পরিবার-পরিজন নিয়ে বিনোদনেরও অন্যতম কেন্দ্র হয়ে উঠেছে মেলাপ্রাঙ্গণ। মেলায় গিয়ে দেখা যায় পরিবার পরিজন নিয়ে মানুষ মেলায় আসছে। বন্ধুদের সঙ্গেও মেলায় এসেছেন কেউ কেউ। জানতে চাইলে আরমান হোসেন ও তার বন্ধুরা জানান, মেলায় কিছু কিনতে নয় শুধুই ছুটির দিনে একটু ঘুরতে এসেছেন। দুপুরের পর থেকে মেলামুখী মানুষের যাত্রা দেখলে যে কারও মনে হতে পারে এ যেন হাজারও মানুষের ছুটে চলা মিছিল যা যাচ্ছে কোন জনসভায়! সব পথই যেন মিশে গেছে মেলা প্রাঙ্গণে এসে। সন্ধ্যায় মেলার ভেতর বাইরে যেন শুধু মানুষ আর মানুষ। এ যেন এক জনসমুদ্র! আর মানুষের চাপে আশপাশের রাস্তায় বেশ জটলা বেঁধে যায়। এদিকে, কেউ কেউ ঘুরতে আসলেও কেউ অবশ্য কিনেছেনও। মেলায় নানা পণ্যে নানা রকম ছাড় দেখে কেউ না কিনে পারেনি। বিভিন্ন পণ্যে দশ থেকে শুরু করে সত্তুর শতাংশ ছাড় দেয়া হচ্ছে। মেলায় বিভিন্ন স্টলে গিয়ে দেখা যায় একটি পণ্য কিনলে তিনটিও ফ্রি দেয়া হচ্ছে। আর শেষ সময়ের কেনাকাটায় মানুষ ফ্রিতে মেতে উঠেছে। বিভিন্ন পণ্যে ফ্রি ও ছাড় দেয়া প্রসঙ্গে ব্যবসায়ীরা জানান, মেলার সময় শেষ পণ্য ফেরত না নিয়ে বিক্রি করতে পারলেই ভাল। এজন্য মূলত ছাড় দেয়া হচ্ছে। এদিকে, মেলায় শেষ সময়ে হকারদের আগমনটা একটু বেশি বাড়াবাড়ি লক্ষ্য করা গেছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মেলার ইজারাদার প্রতিষ্ঠানের একাধিক কর্মকর্তা এ সকল হকারদের মেলায় বসতে দিয়েছে। একাধিক হকারের দেয়া তথ্যে জানা গেছে, যে ব্যক্তি মেলায় বসতে দিয়েছে তাতে প্রতিদিন দোকান হিসেবে টাকা দিতে হয়। প্রতিদিন ৩০০ থেকে ২০০০ টাকা পর্যন্ত দিতে হয় হকারদের। এদিকে, খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মেলার ২০ দিন অতিবাহিত হওয়ার পর থেকে এসব হকার বসানো শুরু হলেও ইপিবিও ইজারাদার প্রতিষ্ঠানের ঐ সকল কর্মকর্তাদের কাছে অসহায়। কারা এসব টাকা নেয় সে বিষয়ে হকাররা কারও নাম বলেনি। শুধু জানান মেলার মালিকের লোক। মেলায় দেখা যায় নানা ধরনের সেলফি স্টিকগুলো হকাররা বিক্রি করছেন ১৫০ টাকা করে। এছাড়াও নানা রকমের খাবার ফেরি করে বিক্রি করছেন তারা। বাচ্চাদের খেলার উপকরণগুলো বিক্রি করতে দেখা গেছে। তবে এসব হকারদের কারণে দর্শনার্থীদের বেশ বিব্রত হতে দেখা গেছে। এদিকে, ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, মেলায় ক্রেতাদের বেশি আগ্রহ গৃহস্থালি পণ্যে। এছাড়া প্রেসার কুকার, জুস মেকার, জুস ব্লেন্ডার, ওভেন, রাইস কুকারসহ নানা ধরনের ইলেক্ট্রনিক পণ্যের চাহিদাও রয়েছে। মেয়েদের থ্রিপিসেও দেয়া হচ্ছে নানা অফার। একটি কিনলে একটি ফ্রি। অথবা তিনটি থ্রি পিস ৫৯৯ টাকা! তরুণীদের ভিড় দেখা গেছে এসব থ্রিপিসের স্টলগুলোতে। হামিদা জামান মেলা থেকে শাড়ি ও থ্রিপিস কিনেছেন। তিনি জানালেন, যে ধরনের থ্রিপিসে ছাড় দেয়া হচ্ছে তা বাইরে