নিখিল মানখিন ॥ আদালতের কয়েকবার নির্দেশনার পরও ব্যবস্থাপত্রে অনেক চিকিৎসকের হাতের লেখা পাঠোপযোগী হয়ে উঠছে না বলে অভিযোগ উঠেছে। চলতি বছরের জানুয়ারির শুরুতে বাংলাদেশের উচ্চ আদালত এক নির্দেশনায় চিকিৎসকদের স্পষ্টাক্ষরে পাঠোপযোগী ব্যবস্থাপত্র লিখতে বলে। সেই সঙ্গে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে এ বিষয়ে নির্দেশনা জারি করতে নির্দেশ দেয় আদালত। কিন্তু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এখন পর্যন্ত কোন নির্দেশনা দেয়নি বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। আর সেই সুযোগে ব্যবস্থাপত্রে অনেক চিকিৎসকের দুর্বোধ্য হাতের লেখা অব্যাহত রয়েছে। এমন ব্যবস্থাপত্র হাতে নিয়ে দুর্ভোগে পড়ছে রোগী ও ওষুধ বিক্রেতারা। এক ওষুধের পরিবর্তে অন্য আরেকটি ওষুধ কেনা-বেচার ঘটনাও ঘটছে বলে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে।
ব্যবস্থাপত্রে চিকিৎসকদের দুর্বোধ্য ও অস্পষ্ট হাতের লেখা নিয়ে আলোচনা দীর্ঘদিনের। অভিযোগ উঠেছে, হাতে লেখা প্রায় দুর্বোধ্য প্রেসক্রিপশনের কারণে প্রতিদিন অনেক মানুষ বিড়ম্বনার শিকার হন। ভুক্তভোগী রোগী, স্বজন ও ওষুধ দোকানি অনেকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চিকিৎসক হাতে লিখে যে প্রেসক্রিপশন দেন, তা পড়ে ৯০ শতাংশ সাধারণ মানুষ ও ফার্মেসির কর্মচারীরা বুঝতে পারেন না। এতে অনেক সময় ওষুধ পাল্টে যাচ্ছে; ব্যবহারের সময় ও ধরন নিয়েও বিপত্তি ঘটছে। এমন পরিস্থিতিতে স্পষ্টাক্ষরে পড়ার উপযোগী করে চিকিৎসকদের প্রেসক্রিপশন লেখার নির্দেশনা দিয়ে গত ৯ জানুয়ারি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে আগামী ৩০ দিনের মধ্যে সার্কুলার জারির নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট। একই সঙ্গে রোগীর প্রেসক্রিপশনে ওষুধের জেনেরিক নাম লিখতে কেন নির্দেশ দেয়া হবে না- তা জানতে চেয়ে রুল জারি করা হয়েছে। স্বাস্থ্য সচিব, স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালকসহ সাত বিবাদীকে চার সপ্তাহের মধ্যে এর জবাব দিতে হবে।
দুর্ভোগ ॥ চিকিৎসকের হাতে লেখা প্রেসক্রিপশন নিয়ে প্রায়ই বিভ্রান্তি ও ভোগান্তিতে পড়তে হয় বলে জানালেন ফার্মগেটের তেজতুরিবাজার এলাকার চৈতি ফার্মেসির ওষুধ বিক্রেতা মোঃ হুমায়ুন। তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, প্রতিদিনই এমন ঘটনা পাওয়া যায়। অনেক সময় প্রেসক্রিপশনের লেখা পড়তে পারি না। তবে পড়তে না পারার বিষয়টি লুকিয়ে রেখে ওষুধটি দোকানে নেই বলে ক্রেতাদের বিদায় করে দেই। রাজধানীর শাহবাগের নিরাময় ফার্মেসির ওষুধ বিক্রেতা সুমন চৌধুরী জনকণ্ঠকে জানান, আজকাল এটা কোন ঘটনা না। প্রতিদিন এমন সমস্যায় পড়তে হয়। অনেক চিকিৎসকের হাতের লেখা জটিল হওয়ায় ওষুধের নাম বুঝতে সমস্যা হয়। তখন রোগী বা স্বজনদের কাছ থেকে রোগ সম্পর্কে জেনে ওষুধের নাম ধারণা করা হয়। এতেও বুঝতে না পারলে আমরা ওষুধ বিক্রি করি না। কেউ কেউ ভুল ওষুধও দিয়ে থাকে। আরেক দোকানদার আব্বাস আলী বলেন, চিকিৎসকের হাতে লেখা প্রেসক্রিপশন ছোট-বড় হরফে না লিখে শুধু বড় হরফে লিখলে পড়তে সহজ ও সুবিধা হয়। তবে কম্পিউটারে টাইপ করা প্রেসক্রিপশন লিখলে সবচেয়ে ভাল হয়। রাজধানীর কয়েকটি বেসরকারী হাসপাতালের চিকিৎসকরা কম্পিউটারে টাইপ করা প্রেসক্রিপশন রোগীদের সরবরাহ করেন এবং এর ফলে সহজেই সঠিক ওষুধ দেয়া যায় বলে জানান তিনি। এভাবে দেশের সর্বত্রই অভিন্ন চিত্র দেখা যাচ্ছে।
