ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

প্রতিবছরই উৎপাদন বাড়ছে ॥ বিশ্বে বাংলাদেশ সপ্তম

আলুর বাম্পার ফলনেও চাষীর মুখে হাসি নেই, দাম প্রাপ্তি নিয়ে শঙ্কা

প্রকাশিত: ০৫:৫০, ৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

আলুর বাম্পার ফলনেও চাষীর মুখে হাসি নেই, দাম প্রাপ্তি নিয়ে শঙ্কা

এমদাদুল হক তুহিন ॥ আগাম আলু উৎপাদনের জন্য পরিচিত নীলফামারীতে আলু উত্তোলন শুরু হয় ডিসেম্বরেই। আর রবি মৌসুমের আলু উত্তোলনে জেলাটিতে বর্তমানে চলছে ভরা মৌসুম। একই অবস্থা উত্তরাঞ্চলের শস্যভান্ডারখ্যাত বগুড়ায়। তবে বেশকিছু জেলার আলু উঠতে সময় লাগবে আরও এক মাস। মুন্সীগঞ্জসহ একাধিক জেলার কৃষকেরা আলু ক্ষেতের পরিচর্চায় এখন ব্যস্ত সময় পার করছেন। দম ফেলার ফুসরত নেই তাদের। চলতি মৌসুমে সারাদেশে ৪ লাখ ৮০ হাজার হেক্টর জমিতে ৯৬ লাখ মেট্রিক টন আলু উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত হয়। তবে বছরটিতে আলুর রোপণ হয়েছে ৫ লাখ ২৫ হাজার হেক্টর জমিতে। অর্থাৎ আলুর আবাদ হয়েছে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৪৫ হাজার হেক্টর অধিক জমিতে। এমন পরিস্থিতিতে কৃষক ও কৃষিবিদদের প্রত্যাশা- পূর্বাপর বছরের মতো এবারও আলুর উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাবে। বছরে আলুর বাম্পার ফলন হলেও দাম প্রাপ্তি নিয়ে এরই মধ্যে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। কোন কোন উপজেলায় জাতভেদে আলু বিক্রি হচ্ছে ৫ টাকা কেজিরও কমে। ফলে বাম্পার ফলনে কৃষকের মুখের হাসি মুহূর্তেই ম্লান হয়ে যাচ্ছে। জানা গেছে, উৎপাদনের সূতিকাগার খ্যাত নীলফামারীতে আলু বিক্রি হচ্ছে পানির দরে। জেলায় প্রতি কেজি হল্যান্ডের আলু বিক্রি হচ্ছে ৪ টাকা দরে। আর কৃষক পর্যায়ে কেজি প্রতি আলু বিক্রি হচ্ছে মাত্র ২ টাকায়! তবে জেলার বাজারগুলোতে দেশী আলু বিক্রি হচ্ছে ১০ টাকা কেজি দরে। এক্ষেত্রেও মাঠ পর্যায়ের কৃষকেরা দাম পাচ্ছে অর্ধেকেরও কম। অন্যদিকে বগুড়ার স্থানীয় বাজারে ১০ থেকে ১২ টাকা কেজি দরে আলু বিক্রি হচ্ছে। আর মাঠ পর্যায়ের কৃষকেরা দাম পাচ্ছে কেজি প্রতি ৫ থেকে ৬ টাকা। কয়েকজন কৃষক জানান, প্রতিকেজি আলু উৎপাদনে তাদের খরচ পড়েছে ৭ থেকে ৮ টাকা। তাদের এই লোকসান পুষিয়ে উঠতে বেগ পোহাতে হবে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্যমতে, চলতি বছর সারাদেশে ৪ লাখ ৮০ হাজার হেক্টর জমিতে ৯৬ লাখ মেট্রিক টন আলু উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত হয়। তবে আলু রোপণ হয়েছে ৫ লাখ ২৫ হাজার হেক্টর জমিতে। এদিকে আলু আবাদের অগ্রগতির সর্বশেষ তথ্যে দেখা গেছে, ঢাকা বিভাগে ৫৭ হাজার ৫৫০ হেক্টর জমিতে আলু আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত হলেও বিভাগটিতে আলুর আবাদ হয়েছে ৬০ হাজার ১২৩ হেক্টর জমিতে। ময়মনসিংহ বিভাগে ১৫ হাজার ২৬ হেক্টর জমিতে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত হলেও আবাদ হয়েছে ১৭ হাজার ৪০৫ হেক্টর জমিতে। কুমিল্লায় ২৮ হাজার ৯৩৭ হেক্টর জমিতে আবাদের লক্ষ্য থাকলেও আবাদ হয়েছে ২৯ হাজার ২৪৯ হেক্টর জমিতে। একইভাবে সব বিভাগে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় অবাদের পরিমাণ বেশি। চট্টগ্রামে ৭ হাজার ৭৪১ হেক্টর, রাঙ্গামাটি ১ হাজার ৫০২ হেক্টর, রাজশাহী ৬৯ হাজার ৮৮৮ হেক্টর, বগুড়ায় ১ লাখ ১৪ হাজার ১৬ হেক্টর, রংপুরে ১ লাখ ৫৮২ হেক্টর, দিনাজপুর ৮২ হাজার ৬৬৪ হেক্টর, যশোর ১০ হাজার ৫১৩ হেক্টর, খুলনা ৪ হাজার ৮১৭ হেক্টর, বরিশাল ১০ হাজার ৯০৫ হেক্টর ও ফরিদপুরে ৪ হাজার ৮০৪ হেক্টর জমিতে আলুর আবাদ হয়েছে। অনুরূপভাবে প্রতিটি জেলায়ও লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আবাদ বেশি। আলু চাষীরা বলছেন, মৌসুমের শুরুতে এবার শীতের দেখা মেলেনি। ফলে নানা রোগে আক্রান্ত হয় আলু ক্ষেত। এতে উৎপাদনে কিছুটা প্রভাব পড়তে পারে। একই কথা বলছেন আবহাওয়াবিদরাও। তারা বলছেন, শীত কম পড়ায় এ বছর রবিশস্য উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। তাদের ভাষ্য, মাত্রাতিরিক্ত শীত যেমন ভাল নয়, তেমনি কম শীতও ফসলের জন্য ক্ষতিকর। এক্ষেত্রে আলু উৎপাদনেও নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। তবে কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন, আলুর ক্ষেতে রোগ, পোকা, ভাইরাস ও ছত্রাক দূর করতে কৃষকদের সব ধরনের পরামর্শমূলক সেবা দেয়া হয়েছে। রোগ থেকে পরিত্রাণের জন্য কৃষকদের বীজ শোধন করে রোপণের জন্য বলা হয়েছে। অগ্রহায়ণে আলুর বীজ রোপণ করা হয়। আর মাঘের শেষের দিকে চাষীরা ফলন ঘরে তোলেন। সাধারণত ৩ মাসের মধ্যে আলুর ফলন পাওয়া যায়। এই সময়টিতে কৃষকের যে কোন সমস্যায় মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। তাদের ভাষ্য, শেষদিকে এসে শীতের প্রকট কিছুটা বাড়ায় উৎপাদনে কোন নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না। এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্যমতে, যেসব জেলায় আলু উত্তোলন শুরু হয়েছে সর্বত্রই বাম্পার ফলন হয়েছে। বরং অধিক জমিতে আলুর আবাদ ও উৎপাদন বেশি হওয়ায়Ñ কোন কোন জেলায় আলু বিক্রি হচ্ছে পানির দরে। নীলফামারী ॥ নীলফামারী আলু উৎপাদনের সূতিকাগার হিসেবে পরিচিত। জেলায় আগাম আলু উৎপাদনের জন্য সারাদেশেই পরিচিত। সাধারণত এই জেলার কিশোরীগঞ্জ উপজেলায় আগাম আলু উৎপাদন হয়ে থাকে। জানা গেছে, নবেম্বর থেকে ডিসেম্বরেই আগাম আলুর উত্তোলন শুরু হয়। তথ্যমতে, মাঠ পর্যায়ের কৃষক তখন আলুর দাম পেয়েছে কেজি প্রতি ৫০ থেকে ৫৫ টাকা। নীলফামারীতে উৎপাদিত আগাম আলু মূলত চলে আসে ঢাকায়। এ কারণেই কৃষকরা আগাম আলুর দাম পেয়ে থাকেন। তবে বর্তমানে জেলাটিতে আলু বিক্রি হচ্ছে পানির দরে। নীলফামারী থেকে নিজস্ব সংবাদদাতা জানান, বর্তমানে জেলাটিতে আলু বিক্রি হচ্ছে পানির দরে। এখানে হল্যান্ডের আলু মাত্র ৪ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। তবে মাঠ পর্যায়ে কৃষকরা দাম পাচ্ছে কেজি প্রতি মাত্র ২ টাকা! আর দেশি আলু বাজারে বিক্রি হচ্ছে ১০ টাকা কেজি দরে। এক্ষেত্রেও কৃষক দাম পাচ্ছে অর্ধেকেরও কম। তিনি জানান, রবিশস্যের বাম্পার ফলন ও উৎপাদন বেশি হওয়ায় কৃষক পানির দরে আলু বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন। কিশোরীগঞ্জ উপজেলার দূরাকুটি গ্রামের আলু চাষী আলম হোসেন ও কালিকাপুর গ্রামের রমজান আলী জানান, বাম্পার ফলন হলেও খরচের টাকাই উঠে আসবে না। বর্তমানে জেলাটিতে আলুর দাম-ই পাওয়া যাচ্ছে না। পাইকারি বাজারে হল্যান্ডের আলু বিক্রি করতে হচ্ছে পাল্লা প্রতি মাত্র ১০ টাকায়। এক্ষেত্রে কেজি প্রতি দাম পড়ছে ২ টাকা! আর খুচরা বাজারে একই আলু বিক্রি হচ্ছে কেজি প্রতি ৪ টাকায়। আর দেশী আলু বিক্রি হচ্ছে কেজি প্রতি ১০ টাকায়। বগুড়া ॥ চলতি মৌসুমে বগুড়ায়ও আলুর বাম্পার ফলন হয়েছে। তবে এই জেলাটিতেও মাঠ পর্যায়ে কৃষকেরা আলুর দাম পাচ্ছে না। চলতি মৌসুমে বগুড়ায় ৫৮ লাখ ২৫০ হেক্টর জমিতে ১১ লাখ ৫৭ হাজার ১৯ মেট্রিক টন আলু উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত হয়। জেলার কৃষি কর্মকর্তাদের তথ্যমতে, লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ৩০ শতাংশ বেশি জমিতে আলুর আবাদ হয়েছে। ফলে জেলাটিতে আলুর উৎপাদনও হবে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ৩০ শতাংশ বেশি। বগুড়া অফিস জানায়, জেলার শিবগঞ্জ, চন্দ্রিহারা, মোকামতলা ও শাহজাহানপুরে এবার আলুর বাম্পার ফলন হয়েছে। মূলত এই অঞ্চলগুলোতেই সবচেয়ে বেশি আলু উৎপাদিত হয়। তিনি বলেন, বগুড়ায় খুচরা বাজারে ১০ থেকে ১২ টাকা কেজি দরে আলু বিক্রি হচ্ছে। আর মাঠ পর্যায়ের কৃষকেরা দাম পাচ্ছে মাত্র ৫ থেকে ৬ টাকা কেজি। তবে জেলাটিতে প্রতি কেজি আলু উৎপাদনে কৃষকের খরচ পড়েছে ৭ থেকে ৮ টাকা। ফলে উৎপাদন খরচ উঠিয়ে আনতেই তাদের বেগ পোহাতে হবে। মোকামতলার কৃষক আজিজুল ইসলাম জানান, জেলায় আলুর দাম কম থাকায় তারা জমি থেকে আলু উত্তোলন করছেন না। তবে ক্ষেতে খুব বেশিদিন এভাবে আলু রাখা যাবে না। তারা অপেক্ষা করছেন কখন আলুর দাম বাড়বে। আর ঠিক তখনই তারা ক্ষেত থেকে আলু উঠাবেন। মুন্সীগঞ্জ ॥ মুন্সীগঞ্জের আলু চাষীরা মাঠে এখন ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। বছরটিতে এ জেলায় রেকর্ড পরিমাণ আলু রোপণ হয়েছে। জানা গেছে, কোন কোন ক্ষেতে আলুর গাছ এখনও ছোট। কোনটিতে গাছ সবুজ হয়ে উঠেছে। মাঠে মহাব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন আলু চাষীরা। যোগ হয়েছেন শ্রমিকরাও। এক্ষেত্রে জেলাটির আলু ক্ষেতে নারী শ্রমিকদেরও লক্ষ্য করা যাচ্ছে। মুন্সীগঞ্জ থেকে স্টাফ রিপোর্টার জানান, মুন্সীগঞ্জে আলুর উত্তোলন শুরু হবে মার্চের প্রথম সপ্তাহে। বর্তমানে ক্ষেতগুলোতে শ্রমিকরা ব্যস্ত সময় পার করছেন। গেল বছর জেলার ৩৮ হাজার ৫৫০ হেক্টর জমিতে ১৩ লাখ ৫১ হাজার টন আলু উৎপাদন হয়। আর এবার আবাদ হয়েছে ৩৯ হাজার ৩০০ হেক্টর জমিতে। জেলাটিতে এ বছরও আলু উৎপাদনে লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাবে। মুন্সীগঞ্জের মতো সারাদেশের আলু উঠে আসতে আরও এক মাস সময় লাগবে। কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়া উপজেলার আলু চাষীরা ক্ষেত পরিচর্চায় ব্যস্ত সময় পার করছেন। এই উপজেলার হরশী গ্রামের কৃষক হিমেল কবির জনকণ্ঠকে বলেন, প্রথম দিকে শীতের তীব্রতা তেমন ছিল না। ফলে আলু ক্ষেত নানা রোগে আক্রান্ত হয়। তবে শেষ দিকে এসে কিছুটা শীত পড়ায় আগের সমস্য কাটিয়ে উঠা সম্ভব হয়েছে। এখন মাঠের পর মাঠ সবুজ। সবাই মহাব্যস্ত। আশা করা যায় এবারও বাম্পার ফলন হবে। তবে আমাদের প্রত্যাশা একটাইÑ বাম্পার ফলনের সঙ্গে সঙ্গে যেন আলুর সঠিক দাম পাওয়া যায়। আলুর উৎপাদন বাড়ছে প্রতি বছর ॥ টানা কয়েক বছর ধরে আলুর উৎপাদন ৮২ থেকে ৮৯ লাখ টনের ঘরে ওঠানামা করছিল। ২০১৫ সালে প্রথমবারের মতো তা ৯০ লাখ টন ছাড়িয়ে ৯২ লাখ ৫৪ হাজার টনে পৌঁছে। ২০১৬ সালে দেশে আলু উৎপাদন হয়েছিল প্রায় ৯৫ লাখ টন। তথ্য থেকে জানা যায়, ২০১০-১১ অর্থবছরে দেশে আলু উৎপাদন ৮৩ লাখ টন ছাড়িয়ে যায়। যদিও পরের অর্থবছর তা কিছুটা কমে দাঁড়ায় ৮২ লাখ ৫ হাজার টনে। ২০১২-১৩ অর্থবছরে তা আবার বেড়ে ৮৬ লাখ ৩ হাজার টনে পৌঁছে। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৮৯ লাখ ৫০ হাজার টন। বিশ্বে সপ্তম ॥ আলু উৎপাদনের দিক থেকে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) আলুর উৎপাদন বিষয়ক সর্বশেষ এক পরিসংখ্যান থেকে জানা যায় আলু উৎপাদনে বৈশ্বিকভাবে বাংলাদেশ সপ্তম স্থানে রয়েছে। তালিকায় সবার উপরে রয়েছে চীন। ক্রমানুসারে তারপরই আছে ভারত, রাশিয়া, ইউক্রেন, যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানি। সামগ্রিক প্রসঙ্গে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের সরেজমিন উইং’র মনিটরিং ও বাস্তবায়ন বিভাগের অতিরিক্ত পরিচালক ড. আলহাজ উদ্দিন আহমেদ জনকণ্ঠকে বলেন, এখন পর্যন্ত সারাদেশে রবিশস্যের আবাদ ভাল। কোন ধরনের দুর্যোগ বা রোগ-বালাই দেখা দেয়নি। এ বছরও আলুর বাম্পার ফলন হবে বলে আমরা আশাবাদী।
×