কোন অনুষ্ঠানে পরার মতো নয়। তবে বাসায় পরা যাবে। তরুণদের অনেককেই দেখা গেল ব্লেজারের স্টলগুলোতে ভিড় করেছেন। তবে কেনাকাটা খুবই কম। ব্লেজারের চেয়েই বিভিন্ন নামের ছোট কোটগুলোর প্রতি আকৃষ্ট অনেকেই। ক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, শীত নেই আর শীতের প্রকোপ কমে যাওয়ার কারণে ব্লেজারের প্রতি আকর্ষণ নেই। বিক্রেতারাও জানালেন একই কথা। তবে একাধিক বিক্রেতা জানান, মেলা শুরুর কয়েকটা দিন ব্লেজার ভাল বিক্রি হয়েছে। শেষ সময়ে অনেক ব্লেজার বিক্রি হচ্ছে এক হাজার টাকায়। এদিকে, বিভিন্ন জুয়েলারি স্টলগুলোতে বিভিন্ন বয়সীদের ভিড় ছিল। আফসানা বিন মেলায় এসেছেন পরিবারের সঙ্গে। জামার সঙ্গে ‘ম্যাচ’ করে কিনেছেন কানের দুল ও হাতের চুরি ও লিপস্টিক। মেলায় কেনাকাটা নিয়ে তিনি বলেন, অনেক প্রডাক্ট অনেক সময় পাওয়া যায় না। আবার পেলেও মনের মতো হয় না। তবে মেলায় অনেক কিছুই এক সঙ্গে পাওয়া যায় তাই মেলায় আসলে কিছু কেনার চেষ্টা করি। আফসানার বাবা আনোয়ার বিন কবির একজন বেসরকারী চাকরিজীবী। তিনি জানান, মেলা হচ্ছে সবার একটা মেলবন্ধনের মতো। ছুটিরদিনগুলোতে পরিবার নিয়ে একটু বিনোদন হয় কেনাকাটাও হয়। এদিকে, মেলায় ছোটদের বিরক্তি দূর করতে বিজ্ঞানের মজার খেলা নিয়ে ‘অন্যরকম বিজ্ঞান বক্স’ এনেছে অন্যরকম ইলেকট্রনিক্স। এ বিজ্ঞান বক্সের যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে ঘরে বসেই শিক্ষার্থীরা বিজ্ঞানের ব্যবহারিক দিকগুলো নিয়ে কাজ করতে পারবে। স্টল জুড়ে ছোট ছেলে মেয়েদের উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো। স্টলে দেখা গেল, বাণিজ্যমেলায় ৫ ধরনের বিজ্ঞানবক্স পাওয়া যাচ্ছে। আলো, ক্যামেস্ট্রি, ইলেকট্রনিক, ম্যাগনেট ও মেজারমেন্ট নিয়ে। বিজ্ঞানবক্সের এক বিক্রয় প্রতিনিধি বলেন, ছোটদের কাছে পড়াশোনাটা যাতে বিরক্তি না হয় এ কারণে আমরা বিজ্ঞানবক্সের কনসেপ্ট নিয়ে এসেছি। যাতে ছোটরা বিজ্ঞান ও অংকের মতো বিষয়গুলো নিয়ে আনন্দের সঙ্গে পড়াশোনা করতে পারে। এদিকে, ছুটির দিনে বেশ ভিড় দেখা গেছে মেলায় অবস্থিত মিনি পার্কে। সারিবদ্ধভাবে টিকেট কেটে লাইনে প্রবেশ করে পছন্দসই রাইডে চড়ছেন দর্শনার্থীরা। কেউ কেউ আবার প্রবেশ করছেন ছবি দেখতে। সঙ্গীদের সঙ্গে কিংবা পরিবারের সঙ্গে আড্ডার অন্যতম জায়গা হয়ে উঠেছিল বাণিজ্য মেলাস্থল। স্টলে স্টলে কর্মরত বিক্রয় প্রতিনিধিদের কাছেও এটি ছিল ভালবাসার এক মেলবন্ধন। দীর্ঘ একমাসের বেশি সময় একই স্টলে কাজ করতে গিয়ে অচেনা মানুষও চেনা বন্ধু হয়ে গেছে। অথচ সবই সময়ের বাস্তবতার কারণে সবার গন্তব্যে ফিরে যাবে। শুধু স্মৃতিগুলো থেকে যাবে। এই বছরের মেলার স্মৃতিগুলো হয়তো আগামী মেলা কিংবা তারও বেশি সময় রয়ে যাবে একইভাবে। মেলার মেলবন্ধন ভাঙলেও ভালবাসা আর আশা ভাঙ্গে না। যে আশা স্বপ্নবাধে নতুন কিছুর জন্য।
×