ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

লিটন আব্বাস

লড়াকু মা ঝর্ণা এবং মেয়ে শম্পা

প্রকাশিত: ০৫:৪৭, ৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

লড়াকু মা ঝর্ণা এবং মেয়ে শম্পা

কত বড় স্বপ্ন বুকের মাঝে পুষলে, কতখানি আকাক্সক্ষা অন্তরে লালন করলে, কতটা মনের জোর থাকলে একজন মানুষ সত্যিকার মানুষরূপে আবির্ভূত হতে পারে। ইচ্ছাশক্তি কতটা প্রবল হলে একজন নারী প্রত্যয়ী হয়ে ওঠে তারই উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত কুষ্টিয়ার কুমারখালীর তেবাড়িয়ার স্বপন মজুমদারের স্ত্রী ঝর্ণা মজুমদার। ২০০১ সালে স্বামীর ক্ষুদ্র ব্যবসা লোকসানের মুখ দেখলেও ভেঙ্গে না পড়ে একমাত্র কন্যা সন্তান নিয়ে জেগে উঠেছেন এই সংগ্রামী নারী। পল্লীতে থেকে কন্যা সন্তানকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করার মানসে তিনি স্বামীর আর্থিক অনটনের ওপর দাঁড়িয়েও কাগজের ঠোঙা বানিয়ে তা বিক্রি করে, ধার-দেনা করে, কিছু মানুষের সহযোগিতায় কন্যা শম্পা মজুমদারকে প্রতিষ্ঠিত করছেন। প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পেরিয়ে এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে মেধার ভিত্তিতে পড়ছেন ঝর্ণা মজুমদারের মেয়ে শম্পা মজুমদার। ‘আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যত’Ñরেডিওতে এই সেøাগান শুনে তৃতীয় শ্রেণী পড়–য়া ঝর্ণা মজুমদারের মনের মধ্যে স্বপ্ন উড়তে শুরু করে। আর্থিক দৈনতায় এই সংগ্রামী মা লেখাপড়া শিখতে না পারলেও তিনি তার সন্তানকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করে মেয়ের ইচ্ছা পূরণের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। মেয়েকে প্রতিষ্ঠিত করতে যত সংগ্রাম যত ঝড়-ঝাপ্টা, ত্যাগ-তিতিক্ষার দরকার তার সবটুকু করতে প্রস্তুত এ নারী। মেয়েকে দয়রামপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পিএসসি পড়িয়ে কুমারখালী শহরে চলে আসেন। শহরের এলঙ্গীপাড়ায় ১৫০০ টাকা ঘর ভাড়া করে পরিবার নিয়ে থাকেন। কুমারখালী পাইলট গার্লস হাই স্কুলে মেয়েকে ষষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি করিয়ে দেন। সেখান থকে জেএসসি ও এসএসসি (মানবিক বিভাগে) পাস করে কুমারখালী আদর্শ মহিলা ডিগ্রী কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে ২০১৬ সালে। ২০১৭ সালে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় শম্পা মজুমদার মেধা তালিকায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে মানবিক বিভাগে ৩টি বিষয়ে, গোপালগঞ্জ ও ময়মনসিংহের ত্রিশালের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩টি বিষয়ে ও কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ পায়। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ পাওয়া শম্পা শেষ পর্যন্ত বেছে নিয়েছেন ময়মনসিংহের ত্রিশালের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজী বিষয়। সেখানেই তিনি অনার্স প্রথম বর্ষে ভর্তি হয়েছেন। ঝর্ণা মজুমদার জানান, তার মেয়েকে তিনি মানুষের মতো মানুষ করতে চান। মেয়েকে এ পর্যন্ত আনতে তাঁকে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। ছল ছল চোখ আর কষ্টে ভরা কণ্ঠে ঝর্ণা মজুমদার বলেন, আমার মেয়েকে আমি মানুষের মতো মানুষ করতে চায়। অনেক কষ্টে এ পর্যন্ত এনেছি। বিশ্বাস করবেন না, আমার মেয়ে নিজের ইচ্ছাতে এতদূর এসেছে। ও কোন দিন কোন শিক্ষকের কাছে আলাদাভাবে পড়তে পারেনি। মেয়ে বলে মা, আমি ম্যাজিস্ট্রেট হব, তুমি দেখে নিও। আমি ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি যেন আমার মেয়ের স্বপ্ন পূরণ হয়। সংগ্রামী এই জননীর কন্যা শম্পা মজুমদার আর্থ্রাইটিস রোগে আক্রান্ত হওয়ার পরও কোন বাধাই তাকে আটকে রাখতে পারেনি। অসুস্থ অবস্থায়ও মনের জোরে পড়াশোনাটা চালিয়েছে। কোন প্রতিকূল অবস্থায় তাদের আটকাতে পারেনি। বর্তমানে শম্পার স্বামী ক্ষুদ্র ব্যবসায় জড়িত। তার যেটুকু উপার্জন তা দিয়ে সংসার সামলে মেয়েকে ত্রিশাল ময়মনসিংহে পড়াশোনা করাতে আরও আর্থিক প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়তে হবে পরিবারটিকে। তবু সংগ্রামী ও স্বপ্নধারিণী মা থেমে থাকবেন না। তার দৃঢ়কণ্ঠে স্পষ্ট উচ্চারণÑ মেয়ে মানুষ হয়ে নিজের এবং দেশের মানুষের উপকার করবে। একই আওয়াজ মেয়ের কণ্ঠেও। এই সরল ও স্বপ্নময় উচ্চারণে এ কথা পরিষ্কারÑএই নারী বিজয়ী হবে এবং তার কন্যার উজ্জ্বল সম্ভাবনাও বাস্তবে রূপ নেবে। এ কারণে ঝর্ণা মজুমদার মেয়ের উচ্চ শিক্ষার জন্য কুমারখালী উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা আনিসা আফরোজের কাছে গেলে তিনি সহজ শর্তে ঋণ দেয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। সংগ্রামী নারী শিক্ষাদাত্রী ঝর্ণা মজুমদারের চোখে স্বপ্নের জল ঝরে প্রতিদিন। তা একটু একটু করে সঞ্চিত করে কন্যার জন্য। তার আকুতি এই স্বপ্ন পূরণে সমাজের শিক্ষানুরাগীরা সহযোগিতা করলে তিনি একটি আদর্শ, সৎ, দেশপ্রেমিক সন্তানকে ঠিকই মানুষ বানাতে পারবেন। সমাজের পিছিয়ে পড়া অসহায়, দরিদ্র ঝর্ণা মজুমদার ইচ্ছের শক্তির জয় হোক...! শর.ষরঃড়হ৮৪@মসধরষ.পড়স
×