ফার্মাসিস্ট ছাড়াই চলছে ফার্মেসি ॥ ওষুধ বিক্রেতাদের সংগঠন বাংলাদেশ কেমিস্টস এ্যান্ড ড্রাগিস্টস সমিতির সাবেক উপ-সচিব মনির হোসেন জানান, প্রায় নব্বই ভাগ চিকিৎসকের হাতের লেখাই স্পষ্ট করে বোঝা যায় না। ফার্মাসিস্ট ছাড়া ওষুধের দোকান চালানো বেআইনী। অথচ দেশের বেশিরভাগ ফার্মেসিতে বিক্রয় প্রতিনিধি অষ্টম শ্রেণী, এসএসসি কিংবা এইচএসসি পাস। স্বল্প শিক্ষিত বিক্রয়কর্মীরা অনেক সময় ইংরেজী ভালভাবে বুঝতে পারেন না, এজন্যও সমস্যা হয় বলে জানান তিনি।
ঔষধ প্রশাসন অধিদফতর জানাচ্ছে, দেশে বর্তমানে এক লাখ ২৩ হাজার ওষুধের দোকানের নিবন্ধন রয়েছে। এগুলো ছাড়াও প্রায় ৮ থেকে ১০ লাখ অনিবন্ধিত ওষুধের দোকান রয়েছে বলে সংশ্লিষ্টদের ধারণা। এ বিষয়ে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের পরিচালক মোহাম্মদ রুহুল আমিন বলেন, ফার্মাসিস্ট দেখেই ওষুধের দোকানগুলোর নিবন্ধন দেয়া হয়েছে। কিন্তু পরে দেখা গেছে, নাম ব্যবহার করা হলেও দোকানে ফার্মাসিস্ট থাকছেন না। তাই নতুন করে ফার্মেসির নিবন্ধন দেয়া বন্ধ রাখা হয়েছে। একই সঙ্গে আদর্শ মডেল ফার্মেসি চালু করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। পর্যায়ক্রমে সারাদেশে মডেল ফার্মেসি চালু হলে মানুষের দুর্ভোগ কমবে।
বাংলাদেশ মেডিক্যাল এ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডাঃ রশিদ-ই মাহবুব বলেন, চিকিৎসকদের হাতের লেখা জটিল হওয়ার পাশাপাশি ফার্মেসির ওষুধ বিক্রয় প্রতিনিধিদের অদক্ষতার কারণে সমস্যা দেখা দিচ্ছে। চিকিৎসকরা ইংরেজী ক্যাপিটাল লেটারে ব্যবস্থাপত্র লিখলে এবং ফার্মেসিতে প্রশিক্ষিত ও দক্ষ বিক্রয়কর্মী নিয়োগ করার গেলে এ সমস্যা কমতে পারে। তিনি বলেন, চিকিৎসকদের দিয়ে ডিজিটাল পদ্ধতির বা কম্পিউটার টাইপ করা ব্যবস্থাপত্র লেখানো গেলে ভোগান্তি পুরোপুরি দূর হবে।
বিএমএর সাবেক মহাসচিব অধ্যাপক ডাঃ ইকবাল আর্সলান উন্নত দেশগুলোর অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও মালয়েশিয়ার হাসপাতালগুলোতে প্রত্যেক রোগীর জন্য আইডি নম্বরসহ পৃথক ফাইল খোলা হয়। ওই ফাইলে রোগীর রোগসহ শারীরিক বিভিন্ন সমস্যা লিপিবদ্ধ করা থাকে। তা ইন্টারনেটে ও কম্পিউটার সার্ভারে সংরক্ষণ করা হয়। রোগীর আইডি নম্বরে ক্লিক করলে তার রোগসংক্রান্ত পূর্ব-ইতিহাস বিস্তৃতভাবে জানা যায়। তিনি বলেন, এ ধরনের প্রক্রিয়া চালু করতে এবং চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ডিজিটাল করতে বেশি সমস্যা হওয়ার কথা নয়। এ বিষয়ে সরকার ও সরকারী হাসপাতালগুলোর সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে উদ্যোগী হতে হবে। তাহলে এটি চালু করা সম্ভব হবে, চিকিৎসা নিয়ে বিড়ম্বনাও কমবে।
আরো পড়ুন
শীর্ষ সংবাদ: